আহমেদ হোসেন। তার স্ত্রীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। শিউলিতলার নিচেই কবরের জায়গাটা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার স্ত্রীর যে শিউলি ফুল খুব পছন্দ ছিল!

ঠিক এক বছর আগে এই শিউলিতলা থেকে আমার স্ত্রী দুটো ফুল এনে চুলে গুজে দিতে বলেছিল! আমি তখন ভুরু কুঁচকে জবাব দিয়েছিলাম, ‘তোমার কি আহ্লাদের শেষ নেই? এই রৌদ্রফাটা দুপুরে আমি তোমার জন্য ফুল আনতে যাব!’

‘আমার না খুব ইচ্ছে করছিল!’ নিচু স্বরে বলেছিল তমা। কষে এক চড় মেরে আমি বলেছিলাম, ‘নিজের শখ নিজে গিয়ে পূরণ করো! আমার কাছে বেশি আশা করতে এসো না।’

বউটা সেদিন হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তাকে আমি দিনের পর দিন অবহেলা, অপমান করে গেছি! কিন্তু কখনো তাকে মুখে মুখে তর্ক করতে শুনিনি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগও করেনি কোনো দিন। আসলে তমাকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। বিয়ের পর সারাক্ষণ মনে হতো, আমি ওর চেয়ে আরও সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে পারতাম। কী নেই আমার! ধন-সম্পদ, ক্যারিয়ার, স্মার্টনেস, যোগ্যতা! কিন্তু ওর না ছিল রুপচ্ছটা, না ছিল উচ্চশিক্ষা! ওর বাবাও অত বড়লোক ছিল না। শুধু সালাত, সিয়াম, কুরআন আর পর্দা করেই কি কারও যোগ্য হওয়া যায়! যোগ্যতার মাপকাঠি হলো ধবধবে সাদা চামড়া, নয়তো বাপের কাড়িকাড়ি টাকা। এর কোনোটাই তমার ছিল না।

কিন্তু আজ আমার তমার জন্য এত খারাপ লাগছে কেন! মেয়েটার সাথে কখনো ভালো ব্যবহার করিনি। বিয়ের পর থেকেই ওর সাথে খারাপ ব্যাবহার করে গেছি সময়ে-অসময়ে। একদিন আমি আমার কলিগ অহনার সাথে কথা বলি। তমা খুব কষ্ট পেয়েছিল। আমাদের মধ্যে ফ্রেন্ডের মতোই কথা হতো। তমা আমায় বলেছিল যাতে বেশি সময় ধরে আলাপ না করি। কারণ ছাড়া কথা না বাড়াই। এতে আমার গুনাহ হবে। তমাকে সেদিন মুখের ওপর বলেছিলাম, ‘তুমি নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছ, তোমাকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি! তুমি আমার কলিগের মতো সুন্দরী হলে, তার সাথে আমি কথাই বলতাম না!’ তমা একটিবারের জন্যেও বলেনি, ‘বিয়ের আগে আপনি তো আমার সম্পর্কে সবই জানতেন। আমার রূপ, আমার বাবার সম্পত্তি সবই আপনার জানা ছিল। তখন তো বড় গলায় বলেছিলেন—আমার আর কিছুই লাগবে না। তবে এখন কেন এগুলো বলছেন?’

মেয়েটা বড্ড ধৈর্যশীল ছিল। নিয়তি মনে করে মুখবুজে সয়ে নিয়েছিল সবকিছু। শুধু অহনা নয়, অনেক মেয়ে কলিগের সাথে আমার কথা চলত। আমি ওদের সাথে চ্যাট করতাম, আর তমা আমার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ত।

আমার দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে তমা গভীর রাতে উঠে যেত। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করত, সালাত পড়ত চুপিচুপি! একদিন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে তাহাজ্জুদ শেষ করে গুনগুন করে কুরআন পড়ছিল তমা। আমার রাগ উঠে গেল। বিছানা থেকে নেমে কষে দিলাম এক থাপ্পড়। বললাম, ‘তুমি জানো না, লাইট জ্বালালে আমার ঘুম আসে না?’

‘আমার ভুল হলে মাফ করে দেন। আমি তো জানতাম না।’ শান্ত গলায় জবাব দিয়েছিল তমা। 

তারপর থেকে সে আর লাইট জ্বালিয়ে তাহাজ্জুদ পড়েনি। আল্লাহর কাছে দুআ করে গেছে আড়ালে আড়ালে। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরত, কিন্তু মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বেরোত না। আমি তমাকে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করতাম—‘তুমি কি আল্লাহর কাছে শুধু অভিযোগ করো আমাকে নিয়ে? না কি দুআও করো?’ ও মুচকি হেসে বলত, ‘স্বামীর নামে কি কেউ অভিযোগ করতে পারে? যারা সবর করবে, আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে জান্নাত দেবেন। সেদিন তো কোনো ইচ্ছাই আর অপূর্ণ থাকবে না। তখন আপনি আমার থেকে চোখই ফেরাতে পারবেন না। সেদিন আমরা এক দেখায় হাজার বছর পার করে দেব ইনশাআল্লাহ!’

‘তোমার কি লজ্জা বলতে কিছু নেই!’ ধমকের সুরে আমি বলতাম তমাকে। মেয়েটাকে এত অবহেলা করতাম, তবুও সে আমার প্রতি ভালোবাসা দেখাত। কী অদ্ভুত!

আমার এক সন্তান জন্ম দিতে গিয়েই তমা দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। বেচারী কতই-না ধৈর্যশীল ছিল। তার গায়ের রং কেন ধবধবে সাদা নয়, এর জন্যে ওকে কত অপমানই-না করেছি। ওর সামনে ওর বাবা-মা-ভাইকে নিয়ে বাজে কথা বলেছি। কিন্তু ও কিছুই বলেনি। চোখের পানি দিয়ে সব অভিমান ধুয়েমুছে সাফ করে নিত মেয়েটা।

তমার মৃত্যুর পর আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। দ্বিতীয় স্ত্রীর চামড়া ধবধবে সাদা। বলেতে গেলে আমি নিজেই সাদা চামড়া খুঁজে পাত্রী ঠিক করেছি। কিন্তু বিয়ের রাত থেকেই তার কর্কশ গলা শুনতে শুনতে আমি এখন ক্লান্ত।[1] ইচ্ছে করেই এখন বাসায় ফিরি দেরি করে। আমি গিয়ে চুপিচুপি ঘুমিয়ে পড়ি। আমি চাই না, এই মহিলার সাথে আমার কোনো কথা হোক। তার কর্কশ আচরণ আমার জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, মাটি খুঁড়ে তমাকে বের করে নিয়ে আসি। আজ এই শিউলিতলায় দাঁড়িয়ে মেয়েটার কথা মনে পড়ে চোখের জল যেন আর থামছেই না! ওর জন্যে কি আমার হৃদয়ে কোনো জায়গা তৈরি হয়েছিল? আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে—আমি তোমায় মিস করছি, তমা! কিন্তু সে তো আমায় একা করে চলে গেছে আল্লাহর কাছে। বড্ড অভিমান নিয়ে শুয়ে আছে মাটির বিছানায়।


[1] সাদা চামড়া মানে খারাপ আর কালো চামড়ার মানুষ মানে ভালো—গল্পে এই বার্তা দেওয়া হয়নি। ভুল বুঝো না। গায়ের রং যেমনই হোক, দ্বীনদারিতাই যে প্রধান বিবেচ্য, এই গল্পে সেই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।—সম্পাদক