পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে, অরবান নামে এক ইঞ্জিনিয়ার অনেকদিন ধরে কামান বানানোর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল। কিন্তু তার আইডিয়াগুলোকে বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক অর্থের প্রয়োজন। দরকার অনেক লোকবল আর জিনিসপত্র।
১৪৫২ সালে হাঙ্গেরিয়ান এই ইঞ্জিনিয়ার গেল বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টান্টিন-১১ এর কাছে। ইংরেজি আর ল্যাটিন মিলিয়ে Constantine XI লিখলে বেশ গুরুগম্ভীর লাগে অথচ বাংলায় অমুক ৬ বা তমুক ১১ লিখলে কেমন অদ্ভুত লাগে, তাই না! যাই হোক, আমরা মূল গল্পে ফেরত আসি। অরবান গেল ১১ নম্বর কনস্টান্টিনের কাছে। বিশাল ও শক্তিশালী কামান বানানোর মেগা প্রজেক্টের আইডিয়া তার সামনে 'পিচ' করল। অরবানের দাবিদাওয়া শুনে কনস্টান্টিন এই প্রজেক্টে ফান্ডিং করতে অস্বীকৃতি জানালো।
মনোবল না হারিয়ে অরবান এবার গেল উসমানী সুলতান মেহমেত-এর কাছে। অরবানের আইডিয়া শুনে তিনি দেখলেন এটা হাই রিস্ক - হাই রিওয়ার্ড প্রজেক্ট। অনেক টাকাপয়সা, সময় আর শ্রমের লোকসান যেমন হতে পারে, তেমনি কার্যকর হলে কোনো দেওয়ালই তার কনস্টান্টিনোপল দখলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি অরবানের প্রজেক্টে ইনভেস্ট করলেন। এরপর বাকিটা ইতিহাস। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল জয় করে মেহমেত হন ফাতিহ আর কনস্টান্টিনোপল হলো ইস্তাম্বুল।
এই গল্পটা বলার কারণ হলো, যুগে যুগে যেভাবে ইনোভেশন হয়ে আসছে, সেটার সাথে বর্তমানের একটা সংযোগ করে দেওয়া।
আইডিয়া 'পিচ' করা কিংবা ফান্ডরেইজ করা—এই শব্দগুলো এই যুগে আমরা টেকনোলোজি স্টার্টআপ-এর ক্ষেত্রে শুনে থাকি। সময়ের সাথে সাথে আইডিয়া এবং ফান্ডিং এর ধরন পালটেছে; কিন্তু মূল বিষয়গুলো একই আছে।
একটি উচ্চাভিলাষী আইডিয়া, একজন উদ্যমী উদ্যোক্তা আর পর্যাপ্ত সহায়তা ইতিহাসের গতিপথ বদলেছে বারবার, বদলাচ্ছে এখনো।
আমাদের সময়েও কেউ গ্যারেজে বসে কিংবা ভার্সিটির হল থেকে একটি আইডিয়াকে অক্লান্তভাবে বাস্তবে পরিণত করে গড়ে তুলেছে এমাজন, ফেসবুকের মতো আধুনিক যুগকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্রতিষ্ঠান।
এটা সত্য যে, সব আইডিয়ার সমান পরিণতি হয় না। আসলে, খুব অল্প সংখ্যক উদ্যোগই এমন সফলতা দেখে। কিন্তু পরিসংখ্যান ছাপিয়েও বাস্তবতা হলো, উদ্যোগ নেওয়ার উদ্যমটাই এমন একটা দরজা, যা যুগে যুগে ধনী-গরিব, শক্তিশালী-দুর্বল সবার জন্য খোলা ছিল এবং আছে। জালুতের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মনোবল সবার ছিল না। দাউদের মতো গুটিকয়েক ব্যক্তিই এগিয়ে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। আলাইহিস সালাম।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে একটি আইডিয়া কিংবা উদ্যোগের মাধ্যমে ইতিহাসের গতিপথ পালটে দেওয়ার সুপারপাওয়ার এখন সবার হাতের নাগালে। সফটওয়্যার এবং মিডিয়া হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর মানুষের জন্য এমন দুটি সুপারপাওয়ার।
তোমার তৈরি করা ছোট্ট একটি প্রোগ্রাম বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে ব্যবহৃত হতে পারে বারবার। তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তোমার সফটওয়্যার সাবস্ক্রিপশান থেকে আয় করতে পারো অনায়াসে।
তোমার লেখা একটি ব্লগপোস্ট কিংবা ভিডিও মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে তোমার মৃত্যুর পরেও। হ্যাঁ, পাল্টা যুক্তি দেওয়া যায় যে, বই লিখে তো আগেও এই কাজ করা যেত। সত্য। কিন্তু বই লেখার ও ছাপানোর সুযোগ কতজনের কাছে ছিল? আর এখন একটি গল্প লিখে সারা দুনিয়ার সাথে শেয়ার করার মতো ইন্টারনেট সংযোগযুক্ত মোবাইল কতজনের কাছে আছে?
Code এবং Media কে তাই বলা হয় permissionless leverage। কথাটার বাংলা করা কঠিন, তারচেয়ে বরং ব্যাখ্যা করি। তোমরা হয়তো সমাজ বইতে পড়েছ, ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে পুঁজি, শ্রম, উদ্যোক্তা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা।
ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করে যেকেউ উদ্যোক্তা হতে পারে। কিন্তু পুঁজি এবং শ্রম সবার কাছে সমানভাবে নেই। তাই অরবানকে যেতে হয়েছে এক সম্রাট থেকে আরেক সম্রাটের দরবারে। শ্রম বলতে এখানে জনবল বুঝানো হচ্ছে। একটা ফ্যাক্টরিতে পণ্য উৎপাদনে মানুষকে শ্রম দিতে হয়। একটার জায়গায় দুইটা পণ্য বানাতে গেলে হয় জনবল বাড়াতে হবে অথবা বেশি সময় ধরে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে গেলে পুঁজি কিংবা শ্রম বা দুটোই বাড়াতে হবে। কিন্তু এ-দুটো বাড়ানোর সহজ কোনো উপায় নেই। তাই এগুলো হচ্ছে permissioned leverage। কারও কাছে চাইতে হবে বা পয়সা ঢালতে হবে। কিন্তু বর্তমান যুগে একটি সফটওয়্যার কিংবা একটি ভিডিওকে একজনের জায়গায় ১০ জনের জন্য উন্মুক্ত করতে হলে তেমন কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, একবার বানানোর পর সেটাকে বারবার বিক্রি করতে পুনরায় উল্লেখযোগ্য শ্রম বা পুঁজি লাগছে না। তাই এ-দুটো হলো permissionless leverage। সহজ ভাষায় বললে, সুপারপাওয়ার।
তাই প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে পরিবর্তন সৃষ্টিকারী কিছু করতে চাইলে কোড এবং মিডিয়া এই দুটি নিয়ে কাজ করতে হবে। মিডিয়া বলতে কিন্তু আবার নাটক, সিনেমা না। একে তো ওগুলোর বেশিরভাগ কাজেই হারাম জড়িত আর অন্যদিকে সেগুলোও কিন্তু পারমিশনলেস না; পুঁজি এবং জনবল লাগবেই। মিডিয়া বলতে বুঝাচ্ছি লেখালেখি, অডিও কিংবা ভিডিও ফর্মে আলোচনা ইত্যাদি। যেগুলো করতে তোমার অন্য কারও অনুমতি কিংবা সহায়তার প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার ইচ্ছা, নতুন কিছু জানার এবং করার আগ্রহ আর লেগে থাকার মনোবল।
আমরা ইতিহাসের একটা এক্সাইটিং সময়ে বাস করছি। তোমাদের হাতের নাগালেই আছে সুপারপাওয়ার। একবার চিন্তা করো, সুপারম্যান তার লেজার ভিশন ব্যবহার করছে শুধু খাবার গরম করার জন্য। এটা যেমন হাস্যকর শোনায়, তেমনি তোমার সময় আর এই সুপারপাওয়ারগুলোকে যদি তুমি ওয়েব সিরিজ আর রিল দেখায় নষ্ট করো তোমার গল্পটাও তেমন শোনাবে।
[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]