২০২২ সালের এপ্রিল মাস। করোনার দীর্ঘ ছুটির পর স্কুল খুলেছে ৭-৮ মাস হচ্ছে। স্কুলে আসার সময় প্রথম কৈশোরের মতো উৎফুল্লতা আর কাজ করে না। ক্লাসে দুই-একজন বাদে সবার মুখেই উদাসীনতার ছাপ, ১৬ বয়সটা যেন ঢাকা পড়ে যায়। ক্লাস শুরু হলে আবার ভাব ফিরে আসে। সবাই গল্প, কৌতুক, খুনসুটিতে মেতে ওঠে।
অন্যান্য দিনের মতো আজকেও স্কুলে গেলাম। রমজান মাস সত্ত্বেও প্রথম পিরিয়ড বেশ মনোযোগী থাকার চেষ্টা করছি। বাংলা ম্যাম মুগ্ধ করা কথার ভঙ্গিতে, একটা প্রসারিত হাসি নিয়ে ‘নিমগাছ’ বুঝাচ্ছেন। একটা প্রশ্ন করে ম্যামকে নীরব উৎসাহও দিলাম। বাংলা ক্লাস শেষ। এরপর ইংরেজি ক্লাস। গত ইংরেজি ক্লাসে ছিলাম না।
কারণ, আমার আবার স্কুলে যেতে অলসতা লাগে খুব। সকাল বেলা ঘুম ভাঙা পটলচেরা চোখে মৃদু চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকলেই কেন যেন মা রাজি হয়ে বলে, ‘থাক, আজকে যেতে হবে না।’ ক্লাস থ্রিতে আমার স্কুল মিস দিতে একটু বেগ পেতে হতো। কারণ ছিল ফরম শিক্ষক। ফরম শিক্ষক ১০ মিনিটের নেইম প্রেজেন্টে এমন কিছু কথা বলতেন, তা শুনে আমার সহপাঠীরা নির্বিকার থাকলেও আমার খুব হাসি পেত। এই যেমন, ‘১২৩ আসেনি কেন, লন্ডন গেছে ওই!’ কথাটা হয়তো অতটাও হাসির না; তবে ফরম শিক্ষকের মুখে শুনলে হাসি পেত, মুখে হাত চেপে হাসতাম। তারপরও অনেক মিস দিয়েছি।
তাই গত ক্লাসে যেহেতু আসিনি, পড়া ধরলে যদি না পারি, বলব—‘ম্যাম, গত ক্লাসে আসিনি।’ এই কল্পনার মধ্যেই কেউ একজন বলল—‘ম্যাম, প্যারাগ্রাফ ফ্রি হ্যান্ড লিখতে দেবেন। যাকে যেটা ইচ্ছা। লেখা জমা নেবেন, ক্লাসে খাতা দেখবেন। কারও কোনো এক্সকিউজ শুনবেন না।’
এটা শুনেই কপালে ভাঁজ পড়ল, সিলেবাসের প্যারাগ্রাফগুলো আমি ফ্রি হ্যান্ড লিখতে পারি না। আবার কোনো এক্সকিউজও শুনবেন না। খুব ভয় কাজ করতে লাগল। ম্যাম লেখাপড়া বিষয়ে একটু কড়া। লিখতে না পারলে বা লেখায় ভুল থাকলে কাছে ডাকবেন, ভুল ধরবেন আর বকবেন। এতজনের মধ্যে আমার সব মানসম্মান মেঝের টাইলসে মিশে যাবে। ভাবতেই মাথা নিচু হয়ে আসছে।
ক্লাস কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায় ভাবতে লাগলাম, কিন্তু কোনো কার্যকর উপায় পেলাম না। বসে রইলাম আর অদূর ভবিষ্যতের নানা চিন্তা মস্তিষ্কে ভিড় জমালো। সবগুলো নেতিবাচক।
ম্যাম ঠিক সময় চলে আসলেন।
লিখতেও দিলেন। সবাই লিখছে। এইদিকে আমার অবস্থা নাজেহাল। কারণ, ক্লাস টেনের আমার রুমের ৬৪ জন ছাত্রীর মধ্যে প্রতিদিন ২০-২২ জন ছাত্রী অনুপস্থিত থাকার কুফল আজ ষোলো আনা আমার উপর এসে পড়ল। তাই আমাকে যেটা লিখতে দিলেন, সেটা আমার আশেপাশের কেউ লিখছে না। আমার বসার স্থানটাই বেখাপ্পা, দেওয়ালের পাশের সারিতে আমি একাই বসে, তাও প্রথম সিটে। ছাত্রী কম আসার দরুন এক সিটের এই সারিতে কেউ বসতে চায় না। জোড়া সিটের সারিতে বসে। আজকেও ব্যতিক্রম না।
যাই হোক, লিখতে শুরু করলাম। পাঁচ লাইন লিখার পর আর কী লিখব বুঝতে পারছি না। ম্যাম সময়ও দিয়েছে ১৫-২০ মিনিট। বাকি ১৫ মিনিট যা করার ম্যাম-ই করবেন। কী যে হবে তখন!
চিটিং করা পাপ, তার ওপর রমজান মাস, রোজা রেখে তো একদমই শোভা পায় না। কী করব বুঝতে পারছি না। ম্যাম রুম জুড়ে পায়চারী করছেন। তাই যতটা সম্ভব খাতা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছি, খাতায় যা লিখছি ম্যাম তা পড়ে ফেলার ভয়ে। ঠিক তখনই দেওয়ালে একটা টিকটিকি দেখতে পেলাম, নির্বিকার আমার দিকেই চেয়ে আছে, ভয় পাচ্ছে না আমাকে। মাথার বাত্তি জ্বলে উঠল (ইবলীস শয়তানটা একটা বুদ্ধি দিল)। ভাবলাম- টিকটিকি দেখে ভয় পাই না, তবুও এখন একটা চিৎকার দিয়ে কিছু সময় এই নাটকে ব্যয় করলে নিজের যেমন উপকার, আমার মতো যারা লিখতে পারছে না তাদেরও উপকার।
ভাবতে লাগলাম অদূর ভবিষ্যত, ‘আমি চিৎকার করলাম, সবাই আমার দিকে তাকালো, আমি লাফ দিয়ে আমার সিট থেকে সরে আসলাম। তারপর টিকটিকি দেখে আরও কয়েকজন চিৎকার করল। তারপর ম্যাম আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকাবেন। জিজ্ঞেস করবেন—টিকটিকি দেখে কেউ এভাবে চিৎকার করে! তারপর ম্যাম কিছু উপদেশ দেবেন। উপদেশ দিতে যেয়ে হয়তো ম্যামের টিকটিকি নিয়ে পুরোনো কোনো স্মৃতি মনে পড়ে যাবে। তারপর ম্যাম সেটা বলবেন। বলতে বলতে ঘণ্টা পড়ে যাবে আর আমাকে লিখতে হবে না।’
কিন্তু... আমি তো আসলেও টিকটিকি দেখে ভয় পায় না। এখন শুধু ম্যামের বকা থেকে বাঁচার জন্য ভয় পেতে চাচ্ছি, মিথ্যা মিথ্যা। মিথ্যাচার কি ঠিক হবে! ম্যাম হয়তো সর্বোচ্চ আম্মুকে কল দেবেন। আম্মু হয়তো অনেক বকবে, এই।
ঠিক করলাম, প্লান ক্যানসেল। আগে পড়া অন্য প্যারাগ্রাফের সাথে মিলিয়ে লিখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ম্যাম পায়চারী করছেন এবং আর কত সময় বাকি তা জানান দিচ্ছেন। মনটা খালি চাইছে কোনোভাবে যদি এই সময়টা নষ্ট হয়, ম্যাম আমাদের খাতা ক্লাসে না দেখেন। আহা! কত তীব্র সেই ইচ্ছা।
এর মধ্যেই কেউ একজন একটা প্রশ্ন করে বসল। ব্যাস! ম্যাম উত্তর দিতে থাকলেন। উত্তর দীর্ঘায়িত করছেন...। এর মধ্যেই পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠল। কী যে শান্তি! আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। বেঁচে গেলাম, শুধু খাতা জমা দিতে হলো। আরও বাঁচলাম। এরপর ঈদের ছুটি, ঈদের পর ম্যাম নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন, পরীক্ষার প্রশ্ন করতে ব্যস্ত থাকবেন। এই খাতাগুলোকে একটি বারও স্মরণ করবেন না। নূরুন আলা নূর ব্যাপার।
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। স্কুল ভবনের সামনেই ১১-১২ বয়সের কিশোরীরা খেলা করছে। ভবনের রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে একদল কিশোর একসাথে নিশ্চুপ অপলক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে অন্য রাজ্যে বিচরণ করছে। একাদশীরা তাকিয়ে থাকা সম্পর্কে সজাগ, তবে রাজকুমার কিশোরদের ওই কল্পরাজ্যের কল্পনার নির্মমতা ও রাজ্যের আঁধারতীব্রতা সম্মন্ধে বেখবর।
হঠাৎ তিনজন জুনিয়র ‘আপু আপু’ করে রাস্তা আটকালো। একজন বলল, ‘আপু, তোমার জন্য একটা গিফট আছে।’
গিফটের কথা শুনে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হলো এদের অন্য কেউ পাঠাযইছে, কোনো ছাপড়ি বা খগেন। ছোট মানুষ, এরা তো এগুলো সম্পর্কে সচেতন না, জানেও না। ওদের একজন বলল হাত পাততে। হাত পাতলাম। আরেকজন জামার পকেট থেকে মুষ্ঠি পুড়ে কিছু একটা আমার হাতে রাখল। গিফট আমার হাতে দিয়ে তার হাত সরাতেই দেখলাম একটা টিকটিকি। মুহূর্তেই কেন যেন ব্রেইন সংকেত পাঠাল, ‘চিক্কুর দে!’ আমিও সাতপাঁচ না ভেবে চিক্কুর দিলাম। ওরা তিনজন হেসে কুটি কুটি। রাবারের টিকটিকি ছিল ওইটা!
স্কুল বাসে উঠে বুঝলাম পিচ্চি তিনটা আরও কয়েকজনের সাথেও এমন প্রাঙ্ক করেছে। জানালার পাশে বসে মনে হলো- অদৃশ্য জগতের কেউ একজন বলছে, ‘তুই টিকটিকি দেখে ভয় পেতে চাইছিলি। নে, আল্লাহ তোর ইচ্ছা পূরণ করে দিল, হি হি হি!’
[ষোলো ৬ষ্ঠ (মে-জুলাই ২০২৪) সংখ্যায় প্রকাশিত]