দৃশ্যপট-১: 

সেলিব্রেটি খেলোয়াড় ঘোষণা দিলেন, তার ভক্তদের একজনকে তার একটি জার্সি উপহার দেবেন। তবে সেটার জন্য কিছু নিয়মকানুন মানতে হবে। তরুণ-যুবারা সেই ঘোষণা শুনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। প্রিয় খেলোয়াড়ের জার্সি বলে কথা! পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু! যেভাবেই হোক, যেকোনো মূল্যে সেটা পেতেই হবে! স্বপ্নের খেলোয়াড়ের গায়ের স্পর্শ লেগে আছে সেই জার্সিতে। আহ.. ভাবতেই হৃদয় বারবার আন্দোলিত হচ্ছে!

দৃশ্যপট-২: 

চাঁদের চেয়েও সুন্দর একজন মানুষ। কিন্তু তাঁর পরনের জামাটি ছেঁড়া। সেটা দেখে আরেকজন মানুষ—যিনি কি না তাঁকে খুব ভালোবাসেন—সেই মানুষটিকে সুন্দর একটি জামা উপহার দিলেন। সুন্দর মানুষটি উপহারের জামাটি বাড়ির ভেতর থেকে পরে আসলেন। জামাটি দেখে আবার আরেক ব্যক্তি আবদার করে বসলেন, ‘আপনি কি আমাকে এই জামাটি উপহার দেবেন?’

মুচকি হেসে তিনি জামাটি খুলে দিলেন; যদিও এটা ছাড়া তাঁর আর কোনো ভালো জামা ছিল না। তাও তিনি বিনা দ্বিধায় সেটা দিয়ে দিলেন! এটা দেখে আশেপাশের মানুষেরা খানিকটা বিরক্ত হলেন। জামাটি তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়ার কী দরকার ছিল! তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন এমনটা করলে? তুমি জানো না, তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি কখনো না করেন না?’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি তো এটাই চেয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জামা যেন আমার কাফন হয়!’

এই ছিল আল্লাহর রাসূলের প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসার একটি নমুনা।

দুটি দৃশ্যপটের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন। দুটোতেই ভালোবাসার গল্প আঁকা হয়েছে। কিন্তু দুটি দৃশ্যপটের ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। একটিতে ভালোবাসা হয়ে গিয়েছে অন্তঃসারশূন্য; আরেকটিতে ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়ে ধন্য হয়েছে!

আমরা সবাই কাউকে না কাউকে খুব ভালোবাসি। ভালোবাসা প্রকাশের ব্যাপারে আমরা বেশ পারদর্শী। কিন্তু আফসোস, সঠিক জায়গায় ভালোবাসার প্রয়োগ করতে পারি না আমরা। আমাদের অন্তর আজ বেদখল হয়ে গেছে! আর তাই, অপাত্রে অনুভূতি বিলিয়ে দিই আমরা।

যেই ভালোবাসার হক আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্য বরাদ্দ করার কথা ছিল, সেই ভালোবাসা আমরা অপচয় করি তথাকথিত দুনিয়াবি সেলিব্রেটিদের পেছনে। এরাই আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়। আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাদের অনুসরণ করি; তাদের লাইফস্টাইল, চালচলন আমাদের মুগ্ধ করে। অথচ না তারা আমাদের চেনে, না আমরা তাদের চিনি। দিনশেষে এই ভালোবাসা হয়ে যায় অন্তঃসারশূন্য। 

যেসব ভাইবোনেরা সেলিব্রেটি-মুগ্ধতায় মত্ত, তাদেরকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘আচ্ছা, কেন আমরা এই ভালোবাসা আল্লাহর রাসূলের জন্য অনুভব করি না?’

জানো, রাসূল ﷺ একবার বলছিলেন, ‘আমার ভাইদেরকে দেখার জন্য খুব ইচ্ছে করে!’

সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি আপনার ভাই নই?’

তিনি ﷺ জবাব দিলেন, ‘তোমরা তো আমার সাহাবি। আমার ভাই হলো তারা, যারা আমার পরে আসবে। আমাকে না দেখেই আমার ওপর ঈমান আনবে।’[1]

দেখলে, দেখলে তাঁর উত্তর? আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাদেরকে তাঁর ভাই বলে সম্বোধন করেছেন! তিনি অনেক কাঁদতেন আমাদের জন্য। এই ভেবে কাঁদতেন যে, আমাদের কী হবে! হ্যাঁ, এই আজকের আমাদের কথা ভেবেই তিনি কাঁদতেন। একদিন দু’দিন না। রাতের পর রাত। আই রিপিট, রাতের পর রাত! এই ভালোবাসা হাল আমলের বস্তাপঁচা ভালোবাসার মতো ঠুনকো নয়। মিছেও নয়। এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য আমরা নই। তবুও পেয়েছি। অনেক পেয়েছি। এই ভালোবাসার হিসেব কি চুকাতে হবে না আমাদের? অবশ্যই চুকাতে হবে!

যাঁকে ভালোবাসি বলে মুখে দাবি করি, তাঁকে আরও বেশি করে জানতে ইচ্ছে করে না? আমি জানি, খুব ইচ্ছে করে। ভালোবাসার মানুষকে তো জানতে ইচ্ছে করবেই। চলো তাহলে, তাঁকে জানি। আর অনেক বেশি ভালোবাসি। তাঁকে যত বেশি জানব, তত বেশি ভালোবাসব। অন্তরে প্রাণহীন অনুভূতি দ্বারা বেদখল হওয়া জায়গাগুলো কানায় কানায় পূর্ণ করব রাসূলের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা। তাঁকে এত ভালোবাসব, যাতে আল্লাহ আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। আর জান্নাতে আমাদেরকে রাসূল ﷺ এর প্রতিবেশি করে দেন!

কল্পনা করো তো, নবিজি ﷺ কে তুমি এত বেশি ভালোবেসেছ যে, শেষ বিচারের দিন তিনি তোমাকে দেখেই উজ্জ্বল একটি হাসি উপহার দিলেন। তারপর তাঁর পবিত্র হাত দিয়ে হাউযে কাউসার থেকে পানি পান করতে দিলেন তোমাকে! তুমি তাঁর সাথে জান্নাতে প্রবেশ করলে! পেছনে ফেলে গেলে দুনিয়ার সকল সেলিব্রিটিকে। আর সেদিন তুমি বুঝতে পারবে, কে ছিল আসল সেলিব্রেটি! তুমি সেদিন দেখবে, দুনিয়ায় যে যাকে ভালোবেসেছিল, আজ শেষ বিচারের দিন, তারা তাদের সাথেই অবস্থান করছে।[2] ঠিক যেমনিভাবে তুমি অবস্থান করছ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে! কারণ, দুনিয়ায় তুমি তাঁকেই ভালোবেসেছিলে।

পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশি!


[1] আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং : ১২৫৭৯

[2] মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং : ৬৪৭০