কথা ছিল পড়তে বসব শনিবার সকালে। এখন পরের সপ্তাহের রবিবার রাত। ১০ টা পার হয়ে গিয়েছে। মাঝখানে ৮ টা দিন কীভাবে চলে গেল টেরই পাইনি।

টুকটাক ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে। ভার্সিটি লাইফের একটা ডায়েরি খুলতেই দেখলাম এই পৃষ্ঠাটা বের হয়ে আসলো।

কাজে আলসেমি করা আমার খুব বাজে একটা অভ্যাস। ভার্সিটি লাইফে এসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। কাল থেকে পড়ব, পরশু পড়ব, পরের সপ্তাহ থেকে সিরিয়াসলি পড়াশোনা করব, পরের মাস থেকে খুব ভালো করে পড়ব, এই সেমিস্টারটা যাক সামনের সেমিস্টার থেকে একেবারে কোপ দিব… এরকম ভাবতে ভাবতে ভালো করে পড়া হতো না। পরীক্ষা চলে আসত। পরীক্ষার রাতে নিজেকে আবিষ্কার করতাম বিশাল বইয়ের স্তূপে। চাপে ভেঙে পড়তাম।

‘একটা পরীক্ষা আমার তোমার মেধাকে যাচাই করতে পারে না, বিল গেটস পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি…’ এমন টাইপের দার্শনিক পোস্ট দিতাম ফেসবুকে।

বিল গেটস পরীক্ষায় পাস না করে বিল গেটস হতে পেরেছে, কিন্তু আমি বিল গেটস হতে পারিনি! পরীক্ষায় ফেইল করা তো আর বিল গেটস হবার পূর্বশর্ত না, তাই না? নইলে সবাই বিল গেটস হতো।

তো, এরকম আলসেমি করার ফলে সারাজীবন ধরে অন্যের অনেক বকাবকি, ঝাড়ি সহ্য করা লেগেছে। অনেক ভালো ভালো সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি জীবনে। আমার একান্ত চাওয়া থাকবে তোমরা অলসতা থেকে দূরে থাকবে।

সবসময় যে নিজেই ইচ্ছা করে অলসতা করতাম, তা কিন্তু আসলে না। বেশিরভাগ সময়ই ফাঁদে পড়ে যেতাম। কিন্তু ফাঁদগুলো বুঝে উঠার আগেই আমার সর্বনাশ করে দিয়ে যেত। তাই চলো, শুরুতেই ফাঁদগুলো তোমাদের চিনিয়ে দিই...

কিছু ফাঁদ-

১। আমি আধা খ্যাচড়াভাবে পড়ব না। পড়লে খুব ভালো করে পড়ব। যেন যতই কঠিন প্রশ্ন করুক না কেন, আমি উত্তর দিতে পারি। এখন যেহেতু পড়তে ভালো লাগছে না, আধা খ্যাচড়াভাবে পড়া হচ্ছে; তাই বাদ দিই, পড়ার দরকার নেই। এমন পারফেকশনিস্ট মনোভাব ছিল আমার।

২। ৯ টা ৩০ থেকে কাজ করা শুরু করব। এখন কয়টা বাজে? ৯ টা ২০। যাই ১০ মিনিট মোবাইল চাপাচাপি করে আসি। লাইফে একটু চিইল না করলে হয় না কি!

৩। আজকে তো রুটিন মানতে পারলাম না। তাই আজকে বাদ দিই। কাল থেকে একেবারে ভালোমতো পড়াশোনা করব/কাজ করব।

৪। আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না। গা কেমন জানি ম্যাজম্যাজ করছে। আজকে বাদ দিই থাক। কালকে থেকে করব ইনশাআল্লাহ।

৫। অনেকগুলা কাজ নিতাম একসাথে। হয়তো অমুক ক্লাবের অমুক ভাই বলছে একটা কিছু করে দিতে। তার কাজ নিলাম। তমুক ভাই বলছে তার ল্যাব রিপোর্ট যেন আমি নিজে লিখে দিই। স্যার ডেকে বলছে উনাকে যেন এসাইনমেন্ট চেক করতে হেল্প করি… অমুকে বাসা থেকে মিথ্যা বলে টাকা নিত রেগুলার... এবার ধরা খাইছে বাবার হাতে, তার বাবাকে এখন আমার ভূগোল বুঝাতে হবে… এমন হাজারটা দায়িত্ব থাকত আমার ঘাড়ে। এত এত কাজ জমত যে, কোনটা ছেড়ে কোনটা করি… শেষমেশ কিছুই করতে পারতাম না।

৬।  রাত জাগার ফলে ঘুম হতো না ঠিকঠাক। দিনেও ঘুমিয়ে সেটা পোষানো যেত না। মাথা ঝিমঝিম করত। কাজকাম, পড়াশোনা করতে আলসেমি লাগত। সারাদিন খালি হাই উঠত। খেতাম না ঠিকমতো। সকালে নাস্তা করা তো বিরল ঘটনা ছিল। আবার ব্যায়াম বা খেলাধুলাও করা হতো না। শরীর একেবারে লুথা হয়ে থাকত। ব্রয়লার মুরগীর মতো। মনের মধ্যে যে একটা ফুর্তি বা জোশ, সেটা থাকত না।   

৭। হাজারটা ডিসট্র্যাকশন ছিল আমার চারপাশে। এই অমুকে ডাকছে- চল বাইরে থেকে চা খেয়ে আসি। তো তমুকে ডাকছে- আয় একদান খেলে নিই। দরজা বন্ধ করে রাখলেও শান্তি নেই। ফোনে একটু পরপর টুং টাং টুং টাং। কে ম্যাসেজ দিল চেক করতে গিয়ে আমি হারিয়ে যেতাম ফোনের রাজ্যে। কয়েক ঘণ্টা পর হুশ ফিরত। কিন্তু ততক্ষণে মাথা পুরা আউলায়া ঝাউলায়া গিয়েছে। আর কাজ শুরু করার এনার্জি পেতাম না।

৮। অলসতা করলে তো আর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, এমন একটা মানসিকতা গেড়ে বসেছিল। স্কুল-কলেজে অলসতা করলে জবাবদিহিতা করতে হতো। কিন্তু ভার্সিটি লাইফে সেটা ছিল না। এই ব্যাপারটা আমার বেশ ক্ষতি করেছিল। এখন বুঝতে পারি; কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি।

৯। আরে, এটা তো খুব কঠিন টপিক। আরে, ওইটা তো খুবই জটিল আর বড় কাজ। আমি এখন এত বড় কাজ শেষ করতে পারব না। আজকে থাক, আগামীকাল সময় বের করে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে খুব ভালোমতো কাজটা শেষ করে ফেলব—এমন চিন্তার কারণে কোনো কাজ শুরুর আগেই ভয় পেয়ে যেতাম। কাজ শুরু আর করা হতো না।

১০। টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে পারতাম না। কোন কাজটা ফেলে রাখা যাবে না, কোন কাজটা আপাতত কিছুদিন ফেলে রাখলেও প্যারা নাই, কোন কাজটা কখন করা লাগবে এটা বুঝতাম না। 

১১। অলসতা বা কাজে অনীহার অন্যতম একটা কারণ হলো বদনজর। এই বদনজর আমার লেগেছিল। কিন্তু সেটা বুঝতেই পারিনি। বদনজরের ব্যাপারটা অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু এটা আসলেই সত্য।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে আছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন : ‘বদনজর সত্য!’[1]

আজকে তো ফাঁদ আলোচনা করতে করতেই গেল। সমাধান আলোচনা করার সুযোগ পেলাম না। তবে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করলেই আসলে ৫০ ভাগ সমাধান হয়ে যায়।

সমাধানগুলো পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাবে। তবে একটা টিপস দিয়ে যাই—

যে কাজটা তোমার আজ করা দরকার, কিন্তু তোমার করতে মন চাচ্ছে না, এমন একটা কাজ খুঁজে বের করো। বা পড়া লাগবে কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছে না, এমন টপিক খুঁজে বের করো।

তোমার সেই  কাজটা আজ পুরাটা করা লাগবে না। খুব সুন্দরমতো করা লাগবে না। ১০০ তে ১০০ পাওয়া লাগবে না। বইটা খুলো। জাস্ট ৫ মিনিট বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবা। বা লেখবা। বা যে কাজটা নিয়ে তুমি অলসতা করছ, সেই কাজটা জাস্ট ৫ মিনিট করবা। এরপর দেখবা ম্যাজিক!

কী ম্যাজিক দেখলা, সেটা ষোলো পেইজের কমেন্টে জানিয়ে দিয়ো।

(চলবে ইনশাআল্লাহ…)


[1] বিস্তারিত এখান থেকে পড়ে নাও- https://ruqyahbd.org/blog/446/evileye-aqida