(১)
বড়াইবাড়ী। কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা রৌমারীর এক প্রত্যন্ত গ্রাম। গ্রাম পেরোলেই ভারতের আসাম রাজ্য। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধানক্ষেত। ক্ষেতগুলো যেন দিগন্তে গিয়ে আকাশের সাথে মিশেছে। মাঝ দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। দূর থেকে দেখতে সাপের মতো মনে হয়। সন্ধ্যে নেমে এলে যখন দূর মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে মাগরিবের আযান ভেসে আসে, কিষাণরা তখন সারাদিনের কাজ শেষ করে এই মেঠোপথ ধরেই বাড়ির দিকে রওনা হয়। ফিকে হয়ে আসা সন্ধ্যের আকাশে উড়ে যায় চেনা-অচেনা নানা রকমের ঝাঁক ঝাঁক পাখি। তাদেরও বাড়ি ফেরার দারুণ তাড়া।
রাতের বাতাসটা আজ বেশ আর্দ্র ঠেকছে। ভারি আর দমবন্ধ লাগছে। বড়াইবাড়ী বিডিআর ফাঁড়ির কমান্ডার নজরুল ইসলাম তার ক্ষীণ আলোয় আলোকিত ঘরে বসে আছেন। চারদিক নিঃশব্দ। খানিক পরপর বাতাসে বাইরের গাছের ডালপালা নড়ার আওয়াজ আসছে। কান পাতলে বহু দূর থেকে গ্রামবাসীর কথার আওয়াজ ক্ষীণ শোনা যায়। নজরুল সাহেবের চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্পর্কে টানাপোড়েনের কথা শোনা যাচ্ছে। সীমান্ত সবসময়ই একটা সংবেদনশীল বিষয় ছিল। কিন্তু আজ কেন যেন নজরুল সাহেবের কাছে সবকিছু ভিন্ন লাগছে। সন্ধ্যে নাগাদ বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে একটা চিঠি আসে। চিঠির উপরে আজকের তারিখ দেওয়া। ১৭ এপ্রিল, ২০০১। চিঠিতে বিএসএফ রহস্যজনকভাবে একটা পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানায়। রৌমারী সীমান্তে সবকিছু তো স্বাভাবিক। তবে এই চিঠি কেন? আশ্চর্য! নজরুল সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়ল। তার মন কুডাক ডাকছিল। তিনি বিডিআরে চাকরি করছেন আজ অনেক বছর। অনেক কিছুই তিনি আগ থেকে আঁচ করতে পারেন।
নজরুল ইসলাম তার সেনাদের চেহারার দিকে তাকালেন। মোটে ১০ জন। সকলে পোড় খাওয়া যোদ্ধা। বছরের পর বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রক্ষার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। কিন্তু আজ রাতে তাদের মধ্যে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। তার মন বলছে, চিঠিটা একটা ফাঁদ। মুখ ফিরিয়ে দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকালেন। প্রায় মধ্যরাত। নজরুল সাহেব জানেন আজ রাতে আর কারও ঘুম হবে না।
(২)
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ি এলাকা পদুয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পসহ মোট ২৩০ একর জমি বিএসএফ অপদখল করে নেয়। আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের উপর তারা নির্যাতন চালায়। বিএসএফ-এর এই ক্যাম্পটি প্রত্যাহারের জন্য একাধিকবার আলোচনা হয়। কিন্তু তারা নড়তে নারাজ। বরং তারা নো ম্যান্স ল্যান্ড দিয়ে গোপনে রাস্তা তৈরি করছে। দু’মাস আগেও বিএসএফকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি।
১৫ এপ্রিল মধ্যরাতে ৮০০ থেকে ১০০০ বিডিআর সেনা পদুয়ার দিকে অগ্রসর হয়।[১] সেখানে পৌঁছে তারা তিনটি ক্যাম্প স্থাপন করে। বিএসএফ মোট ছয় রাউন্ড গুলি চালায়। এরপর ৭০ জন বিএসএফ সেনা আত্মসমর্পণ করে এবং কোনো রক্তপাত ছাড়াই বিডিআর সেনারা পদুয়া মুক্ত করে।[২] দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্লোগান শোনা যায় “পদুয়ার মাটি, বাংলাদেশের ঘাঁটি”।[৩]
খবরের কাগজে গতকাল এই খবরটি ছেপেছিল। নজরুল সাহেব তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ভারত হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এর প্রতিশোধ তারা নিবেই। কেবল সময়ের ব্যপার।
(৩)
১৮ এপ্রিল ভোর ৩টা। প্রতিদিন এই সময়টায় লাল মিয়া তার ধানক্ষেতে সেচ দিতে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার সাথে আরও কয়েকজন গ্রামবাসী এসেছে তাদের ক্ষেতে সেচ দিতে। হঠাৎ সীমান্তের দিকে চোখ গেল লাল মিয়ার। দূরে কাঁটাতার পেরিয়ে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশে ঢুকছে। কাছে আসার পর দেখা গেল তাদের সকলের গায়ে ইউনিফর্ম ও হাতে অস্ত্র। তারা এসে গ্রামের এক বাসিন্দাকে জিজ্ঞেস করল, “বিডিআর কা ক্যাম্প কিধার হ্যায়?” গ্রামবাসীর আর বুঝতে বাকি রইল না এরা কারা।
লাল মিয়া সেখান থেকে এক ছুটে চলে এলো বিডিআর আউটপোস্টে। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে নজরুল ইসলাম সম্বিৎ ফিরে পেলেন। দরজা খুলে দিতেই লাল মিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“স্যার, অরা তো বাংলাদেশে ঢুইক্যা পড়ছে!”[৪]
নজরুল সাহেবের হৃৎপিণ্ড বুক ফেটে বেরিয়ে যাবার অবস্থা। তার আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। প্রতিশোধ নেবার জন্য রাতের আঁধারে বিএসএফ তাদের সৈন্য পাঠিয়েছে। তড়িঘড়ি করে ওয়্যারলেসটা হাতে নিয়ে পার্শ্ববর্তী হিজলমারী ও খেওয়ারচর ক্যাম্পে খবর পাঠিয়ে দিলেন। অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন হতে সময় লাগবে। কিন্তু তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বিএসএফ অতর্কিত হামলা চালানোর সুযোগ খুঁজছে। নজরুল ইসলাম তা হতে দিবেন না।
(৪)
ভোর সাড়ে ৪টা। পূর্বদিক থেকে গুলি চালানো শুরু করে বিএসএফ। আউটপোস্টের কাঠের ভিত ভেদ করে বুলেট চলে যাচ্ছে। বাতাসে কাঠের ভাঙা টুকরো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে উড়ে যাচ্ছে। নজরুল সাহেব ও তার সেনারা মাথা নিচু করে আশ্রয় গ্রহণ করল। গোলাগুলির প্রথম দশ মিনিট তারা কোনো পাল্টা গুলি ছোড়েনি। শত্রুপক্ষ ভাবল, আউটপোস্টটা হয়তো পরিত্যক্ত।
নজরুল সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে রাখলেন। মৃদু চাঁদের আলোয় বিএসএফ সেনাদের কালো ছায়া তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। পাল্টা আক্রমণের সময় এসে পড়েছে। গোলাগুলির আওয়াজ চিঁরে নজরুল ইসলামের কণ্ঠ ভেসে এলো- “ফায়ার”।
একযোগে বিডিআরের চারটি মেশিনগান গুলি করা শুরু করে। মিনিটে শতাধিক বুলেট বিএসএফের জন্য সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে আসে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিএসএফ সেনারা হতবিহ্বল হয়ে যায়। চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল একের পর এক। বিডিআরের অ্যামবুশ নিখুঁত হয়েছে। উল্টো দিকে পালানোর চেষ্টা করে শত্রু সেনারা। পেছন থেকেও বিডিআর তাদের ঘিরে ফেলেছে ভেবে এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে তারা। নিহত হন বিডিআরের ল্যান্স নায়েক ওহিদুজ্জামান। বিএসএফ সেনারা পালিয়ে গিয়ে দু’শ গজ দূরে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই অবস্থান করছে। নজরুল সাহেবের সেনারা তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। বড়াইবাড়ীর ধানক্ষেতগুলো হয়ে উঠেছে রণক্ষেত্র।
রাতের আঁধার কেটে দিগন্ত লাল হয়ে এসেছে। ১৬ জন বিএসএফ সেনার লাশ পড়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তাদের প্রাণহীন ধূসর চোখগুলো সকালের আকাশের দিকে নিবদ্ধ। হিজলমারী ও খেওয়ারচর ফাঁড়ী থেকে আরও ১৬ জন বিডিআর যোগ দেয় নজরুল ইসলামের দলের সাথে। দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলতে থাকে। সকাল ১০টা নাগাদ জামালপুর থেকে ৩৩ রাইফেল ব্যাটেলিয়ানের অতিরিক্ত বিডিআর সেনারা এসে যোগ দিলে শত্রুপক্ষ ভারতে পালিয়ে যায়। এরপর দু’দিন থেমে থেমে দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলে।
নজরুল ইসলামের সেনারা তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তাদের সবকিছু দিয়ে তারা বড়াইবাড়ী রক্ষা করেছে। ৩ জন বিডিআর সেনার তাজা প্রাণ চলে যায়। আহত হয় অনেকে। গ্রামবাসীর ভোগান্তিও কম হয়নি। প্রাণভয়ে অনেকে ভিটেবাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যায়, অনেকে আহত হয়। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও একটুখানি বিজয়ের স্বাদ পেলেন নজরুল সাহেব।
(৫)
বাতাস থেকে বারুদের গন্ধ মুছে গিয়েছে। বন্দুকগুলোও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। কিন্তু বিজয়ের স্বাদ তেতো হয়ে এলো। ভারত এই লজ্জাজনক পরাজয় মানতে নারাজ। সীমান্তের ওপার থেকে সরকারের উপর চাপ আসতে লাগল। নজরুল সাহেব জানতে পারলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী ভাজপায়ীর সাথে গোপন ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন বিডিআরের এমন আচরণে তিনি “লজ্জিত”। দেশরক্ষায় অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া যোদ্ধাদের রক্তের সাথে চরম বেঈমানী করা হলো।
২০ এপ্রিল এক পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ভারত মৃত বিএসএফ সেনাদের লাশ ফিরিয়ে নিয়েছে। গ্রামবাসীর জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু বড়াইবাড়ীর এই ক্ষত অত দ্রুত শুকাবে না।
গ্রামের সীমানায় দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছিলেন নজরুল ইসলাম। সামনের ধানক্ষেতগুলো সেদিন রক্তসিক্ত হয়েছিল। বুকে হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করলেন তিনি। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য লড়েছেন তারা, জীবন দিয়েছেন। কিন্তু শেষমেশ ক্ষমতায় থাকা জালিমদের স্বার্থের বলি হলো তাদের সকল ত্যাগ-তিতিক্ষা। একটি ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যাম্পের পথ ধরলেন নজরুল সাহেব।
বড়াইবাড়ী-রৌমারী যুদ্ধ অতীত হয়েছে। তবে সীমান্ত রক্ষার লড়াই এখনো বর্তমান। ভারতের এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা প্রাণ নেবে ফেলানী থেকে স্বর্ণাসহ শত শত বাংলাদেশীর।[৫] ২০০৯ এর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অনুঘটক ছিল রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধ।[৬]
[ষোলো ৮ম সংখ্যায় (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রকাশিত]
[১] Wikipedia Entry - “২০০১ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ”, https://tinyurl.com/yck9w2hw
[২] “বড়াইবাড়ী যুদ্ধ: আগের সাহসিকতায় নেই বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড”, আল-ফিরদাউস, ১৮ এপ্রিল ২০২১। https://tinyur
[৩] “পদুয়া ও রৌমারী-বড়াইবাড়িতে সীমান্ত সংঘর্ষ: কুড়ি বছর পর ফিরে দেখা”, বাংলা ট্রিবিউন, ১৬ এপ্রিল ২০২১। https://tinyurl.com/32svvhxw
[৪] “বড়াইবাড়ী যুদ্ধ: কুড়িগ্রামে কুড়ি বছর আগের যে সংঘাতে ১৬ জন ভারতীয় রক্ষী নিহত হয়”, বিবিসি বাংলা, ১৮ এপ্রিল ২০২১। https://tinyurl.com/ym2sj7me
[৫] “সীমান্তে ১৫ বছরে ছয় শতাধিক হত্যা”, কালের কণ্ঠ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪। https://tinyurl.com/4chk76me
“ফেলানী থেকে স্বর্ণা: সীমান্ত হত্যার শেষ কোথায়?”, ডয়েচে ভেলে, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪। https://tinyurl.com/ym6fpx9
[৬] “পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনরায় বিচারের দাবি উঠছে কেন, এটা কি সম্ভব?”, বিবিসি বাংলা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪। https://tinyurl.com/mrx7pnmn