আমাদের মাঝিবা ও নাট্টা (নর্তক) জুবাইর!
আজকের ঘটনাটি ২০-২৫ বছর আগের। তখন রোহিঙ্গা কালচারের সাথে দ্বীপের কালচার ৯০% মিল ছিল।
এখানে নামন্ত বিয়ে প্রচলিত। বিয়ের অনেকদিন আগে থেকেই বরের বাড়িতে নাচগান ও হঁলার আসর বসত। অল্লারদোয়ার (বাড়ির পেছনে) মহিলারা অস্থায়ী দোলনায় দোলে দোলে হঁলা, তরুণীরা বাজা (মাউথ অরগান/হারমনিকা) বাজিয়ে নাচত। আর পাড়ার ছেলেদের বিশেষ করে তরুণদের অনুষ্ঠান হতো রাতে। উঠোনে তেরপল বা তলই (বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি বিছানি বিশেষ) বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে আসর জমাত। সম্ভ্রান্ত বা পয়সাওয়ালারা দলিওয়ালা (নাচ-গানের দল) নিয়ে আসত। আর গরিবের ভরসা পাড়ার যুবক! তারাই সব দায়িত্ব নিয়ে নিত। একজন মেন্ডুলিন বা বেহালা অথবা হারমোনিয়াম বাজাত। উনি দলি দলের প্রধান। একজন মঞ্জুরি বা ভঞ্জুরি (মন্দিরা বা করতাল) বাদক, একজন ঢোলবাদক, একজন নাচনী থাকত।
নামন্ত বিয়েতে বরহীন বৈরাত যাত্রা হয়। সন্ধার আগেই বৌ বরের ঘরে নিয়ে আসা হয়। এ-দিন নেকাহ হয় না। জাঁকজমকপূর্ণ এক নাচ-গানের আসর হয়। পরের দিন মেলা (প্রীতিভোজ) শেষে রাতে বিয়ে পড়ানো হয়।
২০-২৫ বছর আগে। কোণাপাড়ায় আমার দূরসম্পর্কের এক মামার বিয়ে। সম্ভ্রান্ত পারিবার। তাই অনুষ্ঠানটা একটু ব্যতিক্রমী করার সিদ্ধান্ত হয়। আকিয়াবের নাট্টা (নর্তক) জুবাইরকে আনা হয়! বৈরাতী রাতে নাচতে। কারণ, তার কোমর দোলে নাচার ব্যপক সুনাম ছিল! প্রচলিত আছে, আকিয়াবের এক মৌলভির ছেলে জুবাইর সার্জারী করে শরীর পরিবর্তন করেছিল। এখনকার সময়ে যাকে রূপান্তরিত নারী বা ট্রান্সজেন্ডার[1] বলি!
বাপ জুবাইরকে অভিশাপ দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। সে আকিয়াব থেকে টেকনাফ নাজিরপাড়া চলে আসে। তার শরীরের গঠন এমন হয়েছে যে, একটা নারীর সাথে তার কোনো পার্থক্য দেখা যেত না! চমৎকার নাচতে পারত। উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক, লম্বা লম্বা চুল… মেয়েদের সাজপোশাক তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিল!
তাকে আনা নিয়ে দ্বীপে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তখনকার সমাজ কমিটি ও মুরব্বিরা এর বিরোধিতা করেন। মৌলভির ছেলে, মেয়ে সাজার কারণে আলিম সমাজও এর তীব্র বিরোধিতা করছেন।
যদিও বিয়েতে নাচ-গানের আসর করা দ্বীপ-সংস্কৃতির অংশ। এটা একটা সমাজ স্বীকৃত ও বিয়ের আনুষাঙ্গিক বিষয়।[2] কিন্তু নাট্টা জুবাইরের কারণে বিষয়টি দ্বীপ-সংস্কৃতি ও নিয়মের বাইরে চলে গেছে।
পাড়ার সমস্ত যুবক ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফাংশন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যেভাবেই হোক জুবাইরের নাচ দেখবে! প্রয়োজনে প্রতিরোধ করবে!
পুরো দ্বীপে থমথমে অবস্থা। বড় গণ্ডগোল হবে আশংকায় সেদিন সবাই আগেভাগে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে! ইশার নামাজের পর মাঝিবা যাবেন এমন গুঞ্জন চলছে। পুলিশ রাস্তায় সশস্ত্র টহল শুরু করেছে।
বিয়েতে মাইক বাজানোর অনুমতি ছিল। সমাজকমিটি বিয়ের জন্য মাইক বাজানো ও স্থানীয়ভাবে ছোট পরিসরে গানের আসর করার অনুমতি দিয়েছে। পাড়ার যুবকদের সিদ্ধান্ত হলো, প্রথমে ঘরোয়া আসর হবে। রাত গভীর হলে নর্তক জুবাইর নাচবে। আর তখন মাইক বন্ধ থাকবে।
আসর শুরু হলে, প্রথমে মাদরাসার ছাত্রদের সাথে যুবসমাজের তর্কাতর্কি হয়। পরে তারা মাঝিবাকে নালিশ করেন এবং গিয়ে দেখে আসার অনুরোধ করেন।
রাত ৯-১০ টা হবে। মাঝিবা গেলেন। সাথে আরেক কিংবদন্তি মৌলানা এজাহার। মৌলভি এজাহার হচ্ছেন যাদের বাড়িতে আসর হচ্ছে তাদের পারিবারিক মুরব্বি ও দ্বীপের বয়োজ্যেষ্ঠ আলিম। মাঝিবাদের দেখে পুরো এলাকা এক মিনিটে ফাঁকা হয়ে যায়। কারণ, কেউ মাঝিবার সামনে এসে তর্ক করতে চাইত না। সম্মান করত। উনার সামনে বেয়াদবি করতে কেউ সাহস করত না।
যুবসমাজ নাট্টা জুবাইরকে লুকিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে দক্ষিণপাড়া জঙ্গলে নিয়ে আসর বসায়। টাকা দিয়ে ভাড়ায় আনা দলি দলকে বিনা আসরে ফেরত দিতে যুবকরা চায়নি। কিন্তু কীভাবে যেন সমাজকমিটি জেনে যায়। তাদের ধাওয়া করে। জঙ্গল থেকে জুবাইরকে বের করে নিয়ে আসে। সকালে মসজিদের মাঠে সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত মতে মাথা নেড়া করে নর্তক জুবাইরকে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়।
এখন যুগ পালটে গেছে। ঘরে ঘরে বড় বড় সাউন্ড বক্স। আরামে ঘুমাতে পারি না। পর্যটন সিজনে প্রতি রিসোর্টে বড় বড় স্পিকার বাজে। পাশে কেউ অসুস্থ হলো কিনা, বয়স্ক মানুষ আছে কিনা, শিশুদের সমস্যা হচ্ছে কিনা, মানুষ ঘুমাচ্ছে কিনা, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই! এখন প্রতিদিন সাইন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে নাচের আসর হচ্ছে। কান-নাক ছেদন করলে পার্টি, মেয়ে বালেগ হলেই পার্টি, ছেলের খৎনা হলে পার্টি, বিয়ের পার্টি, বিয়ের আলোচনার পার্টি, জন্মদিন হলে পার্টি, প্রেমে পড়লে পার্টি! আর সব পার্টিতে সাউন্ড বক্সের শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয়। গান কিন্তু একটাই 'আরে লে ফটো লে ফটো লে...!’
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
[1] ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া এক নয়। হিজড়ারা জন্মগতভাবেই শারীরিক ত্রুটিসম্পন্ন। অন্যদিকে ট্রান্সজেন্ডাররা সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। এরা সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী থেকে পুরুষ বা পুরুষ থেকে নারী হবার দাবি করে। অনেকেই সার্জারি করে না। শুধু পোশাক-আশাক বদলেই ছেলেরা নিজেদের মেয়ে দাবি করে বা মেয়েরা নিজেদের ছেলে দাবি করে। এরা বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন। পরিবার, সমাজ ও সভ্যতার জন্য এরা ভয়ংকর ক্ষতিকর ভাইরাসের মতো। —সম্পাদক
[2] বিয়েতে ইসলামী শরীয়তের মধ্যে থেকে, অপচয় না করে, নারী-পুরুষের ফ্রি মিক্সিং না করে এবং দফ ছাড়া অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র না বাজিয়ে আনন্দ করার অনুমতি রয়েছে। —সম্পাদক
[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]