শাওন বলল, আজ রাতের ভেতরে যে করেই হোক পালাতে হবে। তাই যা যা নেওয়ার গোপনে গোপনে সবকিছু যেন গোছগাছ করে নেয়। জেরিন আগেভাগেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে যা যা নেওয়ার ব্যাগে ভরে রেখেছে।
রাত তখন একটা কি দেড়টা হবে। পুরো শহর নীরব, নিস্তব্ধ। মা ও ছোট বোনটা ঘুমিয়ে আছে। জানালা দিয়ে চাঁদের এক টুকরো আলো পড়েছে ছোট বোনটির মুখের ওপর। কি ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে আজ তাকে! জেরিন চোখ বন্ধ করে চুপিচুপি বেরিয়ে গেল রুম থেকে। একটিবারের জন্যেও ওর পাষাণ হৃদয়টা কেঁপে উঠল না মা আর ছোট বোনটির চেহারা মনে করে!
শাওন সিএনজি নিয়ে জেরিনদের বাসার সামনেই অপেক্ষা করছিল। জেরিন আসামাত্রই দ্রুত সিএনজি স্টার্ট দিল ড্রাইভার। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা পর ওরা পৌঁছে গেল অন্য শহরে। সেখানে আগে থেকেই সবকিছু ঠিক করে রেখেছিল শাওন।
এক দেড় মাস বেশ শান্তিতেই কাটল ওদের সংসার। দুজনের মাঝে আদান-প্রদান হলো সঞ্চিত সবটুকু ভালোবাসা। কিন্তু এই ভালোবাসা আর স্থায়ী রইল না। দেড় মাস পর শাওনের জমানো সব টাকা ফুরিয়ে গেল। দু’ মুঠো ভাত খেতেই তখন ওদের হিমশিম অবস্থা। তার ওপর জেরিন শুনল, ও নাকি নিয়মিত জুয়া খেলে। ভালোবাসা রূপ নিল ঘৃণায়। ক্রমেই দুজনের মধ্যে ঘটতে থাকল সম্পর্কের অবনতি। শাওন দুর্ব্যবহার করতে থাকে জেরিনের সাথে। এমনকি গায়ে হাতও তুলে একপর্যায়ে। দিনদিন মারপিট যেন বেড়েই চলে।
জেরিনের চোখ খুলে যায়, ঘটে যাওয়া এই অন্যায় আর অপূরণীয় এই ক্ষতির কথা ভেবে। কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে ও না পারে মাকে মুখ দেখাতে, আর না পারে অন্য কোনো আত্মীয়ের কাছে একটুখানি ঠাঁই নিতে। সবকিছু সয়ে তাই শাওনের কাছেই থেকে যায় ও।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বাসা থেকে উধাও হয়ে যায় শাওন। একদিন দুদিন করে করে কেটে যায় চার চারটি মাস। শাওন আর ফিরে আসে না।
জেরিনের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তুমুল গাঢ় সে অন্ধকার। জেরিন সে অন্ধকারে পথ খোঁজে পায় না। এদিক-ওদিক কোনোদিকেই সন্ধান পায় না এক টুকরো আলোর। উদ্ভ্রান্ত পথিকের মতো দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকে এদিক-ওদিক। হোঁচট খায় পথের এখানে-সেখানে।
জেরিন সেই পড়ে যাওয়া থেকে আর উঠতে পারে না। জীবন তখন দুর্বিষহ হয়ে উঠে তার জন্য।
একদিন কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে সে। বাসা ছেড়ে একাকী বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে। তারপর আর কোনো খোঁজ নেই।
পুনশ্চ : সেদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় থেঁতলে যাওয়া একটা ছবিসহ বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম ছিল এমন—‘ট্রেনচাপায় এক তরুণীর আত্মহত্যা।’