(১)

আজকের দিনটা বিথীর জন্য বিশেষ একটা দিন। বিথী ভোরবেলা না জাগলেও আজ ভোর হতে না হতেই ওর ঘুম ভেঙে গেছে। সকাল সকাল উঠেই তৈরি হয়ে নেয় সে। এরপরই চলে আসে এখানে। চার রাস্তার মোড়ের পাশের এই জেলা কলেজে। এখানেই চলছে অডিশন। বিথী আর ওর বান্ধবী ছন্দা সেই সকাল দশটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছে। দুপুর হয়ে এসেছে। কড়া রোদে চামড়া কড়কড় করছে। এখনো ওদের নাম ডাকেনি কেউ। উত্তেজনায় দুজনেই ঘামছে। একটু পর পর আয়না বের করে মুখের মেকআপে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে। একজন আরেকজনের চুলে হাত বুলিয়ে ঠিকঠাক করে দিচ্ছে।

মাসের পর মাস প্রস্তুতি নিয়ে আজ এখানে এসেছে দুইজন। আজ থেকে প্রায় ছয় মাস আগে বিথীই প্রথম দেখেছিল মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার বিজ্ঞপ্তি। সেদিনই প্রাণের বান্ধবী ছন্দাকে কথাটা জানায়। এরপর দুজনে মিলে ঠিক করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। বাসায় সাপোর্ট পাবে না জেনেও দুজনে সবরকম প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। ছন্দা বিথীর ছবি তুলে দেয়, আর বিথী তোলে ছন্দার ছবি। ওয়েস্টার্ন-বাঙালি ক্ল্যাসিক-মডার্ন সব স্টাইলের পোশাকে বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে কয়েকশ ছবি তোলে ওরা। এরপর খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে সেরা শটগুলো পাঠিয়ে দেয় প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যে। আর ওদেরকে অবাক করে দিয়ে দুজনকেই অডিশনের জন্য ডাকা হয়! ওদের খুশি তখন দেখে কে! ওরা কল্পনাও করেনি, দুজনে একই সাথে ফার্স্ট অডিশনের জন্য চান্স পাবে। এটা ওদের জীবনে খুব বড় একটা সুযোগ। এই সুযোগকে ভুলেও নষ্ট করা যাবে না।

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন বলে বাসা থেকে বের হতে অনেক ফন্দি আঁটতে হয়েছে বিথীকে। বাসায় বলেছে, ও ছন্দার বাসায় যাচ্ছে। গ্রুপ স্টাডি করতে হবে। এরপর আর কেউ সন্দেহ করেনি। সবাই জানে, ওরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড। ছুটির দিনগুলিও প্রায়ই এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীর বাসায় কাটায়। ছন্দার বাসায় অত রেস্ট্রিকশন নেই। ওর বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা কাছে থাকে না বলে বাবার কিছুটা প্রশ্রয় পেয়েই বড় হয়েছে ছন্দা। তাছাড়া নাচ-গান, বাদ্য-বাজনার দিকে কিছুটা ঝোঁক আছে ছন্দার পরিবারে। তবু এই কচি বয়সেই মেয়েকে মডেলিং-এ নামতে দেবে কিনা তা নিয়ে ছন্দার সন্দেহ ছিল, তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে দুই বান্ধবী গোপনেই সব করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্ল্যানমাফিক সকাল সকাল দুজন কলেজের সামনে দেখা করে, এরপর একসাথে চলে আসে এখানে অডিশন দিতে।

‘এই মামা, যাবেন? বটতলার মোড়?’

‘হ, যামু। আইয়েন।’

দরদাম না কষেই দুজন উঠে পড়ে রিকশায়। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দেয়, ‘জলদি টানেন, মামা’। 

‘হ, এই তো আইয়া পড়ছি।’

কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা শুরু করে লোকটা। ‘বিশ টেহা দিছেন ক্যান? এইখানের ভাড়া চল্লিশ টেহা।’

‘কী বলছেন মামা? আমরা এই এলাকার মেয়ে, প্রতিদিন রিকশায় চড়ি, আমরা ভাড়া জানি না? বিশ টাকার বেশি এক টাকাও না। ঠিক আছে, আজকের জন্য পঁচিশ রাখেন।’

‘না, রাখুম না। কী পাইছেন? পঁচিশ টেহায় এইখানে ভাড়া অয়? চল্লিশ টেহার কম এক টেহাও না।’

ছন্দা রিকশাওয়ালার সাথে বাকবিতণ্ডা শুরু করতে গেলে বিথী ওকে থামিয়ে দেয়। ‘বাদ দে তো। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ চল্লিশ টাকা রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হনহন করে হাঁটা দেয় বিথী।

ছন্দাও গজগজ করতে করতে পিছে পিছে আসে।

‘এই বদ লোকটাকে খালি খালি ডাবল ভাড়া দিলি কেন? আমাদের তাড়া আছে দেখে ইচ্ছা করে ভাড়া নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধাল।’

সেটা বিথীও বুঝতে পেরেছে। সকাল-সকাল এরকম একটা ঘটনায় ওর মেজাজটাও চড়েছে। কিন্তু আজকের দিনে এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মুড অফ করতে চায় না বিথী। আজ ওকে সবদিক থেকে পরিপাটি থাকতে হবে। শুধু শারীরিকভাবে না, মানসিকভাবেও। 

অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বিথী এখানে এসেছে। সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় অডিশন চলছে। মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ড এটা। প্রাথমিক বাছাই পর্ব চলছে। এই পর্বে যারা উত্তীর্ণ হবে তারা জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। ঢাকায় গিয়ে বিচারকদের সামনে মডেলিং করছে—এই দৃশ্যটা ভেবে বিথী মনে মনে শিহরিত হয়ে ওঠে। পাশে দাঁড়ানো বান্ধবীর দিকে আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নেয়। রূপের দিক থেকে ছন্দার তুলনায় বিথী অনেকাংশেই বেশি আকর্ষণীয়। কলেজের ছেলেরা বলতে গেলে বিথীর পিছে পড়ে থাকে।

আচ্ছা, ছন্দা যদি ওর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তখন কী হবে? মাথা থেকে জোর করে ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে বিথী। এখন এসব ভাবার সময় না। সেই দিন আসতে এখনো অনেক দেরি। আগে ফার্স্ট রাউন্ডে টিকতে হবে। বাসায় সবার সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। বাবা-মা কে রাজি করিয়ে ঢাকা যেতে হবে। উফ! সত্যি কি বিথীর স্বপ্ন পূরণ হবে কোনোদিন?

সামনের লাইনটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। এই তো, আর একটা মেয়ের পরেই বিথীর পালা। বিথীর বুকে যেন দামামা বাজতে থাকে। ও কি পারবে নিজেকে তুলে ধরতে? ওর হাতের তালু ভিজে উঠছে বারবার। খুব টেনশনে বিথীর হাতের তালু ঘেমে যায়। একটু পর পর পানির পিপাসা পায়। বোতল খুলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নেয় বিথী। বড় করে একটা শ্বাস নেয়। এবার ওর পালা। জীবনে এমন সুযোগ বারবার আসে না। এই অডিশন রাউন্ডে ওকে টিকতেই হবে। ভয়, শঙ্কা, উত্তেজনা সব মনে চেপে রেখে যতটা সম্ভব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় বিথী। আড়াল হয়ে যায় ছন্দা আর বাকি সব প্রতিযোগীদের নজর থেকে।

প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট ধরে বিচারকগণ নানান প্রশ্ন করে বিথীকে। যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল তেমন কিছুই হলো না। বেশিরভাগই কমন প্রশ্ন। প্রশ্নোত্তর দিতে দিতেই বিথীর মনে হচ্ছিল সবার ওকে পছন্দ হয়েছে। আর ওকে অবাক করে দিয়ে চারজন বিচারকের প্রত্যেকেই ওকে ইয়েস কার্ড দিয়ে দেয়। বিথী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। খুশিতে লাফ দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বের হয়ে আসে অডিশন রুম থেকে। এসেই ছন্দাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু বেশিক্ষণ একসাথে আনন্দ উপভোগ করতে পারে না দুই বান্ধবী। পরমুহূর্তেই ছন্দার পালা। নাম ডাকা হলে ভেতরে চলে যায় ছন্দা। আর বিথীর কাছে মনে হতে থাকে ওর পুরো পৃথিবীই যেন পাল্টে গেছে। এই ধুলোমাখা পথ, রাস্তার পাশের টঙের দোকান, কাকফাটা রোদ্দুর সবকিছু ওর ভালো লাগছে। এমনকি সকালবেলার বেয়াদব রিকশাওয়ালা লোকটাকেও মনে মনে ক্ষমা করে দেয় ও। স্বপ্নপূরণের পথে প্রথম ধাপ পার করেছে বিথী আজ। ও আজ অনেক বেশি খুশি। 

(২)

সারাদিন পর বাসায় ফিরে কাঁধের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে মারে বিথী। ভয়ানক ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। পেটে রাজ্যের খিদে জড়ো হয়েছে। কিন্তু মনের শক্তির কাছে ক্লান্তিরা হার মেনেছে। এসেই ডাক দেয় মিতুলকে। মিতুল বিথীর ছোট বোন। ওর স্বপ্নের একমাত্র সঙ্গী। এই বাড়িতে মিতুল ছাড়া আর কেউ বিথীর এই স্বপ্নের কথা জানে না। আজকের খুশির খবরটা মিতুলকে পুরোপুরি না বলে বিথী স্থির হতে পারবে না। মিতুল বড় বোনের ডাক শুনে দৌড়ে আসে। বিথীর মুখ আমন্দে ঝলমল করছে। 

জানিস, আজ কী হয়েছে?

বল না আপু, কী হলো? তুই চান্স পেয়েছিস?

হ্যাঁ! এবার আমি ঢাকা যেতে পারব! 

মিতুল বোনের কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে, আপু তুই সত্যি চান্স পেয়েছিস? হুররে! এখন তোকে টিভিতে দেখতে পাব! আর ছন্দা আপুর কী হলো?

ছন্দাও চান্স পেয়েছে। 

কী মজা! কী মজা! হাততালি দেয় মিতুল।

আস্তে, আস্তে! আব্বা-আম্মা শুনে ফেলবে।

কিন্তু আব্বা-আম্মাকে কীভাবে রাজি করাবি, আপু?

দেখি, কীভাবে রাজি করানো যায়। রাজি না হলে আমি একাই ঢাকায় যাব। 

কী বলিস, আপু?

হ্যাঁ রে, মিতুল। ঢাকার প্রতিযোগিতায় আমাকে যেতেই হবে, সেটা যেভাবেই হোক। 

উফ, আমার তো শুনেই ভয় লাগছে। দেখিস আব্বা-আম্মা রাজি হয়ে যাবে। তাহলে তোকে আর একা যাওয়া লাগবে না।

দেখতে দেখতে ঢাকায় যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। মনে সাহস জড়ো করে বিথী ওর বাবা-মায়ের সামনে আসে। এতদিন নিজে নিজে সবকিছু ম্যানেজ করতে পারলেও, এবার বাবা-মাকে জানাতেই হবে। নাহয় কোনোবাবেই ঢাকায় যাওয়া সম্ভব না।

বিথীর আম্মা ঘরোয়া স্বভাবের মহিলা। মেয়েদের নাচ-গান, অভিনয় তার পছন্দ না। তিনি কোনোভাবেই বিথীর মডেলিং-এ যাওয়া মেনে নেবেন না, এটা ও ভালোভাবেই জানে। তাই বাবাকেই আগে বলবে বলে ঠিক করে বিথী। তার বাবা মেনে নিলে মা-ও কিছু বলতে পারবে না।

আব্বা, আমি মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় চান্স পেয়েছি। 

বিথীর বাবা খবর শোনায় ব্যস্ত ছিলেন। লুঙ্গির কোণা দিয়ে চশমা মুছে মেয়ের দিকে তাকালেন। ‘কিছু বলবি মা?’

আব্বা, আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় চান্স পেয়েছি। 

মিস বাংলাদেশ মানে? মডেলিং?

জি, বাবা। 

বিথীর বাবা তড়াক করে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। উঁচু গলায় বলেন, ‘মডেলিং-এ তো আমাদের বাড়ির কোনো মেয়েরা যায়নি। আমার মেয়েরা এসব নাচ-গান, অভিনয় করলে সবাই কী বলবে? আত্মীয়-স্বজনের কাছে কীভাবে মুখ দেখাব?’

চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বিথীর মা-ও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন। ‘মডেলিং মানে? কখন চান্স পেলি, কীভাবে এসব হলো? ঢাকায় যেতে হবে কেন?’

বিথী চুপ করে থাকে। বিথীর মা এবার ছোট মেয়ে মিতুলকে জেরা শুরু করেন। জলদি বল, নাহয় পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। মিতুল ভয় পেয়ে গড়বড় করে সব বলে দেয়। ‘বিথী আপু ছন্দা আপুর সাথে মডেলিং করেছে। ওরা একসাথে অডিশন দিতে গিয়েছিল।’

বিথীর বাবা রাগে ফেটে পড়েন। ‘কী? তলে তলে এতদূর? তোকে পড়াশোনা করার জন্য ছন্দার বাসায় যেতে দিই। আর ওর সাথে মিলে তুই যাস মডেলিং করতে? আজকে থেকে তোর সব গ্রুপ স্টাডি বন্ধ। খালি কলেজে যাবি আর বাসায় ফিরবি। কোনো বন্ধুবান্ধব আড্ডাবাজি চলবে না। আর মডেল হতে চাইলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি। আর যেন তোর চেহারা না দেখি।’

বিথী কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলে। নিজের ঘরে গিয়ে সারারাত কান্নাকাটি করে। রাতে খাবারের সময় হয়ে যায়, কিন্তু কেউ ওকে একবারও খেতে ডাকে না।

কলেজে ছন্দার সাথে দেখা হয় বিথীর। ছন্দা ঢাকা যাওয়ার সবরকম প্রিপারেশন নিয়ে নিয়েছে৷ ‘কী রে, বিথী! এমন মুখ গোমড়া করে আছিস কেন? ঢাকা যাবি না?’

জানি না।

কেন? আংকেল-আন্টিকে এখনো বলিসনি?

তুই জানিয়েছিস চাচাকে?

হ্যাঁ, বিশ্বাস করবি না, বাবা তো অনেক সহজে রাজি হয়ে গেছে! জানিস, আমি ভেবেছিলাম বাবাকে রাজি করাতে আরও ঝামেলা হবে। তুই কার সাথে যাবি?

‘আমার বাবা-মা এখনো রাজি হয়নি।’ বিথী ওর বাসার সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। 

ওহ গড! এখন কী হবে? এক কাজ কর, বিথী। তুইও আমাদের সাথে ঢাকা চল। আমার ফুপুর বাসায় উঠবি, কোনো সমস্যা নেই।

ছন্দাকে ওর বাবা আগামী সপ্তাহে ওকে ঢাকা নিয়ে যাবে। বিথীর মন কষ্টে অবশ হয়ে আসে। কত আশা ছিল ওর, কত স্বপ্ন ছিল! ঢাকা যাবে, মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে, বড় মডেল হবে। ইশ, ওর বাবাও যদি ছন্দার বাবার মতো মেনে নিত!

ঢাকা যাওয়ার জন্য মাত্র এক সপ্তাহ আছে। বিথী মনে মনে হিসাব কষে। ওর কাছে সালামির কয়েক হাজার টাকা জমা আছে। ঢাকায় গেলে ছন্দার আত্মীয়র বাসায় উঠতে পারবে। আর এরপর ফাইনাল রাউন্ডে সিলেক্ট হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই। তখন প্রতিযোগিতা থেকেই হোটেলে থাকতে দেওয়া হবে। একা একা ঢাকায় কীভাবে চলবে, বাবা-মায়ের কী হবে, বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে পরে ফিরবে কীভাবে—অত সাত-পাঁচ না ভেবে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় বিথী। ও ঢাকায় যাবে। আর এবার মিতুলকেও কিছু বলবে না। নইলে মিতুলের থেকে বাবা-মা জেনে যাবে।

কাউকে কিছু না জানিয়ে পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে সবকিছু প্যাকিং করে ফেলে বিথী। মনে মনে প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করছে ওর। ঢাকার প্রতিযোগিতা কেমন হবে? যে মেয়েগুলো আসবে তারা সবাই কেমন? ও কি জিততে পারবে? এইসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে বাড়ি ছাড়ে বিথী।

কল্পনায় সাজানো স্বপ্নের মতো মনে হয় সবকিছু। বাবা-মা ছাড়া এই প্রথম যাত্রা ওর। ছন্দা আর ওর বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসে বিথী। আর অবাক করা বিষয়, সেকেন্ড এবং থার্ড রাউন্ডেও টিকে যায় দুজন। মাত্র বিশজন প্রতিযোগী বাকি আছে এখন। প্রাণের বান্ধবীও এখন প্রতিদ্বন্দ্বী। বিথী নিজের দিকে ফোকাস করে। ওর মডেলিংয়ের দক্ষতা, গেট-আপ, লুকস সবকিছুই বিচারকরা পছন্দ করেছে। ওর জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

‘তুই জিতে যাবি বিথী, দেখিস!’

‘ইশ, কী যে বলিস না তুই!’ মুখে মুখে বললেও মনে মনে বিথীর বিশ্বাস ও জিততে পারবে। প্রসঙ্গ বদলাতে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘আর যদি তুই জিতিস? আমাকে ভুলে যাবি না তো?’

‘যাহ! আমি তোকে কখনোই ভুলব না। কিন্তু আমার জেতার চান্স কম। দেখলি না, ওই মহিলা জাজটা কেমন ক্যাটক্যাট করে আমার দিকে তাকায়, আর তেড়াবেঁকা প্রশ্ন করে!’

‘একদম ঠিক বলেছিস, মহিলাটাকে আমার একটুও সহ্য হয় না।’

দেখতে দেখতে দিন কেটে যায়। ফাইনাল রাউন্ডে হোটেলে থাকা শুরু করে দুই বান্ধবী। এখন প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো অ্যাক্টিভিটি থাকে ওদের। হয় কোনো অভিনয় শিল্পীর থেকে ট্রেইনিং, অথবা ফটোগ্রাফি, নতুবা মেকআপ আর্টিস্টদের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এত ব্যস্ততার ভেতর বিথী ভুলেই যায় ওর বাবা-মা কেমন আছে। জেতার নেশা ওকে পুরোপুরি পেয়ে বসেছে। প্রতিযোগিতার এই পর্যায়ে এসে ওর আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে বহুগুণ। সময়টা যেন ঝড়ের গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে ফাইনাল রাউন্ড শুরু হয়। খুব অল্প নম্বরের ব্যবধানে ছন্দা বাদ পড়ে যায়। আর বিথী চলে আসে সেরা দশে।

ছন্দার বাবা ওকে নিতে ঢাকা আসেন। বিদায় নেওয়ার সময় বলেন, ‘বিথী মা, তুমি এতদিন ছন্দার সাথে থেকেছ। এখন তো আমরা চলে যাচ্ছি। তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?’

‘না চাচা, আমি ঠিক আছি।’

‘ঠিক আছে মা, কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ফোন দিয়ো। আর তোমার আব্বা-আম্মার সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি জানিয়েছি, তুমি আমাদের সাথেই থেকেছ।’

বিথী প্রশ্ন করে, ‘আব্বা-আম্মা কি এখনো আমার সাথে রাগ, চাচা?’

‘উনারা অনেক পেরেশান হয়ে আছেন। বিথী মা, তুমি তোমার বাসায় ফোন দাও। রাগ হলেও তোমার বাবা-মা তো, উনাদেরকে মানানোর চেষ্টা করো মা।’

‘ঠিক আছে, চাচা। আমি বাসায় ফোন দিব।’

ঠিক আছে বললেও বিথীর আর ফোন দেওয়া হয় না। একে একে সেরা পাঁচে চলে আসে বিথী। এখন পুরো দেশে সরাসরি দেখানো হচ্ছে ওদের প্রতিযোগিতা। আর মাত্র কয়েক কদম বাকি। এরপরই ওর স্বপ্ন সত্যি হবে! বিথী আনন্দে চোখ বুজে ফেলে। পেরেছি, আমি পেরেছি!

কে জানত বিথীর জীবনের ট্রেন সম্পূর্ণ ভিন্ন গতিতে, ভিন্ন এক পথে মোড় নিতে যাচ্ছে।

ফাইনাল প্রতিযোগিতার সপ্তাহে হঠাৎ করেই বিথী অসুস্থ হয়ে যায়। সারা মুখ, শরীর লাল লাল গুটিতে ভরে যায়। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, গলা বসে গেছে, চোখ ফুলে ঢোল। একটু পর পর কাশি আর হাঁচি দিতে দিতে কাহিল দশা। তবু বিথী মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। আর তারপরই মাথা ঘুরে পড়ে যায় ও।

চোখ মেলে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বেডে শোয়া। পাশে চিন্তিত মুখে ওর বাবা, মা, মিতুল। এতদিন পর পরিবারের সবাইকে দেখে বিথীর চোখ ভিজে ওঠে। ওর মা আর মিতুল এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। বিথীও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অনেক কষ্ট আর ত্যাগের পর এই পর্যায়ে এসেছিল বিথী। বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হয়েছে, বাড়ি ছেড়েছে, একা একা সব কিছু করেছে। কিন্তু ওর কপালে মিস বাংলাদেশের খেতাব নেই আজ বুঝতে পারছে। এই শারীরিক হালে, এমন ভয়ংকর রোগীর চেহারা নিয়ে জেতা দূরের কথা, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করতে পারবে না। তবে মন্দের ভালো এই যে, ওর অসুস্থতার উসিলায় বাবা-মায়ের রাগ গলে পানি হয়ে গেছে। মেয়ের এমন মলিন মুখ দেখার পর কেউ ওকে আর একটু বকাও দেয়নি।

প্রায় দশদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় বিথী। বাবা-মায়ের সাথে বাড়িতে ফিরে আসে। আগের মতোই কলেজে যাতায়াত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই বিথীর বিয়ে ঠিক করে ওর বাবা-মা। মেয়ে একবার না বলে বাড়ি ছেড়েছে, অভিনয় জগতে পা বাড়াতে চেয়েছে, এই মেয়েকে আর ঘরে বসিয়ে রাখা ঠিক মনে হয়নি উনাদের কাছে। খোঁজখবর নিয়ে শীঘ্রই একজন ভালো পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দেন তারা। বিথীর সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরবাড়িতে পা বাড়ায় বিথী। মনে মনে আফসোস করে, ইশ, সেদিন যদি আব্বার-আম্মার কথা শুনতাম, তাহলে এভাবে এত কম বয়সে বিয়ে করতে হতো না৷ কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই।

(৩)

দশ বছর পরের কথা।

বিথী এখন ফুটফুটে দুই সন্তানের মা। আর ছন্দা বড় মাপের অভিনেত্রী। ছন্দাকে দেখে এখন চেনাই যায় না। মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলেও পরবর্তীতে এগিয়ে গেছে ছন্দা। ভাগ্য সবসময় ছন্দার সহায় হয়েছে। বিথীর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছন্দার পজিশনে তো আজ ও থাকতে পারত। রূপে-গুণে কোনো অংশেই ছন্দার থেকে কম ছিল না। এমনকি ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত বিথীই টিকে ছিল। ছন্দা তো আরও আগেই বাদ পড়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যের জেরে বিথী এখন সামান্য এক গৃহিনী আর ছন্দা একজন সুপারস্টার!

ছন্দা কীভাবে এতদূর পৌঁছে গেল? ছন্দার সাথে যোগাযোগ নেই অনেক বছর। সাফল্যের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনেক আগেই ও দূরে সরে গেছে।

একটা নিউজে হঠাৎ চোখ আটকে যায় বিথীর। নামকরা অভিনেত্রীর আত্মহত্যা। দেশখ্যাত মডেল, আমাদের সবার প্রিয় অভিনেত্রী ছন্দা গতকাল ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। আজ সকালে তার ফ্ল্যাট থেকে ডেডবডি উদ্ধার করা হয়। নিউজটা শুনে বিথী ধপ করে বসে পড়ে। এসব ও কী শুনছে? সাথে সাথে মিতুলকে ফোন দেয়। হ্যাঁ, যা ও নিউজে শুনেছে সব সত্যি। ছন্দা সুইসাইড করেছে।

বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ির দিকে রওনা দেয় বিথী। একসময় ছন্দা আর ওর বাবা ওকে অনেক সাহায্য করেছে, এই দুঃসময়ে অন্তত চাচাকে একটু স্বান্তনার দেওয়া দরকার। নানাবাড়ি এসে বাচ্চারা খুব খুশি। ওদেরকে মিতুলের কাছে রেখে মরাবাড়িতে যায় বিথী। অনেক বছর পর ছন্দাদের বাসায় আসা হলো। এই বাসায় আগে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একবার-দুবার আসত! যদিও ছন্দা আরও আগে থেকেই শহরে নিজের আলাদা ফ্ল্যাটে চলে গেছে। তবে ছন্দার বাবা এখনো এখানেই থাকেন।

বিথী ভেবেছিল মরাবাড়িতে অনেক অভিনেতাও বুঝি আসবে। ছন্দা যেহেতু এখন বড় অভিনেত্রী। কিন্তু তেমন কিছু দেখতে পেল না। সবাই মুখে মুখে শোক জানিয়েই খালাস। তবে ছন্দার আত্মীয়-স্বজনরা এসেছে। নিজেরা নিজেরা আলাপ করছে। তাদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক ফিসফাস কথা কানে আসে বিথীর। ছন্দার নাকি অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। টাকার জন্য নিজেকে বেঁচে দিয়েছে। উপরে ওঠার জন্য অভিনেতা-পরিচালকদের বিছানায় গেছে। বিথী চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। মরা মানুষকে নিয়েও এত কথা?

সবাইকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে বিথী। ছন্দার বাবা একটা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন।

চাচা, আমি বিথী। আমাকে চিনতে পেরেছেন?

বিথীকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন ছন্দার বাবা। 

বিথী মা রে, আমার মেয়েটা আর নাই রে মা। কিছুক্ষণ পর ছন্দার বাবা একটু শান্ত হয়ে এলে বিথী বলে, সত্যি চাচা, আমরা কেউ আশা করিনি এমন কিছু হবে। এত অল্প বয়সে ছন্দা চলে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি।

অভিনয় আমার মেয়ের জীবনটাকে নষ্ট করে ফেলল রে মা..

এভাবে বলবেন না চাচা! ছন্দা অনেক সাকসেসফুল একটা মেয়ে, ও আমাদের সবার গর্ব। কিন্তু এত সুন্দর একটা লাইফ পেয়েও কেন যে সুইসাইড করল! চাচা, আপনি কি কিছুই টের পাননি?

না রে, মা! এভাবে যে ও নিজের জীবন নিয়ে নিবে তা তো বুঝিনি। কিন্তু অনেকদিন ধরেই ও ডিপ্রেশন ভুগছিল।

কী বলছেন চাচা? ডিপ্রেশন! আমার তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। 

হ্যাঁ মা, তুমি ছন্দার ছোটবেলার বান্ধবী। তোমার কাছে কিছুই লুকাব না। ওর জীবনে সুখ ছিল না। অভিনয়ের জগৎটা বাইরে থেকে যতটা চকচকে, ভেতরে ভেতরে ততটাই নোংরা, কালো, অন্ধকারে ঢাকা। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। কেউ কারো ভালো চায় না। ছন্দাও হারিয়ে গেল। ওর কাজ, ওর সাকসেস পেতে এমন পথ বেছে নিল, যে পথে কেউ সুখী হতে পারে না। বাবা হয়ে আমি এসব কীভাবে মেনে নিই মা, বলো? কিন্তু ছন্দা আমার কাছ থেকেও চলে গেল। নিজের ফ্ল্যাট কিনল। নিজের মতো থাকা শুরু করল। ওখানে কী করত তা মুখে বলা সম্ভব না রে মা।

আপনি ওকে বুঝিয়ে বলেননি কেন চাচা?

অনেক বলেছি, অনেক বুঝিয়েছি। এসব ছাইপাশ ভুলে এবার একটা বিয়েশাদী কর। সংসার কর। জীবনটাকে গুছিয়ে নে। কিন্তু ও আমার কথা শুনল না রে মা। চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেল। ভুল পথে পা বাড়িয়ে নিজেকে শেষ করে দিলো।

বুক চাপড়ে আফসোস করতে থাকে ছন্দার বাবা৷ বিথী মা, তোমার আব্বার মতো আমিও যদি আমার মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিতাম। তাহলে আজ নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পারতাম। আমার মেয়েটা দশটা-পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো বেঁচে থাকত। সুন্দর একটা জীবন পেত। কী হবে এত টাকাপয়সা দিয়ে? এত সুনাম, এত খ্যাতি দিয়ে আমি কী করব মা? আমার মেয়েই আমাকে ছেড়ে চলে গেল! আমার একটামাত্র মেয়ে, এই বলে ছন্দার বাবা আবারও কাঁদতে লাগলেন।

বিথী বেশিক্ষণ না থেকে বেরিয়ে আসে মরাবাড়ি থেকে। পত্রপত্রিকায় ছন্দাকে নিয়ে যেসব কথা পড়ত, সেগুলো তারমানে মিথ্যা না। ছন্দার হাসিখুশি ছবি দেখে বিথী কল্পনাও করেনি ওর জীবনটা এতটা কমপ্লিকেটেড। এরচেয়ে তো বিথী অনেক ভালো আছে। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে সুখের ঘর করছে। বিথী মনে মনে ওর বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। এতদিন জীবন নিয়ে হাহাকার ছিল। জলদি বিয়েশাদী-বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেল বলে মনে মনে অনেক অভিযোগ ছিল। স্বপ্নপূরণ করতে না পারার খেদ ছিল। আজ মনে হচ্ছে এই স্বামী-সংসার-সন্তান এরাই জীবনের বড় প্রাপ্তি!

গেটের সামনে এসেই একটা রিকশায় চেপে বসে বিথী। পাঁচ মিনিটের মাথায় ওদের বাড়ি পৌঁছে যায়। দশ টাকা এগিয়ে দিতেই রিকশাওয়ালা গজগজ করতে করতে বলে, ‘দশ টেহায় হয়? বিশ টেহার কম এক টেহাও না।’ 

একটু আগেই বিথী মাত্র দশ টাকা ভাড়ায় ছন্দাদের বাড়িতে গেল। কিন্তু আজ আর কথা বাড়াতে মন চায় না ওর। বিশ টাকাই এগিয়ে দেয় বিথী। দশ বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ে যায় ওর। সেদিনও একটা রিকশাওয়ালা এভাবেই বেশি ভাড়া চাচ্ছিল। এতদিন যেসব স্মৃতি মনে করে অজস্রবার হাহাকার করেছে বিথী, আজ সেসব কথা ভেবে কেন যেন ওর একটুও খারাপ লাগছে না। খালি বুঝতে পারছে, আজ ওর মনের ওপর থেকে খুব ভারি একটা পাথর সরে গেছে।

বাড়ি ফিরে অকৃত্রিম ভালোবাসায় দুই সন্তানকে বুকে টেনে নেয় বিথী। বহুবছর পর বাবা-মায়ের পাশে বসে মনখুলে গল্প করে। আজ ওর মনে আর কোনো আফসোস নেই। বিকেলের সোনালি রোদে ভাসতে ভাসতে বিথীর মনে হয়, এই সাদামাটা সাধারণ জীবনটাই ও চায়। এটুকু জীবনই ওর শান্তি। ওর আর কোনোকিছুর প্রয়োজন নেই।

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]