অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে টাকার পেছনে জীবনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করে থাকে। নিজেদের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে। ব্যস্ততার কারণে তারা না পারে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে, না পারে কাঙ্ক্ষিত জীবনযাপন করতে। শুধু টাকার জন্য দিনের পর দিন তাদের এমন সব কাজ করতে হয় যেখানে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাদের এই কষ্টের একটাই লক্ষ্য- অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই লক্ষ্য আজীবন তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে যায়। সত্যিকারের অর্থনৈতিক মুক্তি কখনোই হাতের নাগালে আসে না। কেন এমন হয়? কেন গরিব আরও গরিব হয়, ধনী আরও ধনী হয়, মধ্যবিত্ত সারাজীবন সংগ্রাম করেই যায়?

তোমরা হয়তো দেখেছ অনেক অশিক্ষিত মানুষ প্রচুর টাকাপয়সার মালিক। অনেকেই অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন প্রচলিত অর্থে বিশেষ শিক্ষিত না হয়েই। অথচ তাদের প্রতিষ্ঠানে উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত কর্মচারীরা অল্প বেতনের চাকরি করে থাকেন। এটা কি শুধুমাত্র ভাগ্য? পার্থক্যটা কোথায়? আসলে এই মানুষগুলো একাডেমিক ডিগ্রি থাকলেও তারা আর্থিক শিক্ষার দিক দিয়ে নিরক্ষর (Financially illiterate) । অপরদিকে আমি যে তথাকথিত অশিক্ষিত মালিকের কথা বলছি তার একাডেমিক ডিগ্রি না থাকলেও আর্থিক শিক্ষার দিক বিবেচনায় শিক্ষিত (Financially literate) ।

পরিবার এবং স্কুল থেকে আমাদের শেখানো হয়- ভালো করে পড়াশোনা করো, ফার্স্ট হও, তাহলে ভালো কোম্পানিতে চাকরি করতে পারবে। অপরদিকে বিত্তবানদের কথাগুলো এমন - ভালো করে পড়াশোনা করো যাতে ভালো কোম্পানির মালিক হতে পারো। অর্থনৈতিক বিষয়ে মধ্যবিত্ত ও গরিবদের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় ধনীদের দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। "অর্থই অনর্থের মূল" এরকম আজগুবি কথা আমাদের পড়ানো হয়। অথচ টাকা-পয়সা হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের ক্ষমতা বা পাওয়ার। আমাদের শুধু জানতে হবে কীভাবে এই পাওয়ার ব্যবহার করতে হয়।

আমরা বিশ্বাস করি, কঠোর পরিশ্রম করে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করা সম্ভব। আসলেই কি তাই? একজন দিনমজুর কিংবা রিকশাচালক প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন। তারা কি এই পরিশ্রম দিয়ে আসলেই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন? আমি বলছি না পরিশ্রম ছাড়াই সফল হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের জানতে হবে কীভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিশ্রম করে আমরা সঠিক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে পারি।

আমাদের ঘাটতি কোথায়? আমরা কীসে মনোযোগ দেব? প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। এই বিষয়গুলো নিয়ে এটি একটি ধারাবাহিক লেখা হবে।

শিক্ষা

স্কুল-কলেজে আমরা যে পড়াশোনা করি সেটি আমাদের কেবল এক ধরনের প্রয়োজন পূরণ করে। আমাদের বাস্তব জীবনে এর বাইরে বহুগুণ পড়াশোনার প্রয়োজন। সাধারণভাবে বললে আমাদের চার ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন:

১) ইসলামি শিক্ষা (Islamic Education): ইসলামি শিক্ষা কেন দরকার আশা করি আমরা সবাই জানি। আমি শুধু একটি পয়েন্ট বলব। আমাদের চূড়ান্ত কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হচ্ছে জান্নাত। যেহেতু এটি একটি অবধারিত গন্তব্য এবং এর কোনো বিকল্প হতে পারে না, কাজেই এখানে সফল হতে হলে আমাদের সঠিক শিক্ষাপদ্ধতি জানতে হবে এবং সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে।

২) একাডেমিক শিক্ষা (Academic Education): প্রচলিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য আমাদের একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। আমরা স্কুল-কলেজে ভর্তি হই একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য। উচ্চতর বিশেষায়িত ডিগ্রির জন্য এই শিক্ষা আবশ্যক। বাস্তব জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ কম থাকলেও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এই শিক্ষা গ্রহণ না করলে বেশ সমস্যার মুখে পড়তে হয়।

৩) কারিগরি শিক্ষা (Technical Education): কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করতে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। যেমন: কেউ যদি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় তাকে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ জানতে হবে। বর্তমানে প্রায় সব ধরনের ক্যারিয়ারে ভালো করতে প্রয়োজন ইংরেজি শিক্ষা। সময়ের সদ্বব্যবহার (টাইম ম্যানেজমেন্ট), যোগাযোগ দক্ষতা (কম্যুনিকেশন স্কিল), পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিষয়গুলোও কারিগরি শিক্ষার মধ্যেই পড়ে।

৪) অর্থনৈতিক শিক্ষা (Financial Education): এই শিক্ষাগ্রহণের কথা বেশিরভাগ মানুষই জানে না। কম সময়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে প্রয়োজন সঠিক অর্থনৈতিক শিক্ষা। এই শিক্ষার অভাবে সাধারণ মানুষ সারাজীবন অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করে।

এর বাইরেও সাধারণ জ্ঞান, সামসময়িক বিষয়াবলি, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয় জানার প্রয়োজন হতে পারে আমাদের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এগুলোকে আমি টেকনিক্যাল ক্যাটাগরিতে রাখছি। তবে নিছক বিনোদনের জন্য যেমন কৌতুক, শোবিজ তারকাদের ঘটনা, অপ্রয়োজনীয় ফেসবুক স্ট্যাটাস ইত্যাদিকে আমি কোনো পড়াশোনার আওতাভুক্ত ধরছি না।

কেন অর্থনৈতিক শিক্ষা দরকার?

তোমরা হয়তো ভাবছ, আমরা তো এখনো ছেলেমানুষ। বড়দের এইসব কথাগুলো কেন তোমাদের বলছি। দুটি কারণ বলি:

প্রথমত, আমি ধরে নিচ্ছি তোমরা সবাই প্রাপ্তবয়ষ্ক। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পর বাবা-মা বাধ্য নয় সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে (ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। তার মানে তারা তোমাদের পড়াশোনার খরচ বহন করছে এটি তোমাদের জন্য একটি বিশেষ অনুগ্রহ। এটি তোমাদের হক নয়। কাজেই তোমাদের কি উচিত না খুব দ্রুত স্বাবলম্বী হওয়া?

দ্বিতীয়ত, তোমরা যখন একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে তখন শুরু হবে টাকা উপার্জনের এক নতুন জীবনযুদ্ধ। যেহেতু টাকাই এখানে মুখ্য, কাজেই আমাদের জানা উচিৎ কীভাবে টাকা ম্যানেজ করতে হয়। আমরা টাকার পেছনে দৌড়াব না, টাকা যাতে আমাদের পেছনে দৌড়ায় এই দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এজন্যই দরকার হচ্ছে অর্থনৈতিক শিক্ষা।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এরকম একটি বাস্তব সত্য আমরা সবাই লুকিয়ে যাই। আমাদের পরিবার, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি কোথাও এই ব্যাপারে আমাদের কিছুই শেখানো হয় না। এই বিষয়ে খুব সহজভাবে কিছু কথা বলব। আশা করি অর্থনৈতিক ব্যাপারে তোমাদের ধারণা পরিবর্তন হবে, ইনশাআল্লাহ। 

টাকা-পয়সা বিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা

অনেক মানুষ অনেক টাকা উপার্জন করেও গরিব। কারণ, তারা যেমন আয় করে, ঠিক তেমনি খরচ করে। দিনশেষে তাদের কাছে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কাজেই কেউ যদি বেশি টাকা বেতন পায় তাহলে আসলে সেটায় লাভ নেই। কতটা উপার্জন করছে এটা বড় ব্যাপার নয়, কত ধরে রাখতে পারছে এটাই আসল। কেউ যদি হঠাৎ অনেক টাকার মালিক হয়ে যায়, তবুও লাভ নেই যদি সে না জানে কীভাবে এই টাকার সঠিক ব্যবহার করতে হয়। অনেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক টাকার মালিক হয়েও কিছুদিন পরে আবার গরিব হয়ে যায়।

মধ্যবিত্তরা টাকা সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে তারা টিভি কিনে, এসি কিনে, ভালো ফ্ল্যাট ভাড়া করে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। এতে তাদের খরচ বাড়ে, কিন্তু আয় সেই তুলনায় বাড়ে না। স্ট্যাটাস ধরে রাখতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা সবসময় একটা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায়।

অনেকে হারাম কাজ করে। সুদের ওপর লোন করে ফ্ল্যাট কিনে, গাড়ি কিনে। তারা ভাবে, কিস্তিতে আমরা ব্যাংক লোন পরিশোধ করে দিলে এগুলো অ্যাসেট (asset-সম্পদ) হিসেবে থেকে যাবে। বিপদের সময় কাজে লাগবে। এগুলো কি আসলেই তাদের সম্পদ? তোমরা যদি ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট দেখো তাহলে দেখবে এইগুলো ব্যাংকের অ্যাসেট (asset)। তার মানে এইগুলো তাদের দেনা (liability)। এই দেনা বাড়ার কারণে তারা আসলে আরও গরিব হচ্ছে যা তারা বুঝতেই পারছে না! সেই সাথে সুদের মতো গর্হিত হারাম কাজে জড়ানোর ব্যাপারটি তো আছেই। আমাদের কাজ হচ্ছে অ্যাসেট (asset) বাড়ানো সেইসাথে লায়াবিলিটি (liability) বা দেনা কমিয়ে রাখা। এটাই রুল নাম্বার ওয়ান বা এক নম্বর নিয়ম। পরবর্তী পর্বে আমরা এই বিষয়ে কথা বলব, ইনশাআল্লাহ।