শৈশব-কৈশোরের বেশির ভাগ সময়ই গ্রামে কেটেছে। তখন দিনের বেলায় স্কুল ছিল, বিকালে খেলাধুলা ছিল, সন্ধ্যায় স্কুলের হোমওয়ার্ক ছিল। ছুটির দিন তো সকালের নাস্তা করেই দ্রুত খেলতে চলে যেতাম। আবার স্কুলের টিফিন ব্রেকে খেলতাম, কখনো ক্লাস শুরুর আগেও। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ছিল প্রফেশনাল খেলাগুলোর মধ্যে৷ আমি ক্রিকেটটা ভালো পারতাম অন্যগুলোর তুলনায়। রৌল ছিল বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। লেফটিদের আলাদা কদর আছে গ্রামে। এছাড়া আরেকটু শৈশবে খেলতাম গ্রামীণ খেলাগুলো। যেমন: গোল্লাছুট, ফুল টোক্কা, বরফ-পানি, লুকোচুরি ইত্যাদি। 

বৃষ্টির দিনগুলোতে আম্মুর সাথে প্রায়ই মনোমালিন্য হতো। কারণ, আম্মু আমাকে ভিজতে দিত না—আমার ঠান্ডা লেগে যাবে, এই ভয়ে। যখনই ভেজার সুযোগ পেতাম, মনে হতো যেন আমার রাজ্যে আমিই রাজা। আমার চেয়ে সুখী আর কে আছে? শৈশব-কৈশোরে যে খুব বেশি দূরন্ত ছিলাম, তা না। কিন্তু তবুও এইটুকু তো একদমই সাধারণ ছিল আমাদের প্রজন্মে। কিন্তু কী হয়ে গেল বর্তমান প্রজন্মের?

প্রিয় ভাইয়া/আপু, তোমরা কি দেখতে পাও সমাজটা কোথায় চলে গিয়েছে? চলো, একটু ঘুরে আসি অন্ধকার জগৎ থেকে। এই “অন্ধকার জগৎ” কোনো রূপকথার গল্পের না; বরং তোমরা যে সমাজে বসবাস করছো, সেই সমাজেরই। কথাগুলো তোমাদের প্রজন্মেরই।

[১]

আমার পরিচিত এক ভাইয়ের বন্ধুর ঘটনা। ভালো ছাত্র ছিল ছেলেটা। এইচএসসিতে গোল্ডেন এ+ পেয়েছিল। কিন্তু কোনো এক কারণে ভার্সিটিতে চান্স পায়নি। খুব হতাশ হয়ে পড়ল সে। তার হতাশা আরও বেড়ে গেল, যখন দেখতে পেল তার আশেপাশের বন্ধু-বান্ধব সবাই চান্স পেয়েছে। যখন সে হতাশার চরমে, এমন সময়ে তার গার্লফ্রেন্ডও ব্রেকআপ করে ফেলল তার সাথে। ছেলেটা এতকিছু সহ্য করতে না পেরে অবশেষে আত্মহত্যা করল।

[২]

আমার এক বন্ধুর বড় ভাই। আমার চেয়ে এক ব্যাচ সিনিয়র। ভালো মিশুক মানুষ ছিলেন, নিয়মিত খেলাধুলা করতেন, আমার সাথে দেখা হলেই স্নেহ করতেন। ফুটবল খেলায় দারুণ গোলকিপার ছিলেন তিনি। একসময় জীবিকার তাগিদে প্রবাসে চলে যান। সেখান থেকে অনলাইনে তার সাথে পরিচয় হয় এক মেয়ের। পরবর্তীতে সেই মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই মেয়ের জন্য নিজের কষ্টার্জিত টাকার একটা বড় অংশ খরচ করতেন। একসময় সেই মেয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে মনোমালিন্য হয় তার৷ এক পর্যায়ে মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলা অবস্থায়, ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।

[৩]

২০২০ সালের ঘটনা। ৩য় শ্রেণিতে পড়ুয়া আপন মিয়া বাবার কাছে বায়না ধরল, মোবাইল কিনে দিতে হবে। বাবা বলেলেন, ‘কিনে দিব, তবে কিছুদিন অপেক্ষা করো’। বাবা অটোরিকশা চালান। ছেলেকে মোবাইল কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তবুও ছেলের আবদার রাখার জন্য প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু বাবার এই আবদার পূরণে দেরি হতে দেখে অভিমান করে ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে এগারো বছর বয়সী আপন[1]।

[৪]

আরেকটি ঘটনার দিকে তাকানো যাক। ঘটনাটি ২০২২ সালের। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তখন এটা নিয়ে নিউজ হয়েছিল। ইভটিজিং-এ বাধা দেওয়ায় এবং শাসন করার জন্য শিক্ষককে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু। সে চেয়েছিল এভাবে শিক্ষককে পিটিয়ে প্রেমিকার সামনে হিরো সাজতে।[2]

[৫]

নেত্রকোনার রাকিবের ঘটনা তো বলাই হলো না। ২০ বছর বয়সী রাকিব প্রচণ্ড রকমের ফ্রি-ফায়ার গেইমে আসক্ত ছিল৷ পড়াশোনা, খেলাধুলা, নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে থাকত। এভাবে চলতে চলতে একসময় তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। একদিন তার পাগলামির প্রভাব ছড়িয়ে যায় রাস্তাঘাটেও। রাস্তায় চলমান ২০টি গাড়ি নিজ হাতে লাঠি দিয়ে ভাঙচুর করে সে। পরে পুলিশ এসে তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। [3]

[৬]

পড়াশোনার জন্য শহরে আসি, চারপাশে তাকাই। আমি দেখি আবাসিক হোটেল, পার্ক, স্কুল-কলেজ, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, ব্যাচেলর বাসা আর লিটনের ফ্ল্যাটে রমরমা অশ্লীলতা আর যিনা-ব্যভিচারের আড্ডাখানা। এদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী। দেখতে পাই, এখনো দাড়ি-গোঁফ গজায়নি, এমন ছেলের কাছ থেকেও ভেসে আসছে নিকোটিনের কালো ধোঁয়া। এখনো বয়ঃসন্ধিকালে পা রাখেনি, এমন ছেলে পর্যন্ত কিশোর গ্যাং-এ যুক্ত হয়ে দেয় অস্ত্রের মহড়া।

শহরের জঞ্জাল পেরিয়ে গ্রামে যাই, চারপাশে তাকাই। আমি দেখি লঞ্চের কেবিন, খালি বাড়ি, বাগান, ঝোঁপঝাড় এবং কোচিং সেন্টারের ছাদে অহরহ অশ্লীলতা আর যিনা-ব্যভিচারের কাহিনি। শুনতে পাই ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়ের পালিয়ে বিয়ে করার ঘটনা, আর ১৩ বছরের অবিবাহিত মেয়ের গর্ভধারণের ঘটনা। দেখতে পাই, পিচ্চিগুলো মোবাইল সামনে না দিলে এক মিনিটও খাবার খেতে পারে না।

[৭]

পুরো একটা প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে বিষণ্ণতা আর হতাশায়। এক জরিপে দেখা গিয়েছে, তারুণ্যের ৬১ শতাংশ বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। ২০২৩ সালে দেশে মোট ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এদের বেশিরভাগই স্কুলপড়ুয়া। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এদের বেশির ভাগ কারণ খুঁজতে গিয়েই প্রেমঘটিত বিষয় উঠে এসেছে।[4]

[৮]

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের অভিভাবকরা এই নষ্ট আধুনিক দুনিয়াটা সম্পর্কে জানেন না। যদি জানতেন যে, তাদের সন্তান ফোনে অশ্লীল ভিডিও দেখে রাত পার করছে, কাজিনের সাথে বা বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ডের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, আবার সেসব ছবি/ভিডিও করে রাখা হচ্ছে, ইনবক্সে অশ্লীল ছবি-ভিডিও আদান-প্রদান করছে, পরে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছে, কারও কারও ছবি/ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, তাদের কি গা শিউরে উঠত না? নিজের অজান্তেই তাদের চোখ বেয়ে পানি গড়াত না? হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যেত না? দুঃখ-কষ্টে মারা যেতে ইচ্ছে করত না?

[৯ ]

আজকাল মাদকাসক্তি, যিনা-ব্যভিচার, আত্মহত্যা, টিকটক, অশ্লীল ভিডিও আসক্তি, অনলাইন গেইমসের প্রতি আসক্তি ছাড়া কিচ্ছু দেখা যায় না আশেপাশে। এদিকে বাসায় বসে খেয়ে আর স্মার্টফোনে ডুবে থেকে বাচ্চারা হয়ে যাচ্ছে গাট্টুস-গুট্টুস। নেই খেলার মাঠ, নেই ক্লাব, নেই পারিবারিক কিংবা বন্ধুমহলের আড্ডা, নেই গা ছমছম করা ভূতের গল্পের আসর। বাবা-মায়েরা সন্তানদের বুঝেন না। জেনারেশন গ্যাপের কারণে জানতে পারছেন না, তাদের সন্তান কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রিয় ভাইয়া/আপু, তোমার কি এসব দেখে কষ্ট হয় না? মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না এই নষ্ট সমাজ থেকে? বিশুদ্ধ বাতাসে বাঁচার ইচ্ছে হয় না নিজের? বাঁচাতে ইচ্ছে করে না ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা তোমার অনাগত সন্তানদের? না-কি ওই আপনের মতো হারিয়ে ফেলতে চাও তোমার আদরের ছোট ভাইটাকে?

[১০]

তুমি এখন কী করতে পারো?

দেখো, এসব সমস্যার পেছনে অনেক কারণ আছে। যেমন, সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা, ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা, মিডিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমদানি ইত্যাদি। এসবের পেছনে আরেকটা অন্যতম কারণ হলো আমাদের বাবা-মায়েরা সচেতন না, সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে সচেতন না, আর যারা এসব সমস্যার সম্মুখীন তারা নিজেরাও সেভাবে ভাবছে না এগুলো নিয়ে। এখন তুমি কী করতে পারো? তুমি অবশ্যই এখানটায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারো।

তুমি অভিভাবকদের কাছে গিয়ে তাদেরকে সচেতন করতে পারো। সমাজের মানুষের কাছে গিয়ে গিয়ে বোঝাতে পারো। তারা সচেতন হলে তাদের সন্তানরাও বাঁচতে পারবে। তোমার বন্ধুদের মধ্যে যারা বিভিন্ন আসক্তিতে আছে, হতাশায় আছে অথবা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাদের নিয়ে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করো। তাদের সাথে আড্ডা দাও, তাদের সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো, দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করো, তারা যে ভুলের মধ্যে আছে সেটা একান্ত কল্যাণকামী হয়ে বোঝাও। যারা তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দাও। উপকারী বইপত্র, ভিডিও শেয়ার করো। সাহস দাও ফিরে আসার, আশ্বাস দাও নির্মল পৃথিবীর সুঘ্রাণ নিতে পারার।

তুমি হয়তো বলবে, ভাইয়া আমি একা একা কীভাবে করব এসব? না, তোমাকে একা করতে হবে না। তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে একটা ক্লাব বা কমিউনিটি খুলতে পারো। সেই ক্লাবের মাধ্যমে তোমরা একসাথে খেলবে, আড্ডা দেবে, বিভিন্ন আসক্তির বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করবে, পোস্টার লাগাবে, সভা-সেমিনার আয়োজন করবে। এই কাজগুলো কীভাবে করবে তা সামনের লেখাগুলোতে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

তোমরা যখন এই কাজগুলো করবে, দেখবে তোমাদের চারপাশের মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে, অভিভাবকরা সচেতন হচ্ছে, কিশোর-তরুণরা ফিরে আসতে পারছে তাদের অন্ধকার জীবন থেকে। অর্থাৎ তুমি তোমার চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছো। এটাই হলো সামাজিক শক্তির একটা ধরন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]

***

[1] মোবাইল কিনে না দেয়ায় অভিমানে স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা, ২০ জানুয়ারি ২০২০, যুগান্তর। https://tinyurl.com/2pzjbsc9
[2] প্রেমিকার কাছে হিরো সাজতে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্র জিতু, বঙ্গবাণী, জুন ৩০, ২০২২ - tinyurl.com/5n6vshwe
[3] ফ্রি-ফায়ার গেম খেলে মানসিক সমস্যা, যে কাণ্ড ঘটালেন যুবক, আরটিভি নিউজ, ০৪ অক্টোবর ২০২৩ - https://tinyurl.com/yck7fnxn
[4] তারুণ্যের ৬১ শতাংশই ভুগছে বিষণ্ণতায়, newsbangla24.com, জুলাই ১০, ২০২১ - tinyurl.com/umn7rw8x
মাসে গড়ে ৪৫ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, প্রেমঘটিত কারণে বেশি, আরটিভি নিউজ, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২২ - tinyurl.com/2282v97w