রমজান আলী মোহনপুর গ্রামের একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত। গ্রামের লোকজন তাকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানে। সবাই তাকে বেশ মান্যও করেন। তাই তো গ্রামের যাবতীয় বিচারকার্য তার দ্বারাই সম্পাদিত হয়ে থাকে। আগামীকাল তিনি যাবেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচার করতে। গ্রামের ছেলে মধু নাকি তার বিধবা মায়ের দেখভাল করে না। মধুর বউ সাফ সাফ মানা করে দিয়েছে বুড়িকে, আর একবেলা খাবারও সে দেবে না। আর মধুও বউয়ের তালে তাল মিলিয়ে বলে চলেছে, ‘মা যেন শহরে তার ছোট ছেলের কাছে চলে যায়। সে আর মাকে খাওয়াতে পড়াতে পারবে না।’ 

রমজান আলী দুপুরের খাবার-পর্ব সেড়ে ভাতঘুম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সকাল সকাল মধুর সাথে দেখা করে কিছু টাকার বিনিময়ে বিচারের রায়টা অবশ্য বিকিয়েই এসেছেন তিনি।

আবু মোহনপুর গ্রামের বিল্লাল মিয়ার ছেলে। বছর দুই আগে গ্রাম ছেড়ে চাকরির উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসেছিল সে। গ্রামে তার বিধবা মাকে ভাই আর ভাবির দায়িত্বে রেখে এসেছিল। তার ভাই মধু আজকে ফোন করে জানিয়েছে, মায়ের দেখভাল করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আগামীকাল গ্রামের লোকজন ডেকে তাই সালিশ বসিয়েছে। আবু যেন সময়মতো গ্রামে চলে যায়। ফোন রাখার পর আবু কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। তার ভাই মাস দুই আগে থেকেই বলে চলেছে, মাকে যেন তার কাছে এনে রাখে। আবু এখানে সব বন্দোবস্ত করেই মাকে আনতে যেত। কিন্তু এরই মধ্যে তার ভাই যে সালিশ ডেকে বসবে, সেটা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। সে আর দেরি না করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে গ্রামের পথে রওনা দিয়েছে।

ঠিক সকাল দশটায় মোহনপুর গ্রামের বটতলায় একটি সালিশ বসেছে। সালিশের প্রধান স্বয়ং রমজান আলী। মধু আর তার বউ একে একে তার মায়ের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ পেশ করেছে। সালিশের এক কোণায় মুখে আঁচল গুঁজে বসে আছেন মধু আর আবুর মা ফাতেমা বানু। তার পাশেই ছোট ছেলে আবু নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। 

সবার অভিযোগ, মতামত পেশ করা শেষ। এবার রমজান আলী তার মতামত জানাবেন। মতামত জানানোর আগে রমজান আলী সবসময়ই কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, মধু দুইদিন আগে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়েছে তাকে। বিচারের রায়টা দু’তিন দিন পিছিয়ে দিলে গ্যাঁটে হয়তো আরও কিছু টাকা পড়লেও পড়তে পারে। আর আবু তো আজ সকালে কেবল গ্রামে ফিরল। তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে যদি কিছু আদায় করা যায়, তাহলে ক্ষতি কী! হঠাৎ আবু সবার মধ্য থেকে বলে উঠল, ‘এগুলা আপনে কী কইতাছেন, চাচা সাব? আপনে আমার ভাইয়ের থেইকা টাকা খাইছেন!’‌

রমজান আলী একথা শুনে একদম ভড়কে গেল। তার মনের কথা আবু জানল কী করে? তিনি এবার ঝেড়ে কাশলেন, ‘তোমার মাতা কি খারাপ হইছে, আবু মিয়া? কী কইতাছ, তা তুমি নিজে জানো তো?’

‘আপনে এহন কতা ঘুরাইতাছেন, চাচা সাব। আমি ইস্পষ্ট হুনছি আপনি কইলেন, মধু ভাই আপনারে হাজার পাঁচেক টাকা দিছে। আপনে আমার থেইকাও টাকা খাইতে চাইতাছেন।’‌

এবার সালিশে উপস্থিত আরও কয়েকজন বলে উঠল, ‘হ, আমরাও হুনছি। আপনে টাকা খাওয়ার মতলব আঁটছেন মিয়া।’

এবার রমজান আলী বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এমন করে অলৌকিকভাবে তার মনের কথা যদি সবাই শুনে ফেলে, তাহলে তো সর্বনাশ। তার সকল কুকর্ম তাহলে ধরা পড়ে যাবে। তিনি যত দ্রুত সম্ভব তার সহকারী যদু মিয়াকে নিয়ে সালিশ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

***

দু’মাস হলো আবু তার মাকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছে। সালিশের পরদিনই বড় ভাইকে মায়ের সব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে মাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিল সে। সেদিন সালিশে অলৌকিক কিছুই ঘটেনি। রমজান আলীর সহকারী যদু মিয়া আবুর বাল্যকালের খেলার সাথি। তাই তো বড় ভাই মধুর কাছ থেকে রমজান আলীর ঘুষ নেওয়ার কথা আবুকে জানিয়ে দেয় সে। আবু সালিশের আগের দিন রাতেই গোপনে গ্রামে পৌঁছে কাছের বন্ধুদের নিয়ে শলা-পরামর্শ করে রমজান আলী আর মধু ভাইকে ফাঁদে ফেলে দেয়। আবু যদুর মাধ্যমে জানতে পেরেছে, রমজান আলী সেই ঘটনার পরে খুবই ভয় পেয়ে গেছেন। এখন নাকি তিনি সালিশে কোনোপ্রকার দুর্নীতি করেন না। মানে, দুর্নীতি করতে ভয় পান আরকি। পাছে আবার লোকে তার মনের কথা পড়ে ফেলে! 

সেদিনের জন্য আবু যদুর কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে এখন বেশ ভালো আছে সে।

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]