নিষ্পাপ শৈশবের পরপরই আসে দুরন্ত কৈশোর। চারপাশের সবকিছু তখন অন্য রকম লাগে! কিছুদিন আগেও যে জিনিসটার প্রতি কোনো আকর্ষণই কাজ করত না, এ সময়ে তা যেন চাঁদনী রাতের জোছনার মতো ভালো লাগা শুরু করে। আবার কিছু ব্যাপার বড্ড বেশি বিরক্তিকর লাগে।

বয়ঃসন্ধির এই সময়টাতে তোমাদের নিজেদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখতে পাবে। কিউট মিষ্টি কণ্ঠের ছেলের গলাটা হঠাৎ করেই কেমন বেসুরো হয়ে যাবে। কথা বললে ভাঙ্গা বাঁশির মতো আওয়াজ করবে। মসৃণ গালে দাড়ি-গোঁফ উঁকি মারবে। সাথে ঘটবে কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন। 

শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের মধ্যে যে ব্যাপারটাতে অনেকেই ঘাবড়ে যায় তা হলো Wet Dream বা স্বপ্নদোষ। ঘুমের মধ্যে লিঙ্গ থেকে আঠোলো জাতীয় একটা পদার্থ বের হওয়াকে স্বপ্নদোষ বলা হয়। কিন্তু এটা কোনো ‘দোষ’ নয়। যাহোক, প্রথম প্রথম স্বপ্নদোষ হতে দেখে অনেকেই ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না। দুষ্টু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে স্বপ্নদোষ নিয়ে তখন অনেক উলটা পালটা জ্ঞান অর্জন হয়, যেসবের অধিকাংশই সত্য থেকে লক্ষ-কোটি ক্রোশ দূরে। এবং অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার অভিভাবকেরাও লজ্জার কারণে তোমাদের সাথে এগুলো নিয়ে আলাপ করতে পারেন না। তাই, আজকে আমরা স্বপ্নদোষ নিয়ে কিছু প্রাথমিক ব্যাপার-স্যাপার জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ!

▪️ স্বপ্নদোষ কি কোনো রোগ?

- এটা কোনো রোগ বা পাপ নয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিষয়। একদমই ক্ষতিকর কিছু নয়। আল্লাহ আমাদের শরীরে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এটি দিয়েছেন। আমাদের ভালোর জন্যেই। এটার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তুমি সাবালকে পরিণত হয়েছ।

▪️ তাহলে কারও মাসে দু/একবার, কারও প্রতিদিন একবার, আবার কারও বছরে একবার কেন হয়?

- সবার শারীরিক ক্রিয়া একরকম নয়। একেক জনের একেক রকম। যেমন, কেউ বরফ চিবিয়ে খেয়ে ফেলে, আবার কেউ ঠান্ডা পানি খেলেই টনসিল ফুলে যায়! এ কারণেই কারও বছরে একবার, কারও দৈনিক একবার করে স্বপ্নদোষ হলেও ব্যাপারটা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ‘নরমাল’।

▪️ আমার কখনোই স্বপ্নদোষ হয়নি/আমার একেবারেই স্বপ্নদোষ হয় না। এটা কেন?

- স্বপ্নদোষ হওয়া যেমন স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, তেমনি না-হওয়াও একদমই স্বাভাবিক বিষয়। 

স্বাভাবিক অবস্থায় একজনের দেহে প্রতি সেকেন্ডে ১১ হাজার শুক্রাণু তৈরি হয়। এতে থাকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। সাধারণ অবস্থায় দরকারি উপাদানগুলো শরীর শোষণ করে নেয়। অবশিষ্ট অংশ ফ্যাগোসাইটোসিস (Phagocytosis) প্রক্রিয়ায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এরপরও যা বাকি থাকে তা স্বপ্ন দেখে বা স্বপ্ন দেখা ছাড়াই বের হয়ে আসে।

কারও যদি এ উপাদানগুলো শরীরে শোষিত হওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ ফ্যাগোসাইটোসিস (Phagocytosis) প্রক্রিয়ায় ব্যালেন্স হয়ে যায়, তাহলে তার আর স্বপ্নদোষ হবে না।

সুতরাং, কারও প্রতিদিন স্বপ্নদোষ হওয়া যেমন তার জন্য স্বাভাবিক, তেমনি কারও কখনোই স্বপ্নদোষ না-হওয়াও নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক।

▪️ আগে তো এমন ছিল না! এখন এত ঘন ঘন হয় কেন? / এখন আর হয় না কেন?

- শোনো, আমাদের দেহ এক বিশাল সুপার কম্পিউটারের চেয়েও বেশি সিস্টেম দিয়ে প্রোগ্রাম করা। দেহে প্রতিনিয়ত অনেক জৈব রাসায়নিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে। এসবের সাথে নিবিড় সম্পর্ক আমাদের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশের। এসবের কোনোটার পরিবর্তনের ফলে দেহে কিছুটা পরিবর্তন আসে। এখন নিজ নিয়মেই এটা আবার ক্রমান্বয়ে আগের মতো হয়ে যেতে পারে বা এর কমবেশি করে বা একই রকম থেকে ‘সেট’ হয়ে যেতে পারে! এই পরিবর্তনটাও শারীরবৃত্তীয়।

▪️ কিন্তু, আমার যে ক্ষতি হচ্ছে? শরীর ভেঙে যাচ্ছে। আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি!

- সত্যি কথা বলতে; গা ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল দুর্বল লাগা, কিছু মনে থাকে না, পড়ায় মন বসে না ইত্যাদি সমস্যাগুলো স্বপ্নদোষের জন্য নয়। স্বপ্নদোষকে ‘দোষ’ মনে করার জন্য। মানে ‘মানসিক’ যে বোঝা তুমি বয়ে বেড়াচ্ছ, তা-ই তোমার শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। তবে হ্যাঁ, যদি অশ্লীল ভিডিও দেখা বা অন্য বাজে অভ্যাসগুলো ছাড়া কেবল ‘স্বপ্নদোষ’ হতে হতে শরীরের ওজন কমে যায়, গাল-চাপা ভেঙে যায়, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, দৃষ্টি ঝাপসা হয়, তবে তা স্বপ্নদোষের জন্য না। অন্য কোনো রোগের জন্য। এক্ষেত্রে তোমার  চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।

আর যদি উপরোক্ত বাজে অভ্যাস থেকে থাকে, তাহলে তো বুঝতেই পারছ! আগে এসব একদম বাদ দিতে হবে। বাদ মানে পুরোপুরি বাদ। আর একবারও করা যাবে না। এরপর শরীরের নিজস্ব পদ্ধতিতে ঠিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্যের বিকল্প নেই। বহুদিনের ক্ষয় রাতারাতি পূরণ হয় না। মনে রাখবে—একদিনে সব হয় না, তবে একদিন সব হবে।

▪ স্বপ্নদোষ হলে কি গুনাহ হবে?

- না। তবে তুমি এ অবস্থায় অপবিত্র হয়ে যাবে। পরিপূর্ণভাবে গোসল (যেটাকে আমরা ফরয গোসল বলে থাকি) না-করলে তোমার সালাত আদায় হবে না।

▪️ বুঝলাম ভাই, এটা রোগ না, তাই চিকিৎসাও নাই। কিন্তু মন তো মানে না! এটা কমানোর উপায় বলেন!

- হ্যাঁ, এটা রোগ না। কিন্তু ‘শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন’! আর এর চিকিৎসা আছে। মনে রাখবে, চিকিৎসা মানেই ‘ঔষধ’ নয়। অনেক সময় কিছু উপদেশও চিকিৎসার অংশ!

তোমার চিকিৎসা ৪ টা—

১. মানসিক ও শারীরিক স্থিরতা আনো :

- এটাকে রোগ/পাপ/খারাপ কিছু ভাবা বাদ দাও। মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকো।

- যেকোনো অশ্লীল চিন্তা পরিহার করো।

- দেহ মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত হয়, এমন কাজ করবে না।

- ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করো (খালি হাতে সাধারণ শরীরচর্চা) করো। যেমন- হাঁটা, দৌড়ানো (জগিং), বুকডন (পুশআপ), দঁড়ি খেলা, সাঁতার, স্কোয়াটিং, মাউন্টেইন ক্লাইম্বার, প্লাংক এসব। নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী। এগুলোর কিছু নিয়ম কানুন আছে। এগুলো পাবে ষোলোর দ্বিতীয় সংখ্যার এই লেখায়—

ছাত্রজীবন সুখের জীবন

ঘাম ঝরানোর দিনে

২. লাইফ স্টাইল বদলাও :

- টাইট পোশাক পরবে না। ঢিলে-ঢালা জামা পরবে।

- রাতে ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘণ্টা আগে খাওয়া ও পানি পান শেষ করবে।

- ঘুমানোর আগে ভালোভাবে প্রস্রাব করে ওযু করে ঘুমাবে।

- রাত জাগবে না। উপুড় হয়ে ঘুমাবে না। কোলবালিশ ব্যবহার করবে না। ভোরে উঠে যাবে। একবার ঘুম ভাঙার পর ‘গড়াগড়ি’ করা একদম নিষেধ।

- স্বপ্নদোষ হয়ে গেলে ভুলেও অশ্লীল চিন্তা করবে না। দ্রুত বিছানা ছেড়ে গোসল করে নেবে। মন খারাপ করে শুয়ে-বসে থাকবে না।

যেদিন স্বপ্নদোষ হবে সেদিন একটু সতর্ক থাকবে। বিছানা থেকে দূরে থাকবে যতটুকু পারো, একাকী অলস সময় কাটাবে না একদম। প্রয়োজনে বাহিরে ঘোরাঘুরি করবে, খেলাধুলা করবে। ভালো বন্ধু, বাবা-মা, ভাইবোনদের সাথে সময় কাটাবে।

- গোসল করার সময়েও সম্পূর্ণ উলঙ্গ হবে না। বিশেষ করে লজ্জাস্থান ধোয়ার সময় খুব সাবধান থাকবে।

৩. পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ক্ষয়পুরণ করে ফেলো :

-  দুর্বল লাগলে সামর্থ্য অনুসারে ডাল, দুধ, ডিম ও মাংস খাবে।

- কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে গুরুপাক খাবার, তেল-চর্বি, ভাজাপোড়া বাদ দিবে। পেপেসহ অন্যান্য ফল ও শাকসবজি বেশি করে খাবে।

- কালোজিরা, মধু, খেজুর, ভেজা ছোলা, কিশমিশ, বাদাম নিয়ম করে খাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ১ চা চামচ বা আরেকটু কম কালোজিরা খেয়ে পানি খেয়ে নিলে। একমুঠো বাদাম খেলে বা কয়েকটি খেজুর হলে। এগুলো স্বপ্নদোষ না-হলেও নিয়মিত খাওয়া উচিত। ফাস্ট ফুড, ভাজাপোড়া, চিপস বা কোমল পানীয় খেয়ে তুমি অনেক টাকা নষ্ট করো। সেই সাথে শরীরেরও অনেক ক্ষতি করো।   এগুলো না-খেয়ে পুষ্টিকর খাবার খাও।

- পর্যাপ্ত পানি পান করবে। ইসুবগুলের ভূষি খাবে।

৪. বিশ্বাসের সাথে আমল করো :

- ঘুমের আগে আয়াতুল কুরসি, সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস তিনবার করে পড়ে শরীর মাসাহ করা, ঘুমানোর দুআ ও অন্যান্য যিকর-আযকারগুলো করে হৃদয়টাকে ঠান্ডা করো। এগুলো অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখে। হিসনুল মুসলিম বই বা অ্যাপ থেকে ঘুমানোর আমলগুলো জেনে নাও।

- বাথরুম, গোসলখানায় প্রবেশের আগে ও বের হয়ে মাসনূন দুআ পড়বে।

اللهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبَائِثِ

অর্থ : হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই অনিষ্টকারী নর ও নারী জিন-শয়তান থেকে।[1]

اَلْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ أَذْهَبَ عَنِّي الأَذٰى وَعَافَانِيْ.

অর্থ : সমস্ত প্রশংসা ওই আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি আমার শরীর থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূর করে দিয়েছেন এবং আমাকে স্বস্তি দান করেছেন।[2]

- ডান কাত হয়ে শোবে।

- আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো।

আরেকটি কথা, রমাদান মাসে স্বপ্নদোষ কারও কারও ক্ষেত্রে একটু বেশি হয়। এটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। আর স্বপ্নদোষ হলে সাওম ভাঙ্গে না। তো প্রিয় ভাই, স্বপ্নদোষ স্বাভাবিক ব্যাপার। ভয় পাবে না। দুশ্চিন্তা করবে না।


[1] বুখারি, ১৪২; মুসলিম, ৩৭৫।

[2] নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, ৯৮২৫; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, ২২।