আমি ছোট থেকেই খুব আবেগী। কারও ওপর রেগে গেলে নিজেই কান্না করি। আবার আমার সাথে কেউ একটু খারাপ ব্যবহার করলেও সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকি। আমার মন খারাপের সময় রুবি আমার সাথে থাকে। ও আমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী। আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় ছয় বছরের।
হাই স্কুল পার করে আমরা এক প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হলাম। আমি আর রুবি একই বেঞ্চে বসতাম প্রত্যেকদিন। প্রথম দিনই আমাদের কেমিস্ট্রি টিচার এসে বলে দেন, এক বেঞ্চে তিন জন বসতে হবে। এরপর থেকে বেঞ্চের মাঝে আমি, আমার ডান পাশে রুবি আর বামে বসত সুমি। সুমি আমাদের কলেজের নতুন বান্ধবী।
আমরা একসাথে কলেজে আসতাম, যেতাম। টিফিন শেয়ার করতাম, গ্রুপ স্টাডি করতাম। কলেজ লাইফটাতে একসাথে অনেক মজা করেছি।
পড়াশোনা ভালোই চলছিল। জুন মাসের শেষে কলেজে বেতন দেওয়ার ডেট। আব্বুকে বেতনের কথা বললাম। আব্বু কিছু না বলেই চলে গেল। পড়ে আম্মু আমার ঘরে এসে বলল, ‘তোর আব্বুর অফিসে কী নিয়ে যেন ঝামেলা চলছে। এই মাসের বেতনটা দেরিতে হবে। তুই তোর কলেজের স্যারদের সাথে একটু কথা বলে দেখ তো, ম্যানেজ করতে পারিস কি না।’ আমাকে সরাসরি বলতে হয়তো আব্বু অস্বস্তিবোধ করছিল, তাই আম্মুকে দিয়েই বলাল। আমিও আম্মুকে বললাম আব্বুকে বলতে, যেন টেনশন না করে।
পরদিন কলেজে গিয়ে রুবির থেকে কিছু টাকা ধার চাইলাম। ও বলল, এই মাসে ওরা ঘুরতে যাবে। তাই আমাকে এখন টাকা দিতে পারবে না। সুমি আমার কথা শুনে বলল, ও দিয়ে দেবে। আমি সুমির থেকে টাকা নিয়ে ওই মাসের বেতন পরিশোধ করলাম।
রুবি তিন দিনের ট্যুর শেষ করার পর কলেজে আসলো। ক্লাস শুরু হতে এখনো দেরি। তাই ওর গল্প শুনতে বসলাম। ও কোথায় কোথায় ঘুরল।
ক্লাস শুরু হওয়ার পর খেয়াল করলাম, আমি কলম আনতে ভুলে গেছি। কালকেই নতুন কলম কিনলাম। কোথায় যে হারালাম! রুবি ওর একটা কলম এগিয়ে দিল। কয়েকটা ক্লাস শেষে টিফিনের সময় রুবি বলল, ঘুরাঘুরির জন্য ও অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমি যেন ওর অ্যাসাইনমেন্টগুলো করে দিই। আমাকে কাগজ দেবে এমন সময় সুমি বলল, ‘সামনে তো পরীক্ষা। সাদিকা এতগুলো করতে গেলে ওর তো পড়াই হবে না।’ আমি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে রুবির থেকে কাগজগুলো নিয়ে নিলাম। রুবি একটা ক্লাস না করেই চলে গেল। রুবি যেতেই সুমি আমার মাথায় জোরে একটা গাট্টা মেরে বলল—
: এই গাধি, তুই ওকে হেল্প করতে গেলি কেন?
: ও যে আমাকে তখন ক্লাসে কলম দিয়ে হেল্প করল।
: ওর ওই ছোট্ট হেল্পের কথা তোর মনে আছে, আর ও যে তোকে বিপদে দেখেও ঘুরতে চলে গেল সেইটা তোর মনে নেই?
: তাহলে শোন, তোকে একটা গল্প বলি।
দুই বন্ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে হাঁটছিল। কিছুক্ষণ পর তাদের মধ্যে ঝগড়া লাগল। এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে চড় মেরে বসল। চড় খাওয়া বন্ধু কিছু না বলে পাশে থাকা বালিতে লিখল, ‘আজ আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমাকে চড় মেরেছে।’
এরপর ওরা আবার হাঁটতে থাকল। হাঁটতে হাঁটতে যে বন্ধু চড় খেয়েছিল সে হঠাৎ চোরাবালিতে পড়ে গেল। কিন্তু তার বন্ধু তাকে বাঁচিয়ে দিল। চোরাবালি থেকে উঠে আসার পর সে একটা পাথরে লিখল, ‘আজ আমার সেরা বন্ধু আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’
যে বন্ধু চড় মেরেছিল আর তাকে বাঁচিয়েছিল, সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি তোমাকে আঘাত করার পর তুমি বালিতে লিখেছিলে। আর এখন পাথরে লিখছ কেন?’
অপর বন্ধু উত্তর দিল, ‘যখন কেউ আমাদের আঘাত করে তখন আমাদের তা বালিতে লিখে রাখা উচিত। ক্ষমার বাতাস যেন এটিকে মুছে ফেলতে পারে। কিন্তু যখন কেউ আমাদের উপকার করে, তখন আমাদের অবশ্যই তা পাথরে খোদাই করে রাখা উচিত। যেন কোনো বাতাস তা মুছে ফেলতে না পারে।’
এবার বল, তুই কী বুঝলি?
বুঝলাম তো অনেক কিছুই রে। আসলেই, ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। মানুষ একেবারে নিখুঁত হতে পারে না। মন্দ বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে ভালো বিষয়গুলোকে মাথায় রাখা উচিত আমাদের।
‘লোকেদের প্রতি কোমলতা করবে, কঠোরতা করবে না; তাদের সুখবর দেবে, ঘৃণা সৃষ্টি করবে না। পরস্পর একমত হবে, মতভেদ করবে না।’[1]
[1] বুখারি, আস-সহীহ, হাদীস নং : ৩০৩৮।