১৯৬২ সালের কথা। তানজানিয়ার (তৎকালীন তাংগানাইকা) এক ছোট্ট, শান্ত গ্রাম। জীবন এখানে গড়পড়তা ধীর-স্থির। হঠাৎ একদিন ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। মেয়েদের স্কুলে কয়েকজন ছাত্রী হাঁসিতে ফেটে পড়ল। কোনোভাবেই যেন তারা হাসি বন্ধ করতে পারছিল না। প্রথমে মনে হয়েছিল তারা স্রেফ মজা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুতই ভয়াবহ রূপ নেয়।
হাসির মহামারিতে তোমাকে স্বাগত। যখন হাসি আনন্দের উৎস থেকে রীতিমত মহামারিতে রূপান্তরিত হয়েছিল!১
হাসির সূত্রপাত
গ্রামের নাম কাশাশা। ছোট্ট এই গ্রামের বোর্ডিং স্কুলের কয়েকজন ছাত্রী একদিন হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। মজার বিষয় হলো এই হাসি কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ধীরে ধীরে অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। একের পর এক
সবাই সংক্রমিত হতে লাগল অপ্রতিরোধ্য হাসির রোগে! এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৯৫ জন শিক্ষার্থী এতে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। পুরো ক্লাসরুম যেন হাসির ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছিল!
ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাসির এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামগুলোতে। গ্রামবাসী বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল—কী হচ্ছে? এটা কি কোনো নতুন ট্রেন্ড? নাকি কোনো গোপন সংকেত? পরিস্থিতি যেন কোনো কমেডি মুভির
দৃশ্য, পরিস্থিতি যাই হোক চরিত্ররা কোনোভাবেই যেন হাসি থামাতে পারে না।
প্রথম ধাক্কা
এই হাসির মহামারি স্কুলের বাইরে এসে পুরো গ্রামকে গ্রাস করে ফেলল। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই এতে জড়িয়ে পড়ল। বিষয়টি তখন আর একদল মেয়ের হাসির ঘটনা থাকল না, এটি তানজানিয়ায় এক মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হলো! প্রায় ১০০০ মানুষ এতে আক্রান্ত হয়ে পড়ল।২ দেখা গেল, কেউ এখন দৈনন্দিন কাজ করছে, পরমুহূর্তেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আর হাসি একবার শুরু হলে তা কোনোভাবেই থামাতে পারছে না। এমনকি সর্বদা সবাইকে চুপচাপ থাকতে তাগাদা দেওয়া বয়স্ক লোকটাও হেসে উঠছেন। এত হাসছেন যে, তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে! আক্রান্তদের সারাদেহে র্যাশ উঠে যাচ্ছিল, হাসতে হাসতেই কেউ কেউ প্রচণ্ড কান্না জুড়ে দিচ্ছিল। অনেকে তো হাসতে হাসতে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছিল।৩
এত হাসি কোথায় পেলে?
ডাক্তাররা পুরোপুরি হতবাক। এটা কি কোনো রোগ? মানসিক সমস্যার লক্ষণ? নাকি কেবল অতিরিক্ত আনন্দের বহিঃপ্রকাশ? এর কারণ খুঁজতে গবেষকরা নানান তত্ত্ব দিচ্ছিলেন—কেউ বলছিলেন এটা ‘মাস হিস্টিরিয়া[1]’, কেউবা যোগ ব্যায়ামের সাথে তুলনা করে একে “লাফটার ইয়োগা” বলছিলেন।
কারও কারও মতে, এটা মানসিক চাপ, বয়োঃসন্ধিকালীন হরমোন এবং প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের গাম্ভীর্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মিশেল হতে পারে। আবার কেউ ভাবলেন, গ্রামবাসী হয়তো আসলেই খুব রসিক! কারণ যাই হোক, হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল, আর থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না।
বিজ্ঞান বনাম হাসি
ডাক্তার ও মনোবিজ্ঞানীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন। তারা হাসির ধরন, সময়কাল সবকিছু টুকে রাখলেন। একজন মনোবিজ্ঞানীর ভাষ্যমতে, হতে পারে গ্রামবাসী কোনো মজ্জাগত সামাজিক চাপ মোকাবিলা করছে, আর এই মহামারি তারই বহিঃপ্রকাশ। ক্রিশ্চিয়ান হেম্পেলম্যান বলেন, তানজানিয়ার স্বাধীনতার পর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বাবা-মা ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা অত্যধিক বেড়ে যায়। এই চাপ বা স্ট্রেসের কারণে এমনটা হতে পারে।৪
সমাজবিজ্ঞানী বার্থোলোমিও এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাইমন ওয়েসলি একটি তত্ত্ব উত্থাপন করেন। তারা দেখেন ষাটের দশকে মিশনারি স্কুলগুলোতে এমন হচ্ছে। তারা বলেন, এক ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে মানুষ এমনটা করেছিল।৫
কোয়ারেন্টাইন
শেষমেশ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হাসির মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর গ্রামবাসীকে বলা হয় হাসি সংযত রাখতে।
কিছুদিনের মধ্যে হাসির প্রকোপ কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হলো না। অবশেষে, প্রায় এক বছর পর হাসির মহামারি শান্ত হয়ে আসে। গ্রামীণ জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তবে এই অদ্ভুত ঘটনা কেউ ভুলেনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক কিংবদন্তি হয়ে রয়ে গিয়েছে।
[ষোলো ৮ম সংখ্যায় (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রকাশিত]
Reference:
১- The Tanganyika laughter epidemic of 1962: Around 1,000 people were hysterically laughing for one year - https://tinyurl.com/yetd3mwa
২- The 1962 Laughter Epidemic of Tanganyika Was No Joke - https://tinyurl.com/335wha8s
৩- Tanganyika laughter epidemic - https://tinyurl.com/y75a2fmr
৪- Hempelmann, Christian F. (2007). "The Epic Tanganyika Laughter Epidemic Revisited". Humor: International Journal of Humor Research. 20 (1): 49–71
৫- Radiolab (25 February 2008)
[1] হিস্টিরিয়া শারীরিক নয়, মানসিক রোগের লক্ষণ। মস্তিষ্কের ওপর খুব চাপ পড়ে, যেটি মস্তিষ্ক নিতে পারে না। এর মধ্যে আতঙ্ক, ভয় এগুলোও কাজ করে।