জুলাই ২০২৪।

কোটা আন্দোলন বদলে গেল সরকার পতনের আন্দোলনে। তবে তার জন্য প্রথমে দিতে হয়েছে আবু সাঈদ নামক তাজা প্রাণের কুরবানি। আল্লাহ তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন। মনে আছে সেই আবু সাঈদের কথা? তার অসীম সাহস, তার অবিচলতা, তার সংগ্রাম আমাদের অবাক করে দেয় বারবার। যতবার ভাবি, ঠিক ততবারই অবাক হতে হয়। খুব কাছ থেকে পুলিশ পজিশন নিয়ে আছে তাকে গুলি করার জন্য। সে বুক পেতে রেখেছে, একা। একদমই একা। সঙ্গে কেউ ছিল না। যেন সে বলতে চাচ্ছিল—বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। হ্যাঁ, তার বুকে অসীম ঝড় ছিল। কিন্তু তা কীসের? ঝড় বয়ে চলছিল স্বৈরাচারী সরকারের জুলুম, ইসলামবিদ্বেষী শাসন এবং এক বিশেষ গোষ্ঠীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গেলে আমরা এখনও দেখতে পাই ইসলামের প্রতি তার অশেষ আনুগত্য এবং ভালোবাসা। ঠিক এই কারণেই তাকে ঘিরে সেই বিশেষ মহলের প্রচণ্ড ক্ষোভ; যা তার ফেসবুকের কমেন্টবক্সে গেলেই বোঝা যায়।

সেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সন্তান আবু সাঈদের রক্তের বিনিময়েই আজ আমরা ১৫ বছরের জুলুমের অবসান দেখতে পেলাম।

এবার আরেকটু পেছনে ফিরে যাই। ১৪ জুলাই ২০২৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিমউদদীন হলের ছেলেরা স্লোগান দিচ্ছে—’তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। এই স্লোগানের পর দেশ মূলত দুইভাগ হয়ে যায়। একদল লোক আন্দোলনের পক্ষে, আরেকদল আন্দোলনের বিপক্ষে।

জাফর ইকবালদের মতো সেকুলার ব্যক্তিরা[1] তখন সরাসরি আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেছিল। তেমনই প্রথম আলো পত্রিকার কলাম লেখক ও ‘কিশোর আলো’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক আনিসুল হক আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তার ফেসবুকে সে আফসোস করছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে। পরে অবশ্য সেসব পোস্ট ডিলিট করে দেয়। তো যাই হোক, যারা প্রগতিশীলতার কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এদের বিরাট একটা অংশ যে ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল, তা প্রকাশ হয়ে যায়।

এবার আন্দোলনের আরেকটু সামনে আগানো যাক। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর দেশে শুরু হলো গণ-আন্দোলন। যোগ দিল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ জনতা। ঢাকা অচল হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, যুবলীগ, ছাত্রলীগের গুলিতে একের পর এক লাশ পড়া শুরু হলো। প্রতিটা লাশ যেন ছাত্র-জনতাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে দিচ্ছিল। তারা একদিকে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর সামনে মাথা অবনত করে নামাজ পড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! তারা জানত, আল্লাহ ছাড়া কোনো আশ্রয়দাতা নেই, আল্লাহ ছাড়া কোনো রক্ষাকারী নেই৷ তারা জানত, জালিমদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ছাড়া তাদের আর কোনো সাহায্যকারী নেই। যারা এতদিন খুব বেশি ইসলাম প্র্যাকটিস করত না, তারাও ইসলামের ব্যাপারে আগের চেয়ে অগ্রসর হয়ে গেল। 

শহীদ আসহাবুল ইয়ামিনকে মনে আছে? অত্যন্ত ধার্মিক ছিল সে। শহীদ মুগ্ধ, যার নাম শুনলে আমাদের মাথায় ভেসে আসে ‘পানি লাগবে, পানি?’ কথাটা। সেই মুগ্ধের ব্যাপারে তার পরিবার বলেছিল, সে পরিবারের বাকিদের চেয়ে ইসলাম বেশি ধারণ করত।

শহীদ ওসমান পাটওয়ারীর কথা মনে আছে? তার কথা শুনলেই মনে উঠে সেই নাশিদটার কথা - ‘হারিয়ে যাব একদিন আমি, রবো না এ ভুবন চিরদিন’। সে একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম ছিল। সে সেক্যুলার ছিল না। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গেলেই তার চিন্তাভাবনা বোঝা যায়।

তামিরুল মিল্লাতের ছাত্র শহীদ আলিফের কথা তোমাদের মনে আছে? তার কথা শুনলেই মনে আসে সে  খুব মায়া নিয়ে গাচ্ছে আল্লামা ইকবালের মুসলিম উম্মাহকে জাগ্রত করার জন্য লেখা, ‘Khwab e Ghaflat me soye hue momino’ নাশিদটি।

মনে কি আছে সিলেট, নরসিংদী, চট্টগ্রামের কথা? রাস্তায় আযান হচ্ছে নামাজের জন্য। তারপর সম্মিলিতভাবে রাস্তায় জামাতে নামাজ আদায়। মানুষজন আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়ার জন্য একজন আরেকজনকে অনুপ্রাণিত করছে। তারা শহীদ হওয়ার জন্য রাস্তায় নামত, কারণ তারা জানে ইসলামে শহীদের মর্যাদা কত বেশি! যারা আন্দোলনে মাঠ পর্যায়ে ছিলেন, তারা এগুলোর স্বাক্ষী। 

জুলাই আন্দোলনে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রাউন্ডগুলোর একটি ছিল যাত্রাবাড়ী। অথচ এখানে কোনো বড় পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এখানের বেশিরভাগ মানুষই ছিল যাত্রাবাড়ীর আশেপাশে যত কওমী মাদরাসার ছাত্ররা আছে - তারা। আমরা একটা জরিপের কাজে ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। তারা আমাদের বলেছিল, তারা পাঞ্জাবি-জুব্বা খুলে ট্রাউজার, টি-শার্ট পরে আন্দোলনে নেমে গিয়েছিল। কারণ পাঞ্জাবি-জুব্বা পরিহিতদের দেখলে হাসিনার বাহিনী বেশি হিংস্র হতে পারে। যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে শহীদ হয়েছে ৭০ এর অধিক কওমী মাদরাসার ছাত্র। তারা খুব সাধারণ মুসলমান। তাদের রক্তে, তাদের চেতনায়, তাদের আবেগে ইসলাম মিশে আছে।

পুরো আন্দোলনেই আমরা ইসলাম দেখেছি। মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে ইসলাম, মানুষকে সাহস জুগিয়েছে ইসলাম।  ওয়ালে ওয়ালে গ্রাফিতি করতে দেখেছি - ‘For every Firaun, a Musa will be born’। মানুষজনের হাতে প্ল্যাকার্ড দেখেছি - ‘From Gaza to Dhaka, Long live Intifada’। মানুষের অনুপ্রেরণার জায়গায় মুসা নবী, মানুষের অনুপ্রেরণার জায়গায় ফিলিস্তিনের গাযা। এই ইতিহাস তো মিথ্যা না।

মসজিদের ইমামদের খুৎবাতে আওয়ামী জাহেলিয়্যাতের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আহ্বান করা হয়। তাদের অনেকেই সেটা করতে গিয়ে ইমামতির চাকরি হারিয়েছেন। তাদের এসব কুরবানির কথা আমরা ভুলে যাই কী করে? শেষদিকে যখন পুনরায় ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের আশঙ্কা হলো - তখন ঘোষণা আসলো, মসজিদ থেকে যেন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। অনেক মানুষ কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাস্তায় নামে, ঘরের মহিলাদের তাহাজ্জুদের আহ্বান করে। ধারণা করা হয়, ৫ আগস্টের আগের রাতে দেশে রেকর্ড পরিমাণ তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা হয়েছে। ঘরে ঘরে আল্লাহর কাছে দুআ-প্রার্থনা করা হয়েছে।

এটাই তো বাংলাদেশ। মুসলমানের বাংলাদেশ। এখানকার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের চিন্তা-চেতনা ও আবেগের নাম ইসলাম। এই আন্দোলনই তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। এই বিষয়টা বুঝতে পেরে অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তি ইসলামকে ব্যবহার করা শুরু করল। ফাহাম আব্দুস সালাম নামক একজন সেকুলার লেখক তার ইউটিউব চ্যানেলে সবাইকে মাঠে নামার জন্য আহ্বান করছিল। এবং সে বলে দিচ্ছিল, সবাই যেন ‘হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিমাল ওয়াকিল’ বলে রাস্তায় নামে। যার অর্থ হলো- আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক।’ তারপর দেখো, আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক রিফাত রশীদ। তিনি মানুষজনকে কালিমা পড়ে নামার জন্য বলেছিলেন। এসব কি মিথ্যা? না, এগুলো বাস্তবতা।

তারপর হাসিনার পতনের দিন মানুষজন গণভবন দখলে নিয়ে সবার আগে সেখানে গিয়ে বহু মানুষ নামাজ আদায় করল। বহু মানুষ সিজদাহতে পড়ে গেল। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল। কালিমার পতাকা নিয়ে মানুষ বিজয় মিছিল করল। এগুলোর প্রমাণ এখনো আছে অনলাইনে।

কিন্তু যখন শেখ হাসিনার পতন হলো, তখন এদেশের একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষেরা প্রচার করা শুরু করল - নতুন বাংলাদেশ নাকি সেক্যুলার বাংলাদেশ। আচ্ছা, আন্দোলনকারীরা কি এই 'সেক্যুলার' জিনিসটার জন্য রাস্তায় নেমেছিল? কীভাবে গুটিকয়েক লোক ইতিহাস পালটে দিচ্ছে! তারা এখন ইসলামকে বলছে সামাজিক ফ্যাসিবাদ। ঠিক হাসিনার মতো করেই ইসলাম পালন করাকে নাম দিচ্ছে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, উগ্রবাদ। অথচ এইগুলো ব্যবহার করেই শেখ হাসিনা আয়নাঘর, জেল, জুলুমের বৈধতা তৈরি করত। সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালিয়ানার নাম করে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি - যেসব ছিল শেখ হাসিনার স্বৈরাচার হয়ে ওঠার হাতিয়ার। হাসিনার পতন হলেও ক্ষমতার আশেপাশের মানুষজন সেই একই ধারায় এখনো কথা বলে যাচ্ছে। তারা আমাদের পাঠ্যবইয়ের মধ্যে এমন এমন জিনিস ঢুকানোর কথা বলছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে সবসময় আবু সাঈদ রাহিমাহুল্লাহ কথা বলে গিয়েছিলেন। আবু সাঈদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশে - আবু সাঈদের সাথেই তারা গাদ্দারি করছে। তাদের এই পল্টিবাজি আমাদের সামনে ইতিহাস হয়ে থাকবে।

অবশ্য এসব তো আর নতুন কিছু না। ইতিহাসে আমরা এই একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি বারবার দেখে এসেছি। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত আর পাকিস্তান ভাগ হয় - তখন তা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা সাধারণ মানুষকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্র উপহার দেওয়ার। দেশ চলবে আল্লাহর আইন দিয়ে। কিন্তু যখন পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করল, তখন তারা তাদের কথা আর রাখল না। দেশের আইনের উৎস বানানো হলো আল্লাহর বদলে মানুষকে। গঠন করা হলো সেক্যুলার রাষ্ট্র পাকিস্তান। 

১৯৭১ সালেও একই ধোঁকা খায় এই জমিনের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধে যখন সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন দেখা দিলো, তখন রেডিওতে জিহাদে নামার আহ্বান করা হলো, কুরআন থেকে জিহাদের ফজিলত বর্ণনা করা হলো। শহীদের মর্যাদা প্রচার করা হলো। এসবের প্রভাবে যখন সাধারণ মানুষ যুদ্ধে নেমে গেল এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জন করল, তখন জাতীয় নেতারা সাধারণ মানুষের পুরো বিপরীত মতাদর্শ দিয়ে রাষ্ট্র গঠন করল। স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ হিসেবে ঠিক করা হলো সেক্যুলারিজম এবং সমাজতন্ত্রকে। অর্থাৎ ৪৭, ৭১ কিংবা ২৪ - কোনোটাতেই সাধারণ মুসলিমদের স্বার্থ আদায় হয়নি। সাধারণ মুসলিমদের ব্যবহার করার পর দেশকে নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের আদর্শে গঠন করে সেক্যুলার নেতারা। ইতিহাস ফেরত আসে বারবার, এটা সত্য। তা থেকে শিক্ষা নিতে পারলে, তবেই উত্তরণ সম্ভব। নিজেদের অধিকার আদায় করে নেওয়া সম্ভব।


[1] সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতা এমন এক জীবন ব্যবস্থা, যার একমাত্র লক্ষ্য দুনিয়াকে দ্বীনের প্রভাব মুক্ত করা। সেকুলারিজম একটি মতবাদ, তার কাজ হচ্ছে পার্থিব জগতের সকল বিষয়কে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ থেকে মুক্ত রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আদর্শিক ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার নিজের তৈরি বিধান দেওয়া ও সকল স্তরে নেতৃত্ব প্রদান করা। অর্থাৎ সেকুল্যারিজমে আল্লাহর দেওয়া আইনের বাইরে গিয়ে নিজেদের মনমতো আইন বানানো হয়। সে অনুসারে সব কিছু পরিচালনা করা হয়। সেকুলারিজমে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে সেকুলার বলে।