এক.

ক’দিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট চোখে পড়ে। পোস্টের ভাষা ছিল অনেকটা এরকম—এই জেনারেশন হঠাৎ করেই কেমন ম্যাচিউর হয়ে গেছে। কোনো মিম শেয়ার নেই, মুভি, সিরিয়াল, খেলা, জিএফ-বিএফ, ট্যুর, গান, আড্ডা নিয়ে কোনো পোস্ট নেই, রিলস নেই। সবাই মানুষের কথা, জাতির কথা, ইনসাফের কথা ভাবছে। রাজপথে বুক পেতে রক্ত দিচ্ছে।

আন্দোলনকারী ভাইয়া ও আপুরা, বুঝতে পেরেছ কী কারণে আমরা এই ১৬-১৭ বছরের জালিম সরকারের কবলে বন্দি ছিলাম? কেন ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছিল? আমাদেরকে, তোমাদেরকে এই মুভি, সিরিয়াল, খেলা, জিএফ-বিএফ, অসীম বিনোদনে মজিয়ে রেখে ডুবিয়ে রেখে জালিমেরা আমাদের শোষণ করেছে। আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। যেই ক্রিকেটের সাথে এত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এত দেশপ্রেমের সম্পর্ক, সেই ক্রিকেটাররা কী করল, তা আমরা দেখলাম না?

পতন্মুখ রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যুগে যুগে কালে কালে স্বৈরাচার এভাবেই তাদের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাখে। এক জালিম বিদায় নিয়েছে। কিন্তু আবার কোনো এক স্বৈরাচার, কোনো এক  জালিম এ জাতির ঘাড়ে যে চেপে বসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অসীম বিনোদন আর ভোগের স্বাধীনতা দিয়ে তোমাদের আবার ধোঁকায় ফেলতে চাইবে। তোমরাই হবে তাদের প্রথম টার্গেট। কারণ তোমাদের একতার কী শক্তি তার প্রমাণ তোমরা দিয়েছ।

তোমরা যদি আবার ধোঁকায় পড়ো, তা হলে শহীদদের রক্তের সাথে গাদ্দারি করা হবে। এত এত লাশ, এত রক্ত, এত অশ্রু এ-সব কিছু বৃথা যাবে। কী জবাব দেবে তুমি তোমার শহীদ সহযোদ্ধাদের? পেলেট গানের আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা ভাইবোনদের?

জনতার সাথে মিলে বুকের রক্ত দিয়ে তোমরা যে নতুন বাংলাদেশ এনেছ, তার ন্যায্য হিস্যা ছেড়ো না। এক দলের বিদায় হবে, আবার অন্য দল এসে আমাদেরকে দাস বানিয়ে রাখবে এ জন্য তো তোমরা রক্ত দাওনি, রক্ত দেয়নি জনতা। শহীদদের রক্তের সাথে গাদ্দারি কইরো না। লাশের ভারের চাইতে বেশি ভারী কোনো কিছু নেই। ইতিহাস তোমাদের ক্ষমা করবে না।

দুই.

জালিম সবসময় চায় জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে । কারণ, জনগণ বিচ্ছিন্ন থাকলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা, জুলুম করা সহজ হয়। একটা ইটকে সহজে ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু ইটের পর ইট সাজিয়ে তৈরি করা দেয়াল সহজে ভেঙে ফেলা যায় না। আমাদের ঘাড়ে জালিম চেপে বসার অন্যতম এক কারণ হলো, আমরা একতাবদ্ধ না। আমরা বিচ্ছিন্ন। আমাদের দরজার পাশেই যে প্রতিবেশী থাকে, তাকে আমরা চিনি না। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে আমরা বিশ্বাস করি না। ভরসা করতে পারি না। যে কাজ গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো পারেনি, তা তোমরা অল্প কয়েকদিনেই করে ফেলেছ। কারণ তোমরা ছিলে একতাবদ্ধ। তোমরা জীবন দিয়ে বিশ্বাস করেছ একে অপরকে। এই একতা টিকিয়ে রাখতে হবে। বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। বিচ্ছিন্ন হলেই নতুন কোনো জালিম চেপে বসবে। সেই আবার আগের জীবনেই ফিরে যেতে হবে।

সবাই মিলে একটা কেন্দ্রীয় কমিটি দিলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া যায়। তবে এর বেশ অসুবিধাও আছে। কমিটি একটা হবার কারণে কমিটির মানুষেরা জালিমের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে পারে। তখন পুরো সংগঠন বিপথে চলে যাবে। স্বৈরাচারী হয়ে যেতে পারে। যথেষ্ট স্বৈরাচার দেখেছি আমরা। আর না। তাই একক কেন্দ্রীয় কমিটি করে সব ক্ষমতা তাদের হাতে তুলে না দিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা এলাকা ও মসজিদ ভিত্তিক আলাদা আলাদা কমিউনিটি বা ইউনিট গড়ে তুলতে হবে। নিজ নিজ এলাকায় ইউনিটগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এর ফলে বড় পরিসরে কেউ স্বৈরাচারী হতে পারবে না। বৃহত্তর  কোনো ইস্যু আসলে এলাকাভিত্তিক সমন্বয়ক নিয়ে সবগুলো ইউনিট বা টিম বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলবে।

তোমাকে ভোটের রাজনীতি করতে হবে এমন না। সমাজের একজন মানুষ হিসেবে, শাহজালাল, শাহ পরান, হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীরের ভূখণ্ডের অধিবাসী হিসেবে তুমি তোমার অধিকার সম্পর্কে জানবে। সে অধিকার কখনো ছেড়ে দেবে না। কেউ অধিকার কেড়ে নিতে চাইলে রুখে দাঁড়াবে। রাষ্ট্র বা সমাজের নেতাদের সবসময় জবাবদিহিতার মধ্যে রাখবে।

তিন.

কোনো প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী ছাড়া দীর্ঘদিন ঐক্যবদ্ধ থাকা সম্ভব না। সবার জজবা ধরে রাখা সম্ভব না। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কর্মসূচী কী হবে?

এখন আমাদের কর্মসূচী হতে হবে দুই ধরনের।

১/ নতুন করে আবার কেউ যেন জালিম হবার স্বপ্নও দেখতে না পারে।

২/ সমাজ সংস্কার করা, সমাজকে প্রকৃত মুক্তি, প্রকৃত স্বাধীনতা, কল্যাণের দিকে পরিচালিত করা।

১ নং কর্মসূচীর মধ্যে থাকবে—

অনেক স্থানে লুটতারাজ চলছে। অনেক জায়গাতেই বছরের পর বছর ধরে চাঁদাবাজি চলে। বাজারে সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি হিসেবে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মাস্তানি করে বেড়ায়। এলাকাকে বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে। মসজিদের কমিটি ইমাম সাহেবদের মুখ চেপে ধরে। সত্য কথা বলতে দেয় না। সরকারি কর্মচারীরা কাজে ফাঁকি দেয়, দুর্নীতি করে।  এদের বিরুদ্ধে এলাকার/ক্যাম্পাসের সবাইকে নিয়ে সামাজিকভাবে রুখে দাঁড়ানো। গনপ্রতিরোধ কমিটি/বাহিনী তৈরি করতে হবে। এলাকায় এলাকায় লাঠি হাতে পাহারা দিতে হবে।  কে কোন রাজনৈতিক দলের, তা আমরা গুনব না। যে-ই দুর্নীতি করবে, জুলুম করবে, সত্য কথা বলতে দেবে না, তাকেই আমাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের ভাইবোনদের, আমাদের ছাত্রজনতার হাজারো লাশের উপর দাঁড়িয়ে আমরা জালিমের কবল থেকে মুক্ত হয়েছি। এখানে কারও মাস্তানি চলবে না। সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষা করতে হবে। অমুসলিম ব্যবসা-স্থাপনায় কোনো সুযোগসন্ধানী যেন হামলা করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে মসজিদের মিম্বারগুলো যেন স্বাধীন থাকে। কোনো সুদখোর, ঘুষখোর যেন কমিটিতে না থাকে। ইমামরাও যেন কমিটির দালালি না করেন।

২ নং কর্মসূচীর মধ্যে থাকবে—

শহীদদের পরিবারকে সাহায্য করা, ত্রাণ বিতরণ, বৃক্ষরোপণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বয়স্কদের/সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পাঠশালা, মসজিদে মসজিদে মক্তব চালু করা, জীবনবিধ্বংসী মাদক, জুয়া, অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখার জন্য খেলাধুলার টুর্নামেন্ট আয়োজন, শরীর চর্চা, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, স্মার্টফোন আসক্তি, পর্ন-আসক্তি, নবজাতক হত্যা, বৃদ্ধাশ্রম, হতাশা, আত্মহত্যা, জিনা-ব্যভিচারের মতো টপিক নিয়ে সেমিনার, লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং—যেকোনো কিছু হতে পারে। সম্ভব হলে ছোট লাইব্রেরি স্থাপন করা, নিয়মিত পাঠচক্র বা হালাকাহ করা। বনভোজনে যাওয়া। জামাতবদ্ধভাবে সালাত আদায় করাকে খুব ভালোমতো গুরুত্ব দিতে হবে।

চার.

এসব কাজ করতে গেলে কি পড়াশোনার ক্ষতি হবে?

দেখো, জালিমের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন সমাজের মানুষ ভালো থাকে, সে জন্য আবু সাঈদের মতো হাজার হাজার মানুষ জীবন দিল। তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায় তার জন্য তুমি সামান্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারবে না? তাদের রক্তের সাথে গাদ্দারি করবে? এতটাই স্বার্থপর তুমি?

১/ দেখো, শুরুতেই বললাম তুমি যে অসীম বিনোদনের মাঝে ডুবে থাকো, এটা থেকে বের হতে পারলেই দেখবে তোমার হাতে কাজ করার সময়ের অভাব হবে না। এই ফাঁদে পড়ে আমরা যে কত সময় ও ফোকাস নষ্ট করি, তা আসলে আমরা বুঝি না। দিনে ১ ঘণ্টা করে সময় দাও, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সময় দাও, গ্রীষ্মকালীন ছুটি বা সেমিস্টার ব্রেকগুলোতে সময় দাও। ইচ্ছা থাকলে ঠিকই সময় বের করা যায়।

২/ জালিমের সমাজে কী পরিমাণ বৈষম্য থাকে, চাঁদাবাজি, লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচার, সুদভিত্তিক অর্থনীতির কারণে দেশের অর্থনীতি, চাকরিবাকরি, বাজার কীভাবে সংকুচিত হয়ে আসে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় তা তোমরা নিজেরাই খুব ভালোভাবে জানো। জালিমদের সমাজ থেকে নির্মূল না করলে অনেক ভালো রেজাল্ট করেও খুব একটা লাভ নেই। 

৩/ সামাজিকভাবে একতাবদ্ধ থাকার ফলে এবং বিভিন্ন কর্মসূচীতে সক্রিয় থাকার ফলে তোমার যে দক্ষতা তৈরি হবে, তোমার যে নেটওয়ার্ক তৈরি হবে তাতে তোমার চাকরি বলো বা ব্যবসা বলো সবক্ষেত্রেই অনেক কাজে লাগবে।

পাঁচ.

ধরো, তুমি নতুন একটা তালা কিনে নিয়ে আসলে। তালার যে চাবি সেই চাবি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে তালা খুলবে না। এখন তুমি যদি অন্য চাবি দিয়ে চেষ্টা করো তাহলে কি এই তালা খুলবে?

আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন কীসে আমাদের প্রকৃত মুক্তি। কোন পদ্ধতিতে চললে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র সঠিকভাবে চলবে। মানুষ মানুষের দাসে পরিণত হবে না। অমুসলিমরাও জুলুমের শিকার হবে না। তাদের প্রাপ্য হক বুঝে পাবে। সেই পথ তিনি আমাদের জানিয়েছেন তাঁর রাসূল ﷺ এর মাধ্যমে। খুলাফায়ে রাশিদীন তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। আল্লাহ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হোন। একমাত্র সেই পথেই সেই জীবনব্যবস্থাতেই আছে মানুষের চিরমুক্তি।

আল্লাহ-রাসূলের অনুসরণ করা ছাড়া, কুরআনের আইন বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাতেই মানুষের মুক্তি মিলবে না। দিনশেষে মানুষ পরিণত হবে মানুষের দাসে। তোমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সময় এটি খুব ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত।]