সেলফি[1] তোলার সময় বিভিন্ন ইফেক্ট বা ফ্রেম দিয়ে অনেকেই ছবি তোলে, খেয়াল করেছ না? বিড়ালের ফ্রেম, বড় চশমার ফ্রেম, মজার মজার বিভিন্ন ফ্রেইম… মানুষের চেহারাই পুরো পালটে যায়। দেখা গেল, মাথা বিশাল বড়, শরীর অনেক ছোট বা বিড়ালের মতো ইয়া বড় বড় কান বা দাড়ি-গোঁফ। এই চেহারা কি আসলে তোমার?
তুমি এমন না। কিন্তু সেলফি ক্যামেরার ইফেক্ট তোমার চেহারাকে বদলে ফেলেছে। তোমার তুমিটাকে পরিবর্তন করে এক অন্য তুমিতে রূপান্তর করেছে।
সেলফি ক্যামেরা যেমন বাস্তবতাকে বদলে দিয়েছে, তুমি যখন টেনশন করো তখন তোমার এই টেনশন তোমার সামনে বাস্তবতাকে বদলে দেয়। অন্য রূপে হাজির করে। তুমি তোমার এই মাথা, বিশাল বড় শরীর, অনেক ছোট চেহারাকেই নিজের প্রকৃত শরীর বলে মেনে নাও। ভয় পাও। এ কী হয়ে গেল আমার, আমি শেষ হয়ে গেলাম—এমন ধ্বংসাত্মক চিন্তাভাবনা করো। এবং পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে ফেলো। আরও ধ্বংসাত্মক চিন্তা করো।
আমরা এখন ধারাবাহিকভাবে চিন্তার এমন ৬টি ফাঁদ নিয়ে আলোচনা করব। মুখচোরা, সোশ্যাল এংজিটি আছে এমন মানুষেরা সাধারণত না বুঝে চিন্তার এই ৬টি ফাঁদের কোনো একটিতে পা দেয়। এবং অন্যদের সামনে সহজভাবে কথা বলতে পারে না। এই ফাঁদগুলো চিনতে পারলে তুমি অন্য মানুষদের সামনে কথা বলতে ভয় পাবে না, অস্বস্তি বোধ করবে না, ইনশাআল্লাহ।
১/ ধ্বংসাত্মক চিন্তাভাবনা (Catastrophic Thinking)
কোনো কাজ করতে যাবার আগে সবার প্রথমে তোমার মাথায় এই চিন্তা আসে বা তুমি এই প্রশ্ন করে বসো—এই কাজের ফলে সবচেয়ে খারাপ কী কী হতে পারে? এরপর তুমি সেই কাজটা শুরু করলা। তুমি যেমন প্রত্যাশা করেছিলা হুবহু সেভাবে কোনো কিছু না হয়ে একটু ভিন্নভাবে কিছু হলো। ব্যাস, তুমি টেনশন শুরু করে দিবা। আর ধরেই নিবা, সবচেয়ে খারাপ পরিণতি বরণ করতে চলেছ তুমি। অথচ আরও অনেক কিছু হতে পারত। কিন্তু তুমি ভাববে সবচেয়ে খারাপটাই। এটাই হলো ধ্বংসাত্মক চিন্তা।
ধরো, শহীদ তিতুমীর স্কুলে ভ্যালেন্টাইনের অশ্লীলতা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য এলাকার তরুণ আসাদ লিফলেট বিতরণ, পোস্টার সাটানো, রম্য মিছিল করতে চাচ্ছে। তাই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সে গিয়েছে হেডস্যারের কাছে অনুমতি নিতে। হেডস্যার গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের পরিচয় কী? তোমরা আসলে কী চাও? প্রশ্ন আর গম্ভীর মুখ দেখেই ঘাবড়ে গেল আসাদ। সাথে সাথে তার মাথায় চিন্তা আসলো—হেডস্যার বোধহয় ভাবছেন আমরা কোনো বিশেষ দলের সদস্য। নাহলে মুখ এত গম্ভীর কেন? আমরা এলাকারই ছেলে। আমাদের না চেনার কী আছে। আমাদের পরিচয় কেন জানতে চাইলেন আবার? এবার বোধহয় আমাদের সবাইকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন।
অথচ ঘটনা এসবের কিছুই নয়। হেডস্যারের বয়স হয়েছে। একটা মাইল্ড স্ট্রোক করেছেন। অনেককেই এখন আর চিনতে পারেন না। শরীর খারাপ থাকায় মেজাজটাও তার ভালো থাকে না। তাই মুখ এমন গম্ভীর। স্যার শুধু আসাদদের নাম জানতে চেয়েছেন। আর ভালোভাবে বুঝতে চেয়েছেন, ওরা কী কী করতে চায়। তাহলে সেভাবে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে দেবেন। কিন্তু মুখচোরা আসাদ শুরুতেই ধরে নিয়েছে সবচেয়ে খারাপটা। এরপর ভোগা শুরু করেছে ব্যাপক টেনশনে এবং তোতলাতে শুরু করেছে।
বাড়ির কাজ - ১
ক) খাতা-কলম নিয়ে এমন একটি ঘটনার কথা বিস্তারিত লিখো, যখন তুমি ধ্বংসাত্মক চিন্তাভাবনা করছিলা।
খ) সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে? তুমি কী ভেবেছিলা তা লিখো।
২/ নিজের সামর্থ্য বা সফলতাকে গোনায় না ধরা
যখন তুমি ভালো কিছু অর্জন করে ফেলো, তখন মনে করো—আরে ঝড়ে বক পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’ টাইপের অবস্থা। আমার কোনো যোগ্যতা নাই। বা ধরো, কেউ তোমার কোনো কাজের অনেক প্রশংসা করল, তুমি ভেবে নিলা—তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে চায় সে। তাই এত প্রশংসা করেছে। মানে, সে যা যা বলেছে সেগুলো আসলে সত্যি না।
বা ধরো, মুখচোরা লাজুক হিসেবে তোমার সবিশেষ খ্যাতি থাকলেও কোনো কোনো সময় কোনো কোনো টপিক নিয়ে তুমি অনেক কথা বলে ফেলতে পারো। তোমার এই সফলতা থেকে তোমার উচিত ছিল বাকি সবার সাথে সব পরিস্থিতিতে মুখচোরা না হয়ে কথা বলার অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে এটা ভাবা—আরে, আমিও পারি মানুষের সাথে মিশতে, কথা বলতে। কিন্তু তুমি তা না করে চিন্তা করলা—আসলে এখানে আমার কোনো ক্রেডিট নেই। সেই মানুষগুলো অনেক ভালো। আমাকে পছন্দ করে। আমার জন্য পরিস্থিতি সহজ করে দিয়েছে। তাই আমি এত কথা বলতে পেরেছি।
এভাবে যদি বারবার তুমি তোমার সফলতাকে, তোমার গুণ, ইতিবাচক বিষয়, তোমার অর্জনকে ছোট করতে থাকো, তাহলে আত্মবিশ্বাসহীন, নার্ভাস, মুখচোরা, লাজুক স্বভাব থেকে বের হয়ে আসাটা ভয়ঙ্কর রকমের কষ্ট হবে তোমার জন্য।
কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কুরআন তিলাওয়াতের দায়িত্ব পাওয়া নার্ভাস কিশোর রবিনের চিন্তাভাবনা দেখো। তার কুরআন তিলাওয়াত খুবই চমৎকার। কিন্তু…
রবিন : আজকে সবার সামনে আমাকে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে, কয়বার যে আমি আটকে যাব! সবাই জেনে যাবে, আমার গলা একদম বেসুরো!
অনুষ্ঠানের পর ইসলাম শিক্ষা স্যার : রবিন, মাশাআল্লাহ তোমার তিলাওয়াত খুবই ভালো ছিল।
রবিন : (মনে মনে) স্যার বোধহয় আমাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করছেন, আমি খারাপ করেছি এটা বুঝতে দিতে চাচ্ছেন না।
বাড়ির কাজ ২
ক) কেউ তোমার কাজের প্রশংসা করেছে, আর তুমি ভেবেছে তুমি এই প্রশংসার যোগ্য না—এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখো।
খ) কেন তুমি নিজেকে যোগ্য মনে করোনি, তা লিখো।
ক্লাস টেনের নাহিদের আজ দায়িত্ব পড়েছে ক্লাসে হাজী শরীয়তউল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করা। সে আলোচনা করছে। আলোচনা খুব ভালো হচ্ছে। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আলী হঠাৎ আবিষ্কার করল, দেয়ালে বিশাল একটা টিকটিকি বসে আছে। চোখ টিকটিকির দিকে রাখলেও তার কান নাহিদের লেকচারের দিকে। হঠাৎ গালিব ওমরকে বলল, ‘দেখ, দেখ, বাইরের আম গাছটাতে কী সুন্দর আম। দুজন মিলে মাঝে মাঝে আমগাছের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু পুরোটা সময় নাহিদের লেকচার শুনছে। কবি তানযিল ক্লাসে লুকিয়ে আনা স্মার্টফোনে সার্চ করে হাজী শরীয়তউল্লাহর ছবি দেখছে। আর মুগ্ধ হয়ে নাহিদের কথা শুনছে।
অথচ নাহিদ ভাবছে আমার প্রেজেন্টেশনে সবাই বিরক্ত হয়ে গেছে। কেউ আমার কথা শুনছে না। ঐ যে—
১/ আলী দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।
২/ গালিব আর ওমর মিয়া জানালা দিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছে।
৩/ কবি তানযিল লুকিয়ে ফোন চাপছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে সে আমার কথা শুনছে না।
যারা সবকিছুতে শুধু ইতিবাচক জিনিস খুঁজে পায়, তাদের চোখে নাকি থাকে রঙ্গিন চশমা। অন্যদিকে সোশ্যাল এংজিটিতে ভোগা মুখচোরা লাজুক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের চোখে থাকে ধূসর রংহীন চশমা। সে সবকিছু দেখে। কিন্তু শুধু খারাপ, শুধু নেতিবাচক বিষয়গুলোকেই সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে। ইতিবাচক বিষয়গুলোকে সে গোনায় ধরে না। তুমিও কি নাহিদের মতো এমন করো? দৃষ্টিভঙ্গী বদলাও মিয়া, জীবন বদলে যাবে!
বাড়ির কাজ ৩
ক) এমন একটি ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখো, যখন তুমি সব ইতিবাচক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করেছ।
খ) কেন ইতিবাচক বিষয়গুলো উপেক্ষা করেছিলা তাও লিখো।
আজ এ পর্যন্তই থাক। সামনের সংখ্যাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে পরের ফাঁদগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। এর আগের পর্বেও বেশ কিছু বাড়ির কাজ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোসহ এই পর্বে দেওয়া কাজগুলো একটা আলাদা খাতায় সুন্দর করে লিখে ফেলো। এই খাতায় আর অন্য কিছু লিখবে না। পরের পর্বগুলোতেও আরও বেশি করে বাড়ির কাজ দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। এগুলো করলে মুখচোরা স্বভাব কাটিয়ে উঠবে তুমি। মানুষের সামনে কথা বলতে গিয়ে আর নার্ভাস, ভয় লাগবে না তোমার। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে না।
অতীত অভিজ্ঞতা বলে, তোমাদের অধিকাংশই বাড়ির কাজ করবে না। এবং সরি টু সে, এ কারণে মুখচোরা স্বভাব পরিবর্তনের কতদূর কী করতে পারবা, তাও বুঝতে পারছি না!
(চলবে ইনশাআল্লাহ…)
[1] প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব