আমি মারা যাচ্ছি!

ভূতুড়ে জাহাজ কেবল গল্প বা সিনেমায় থাকে না,[1] কখনো কখনো এগুলো বাস্তব জীবনেও ঘটে। এমনই একটি ভৌতিক কাহিনি ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে মালাক্কা প্রণালীতে, যা সুমাত্রা এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে অবস্থিত। এ এলাকায় থাকা জাহাজগুলো একদিন এক ভয়ানক বিপদ সংকেত পায়—

‘সব অফিসারসহ ক্যাপ্টেন মারা গেছে, চার্টরুম এবং ব্রিজে পড়ে আছে। সম্ভবত পুরো নাবিকদল মারা গিয়েছে।’ এর পর কিছু অস্পষ্ট মোর্স কোড এবং তারপর, ‘আমি মারা যাচ্ছি।’

‘সিলভার স্টার’ নামের এক আমেরিকান জাহাজ সেই বিপদ সংকেতে সাড়া দেয়। সিগন্যাল ট্রেস করে তারা খোঁজ পায় ‘অউরাং মেডান’ নামের এক ডাচ জাহাজের। দ্রুত অউরাং মেডানের কাছে হাজির হয় সিলভার স্টার। কিন্তু কাউকেই ওই জাহাজে দেখা যাচ্ছিল না। জাহাজের ডেকে নাবিকদলের কোনো নাম-নিশানা পর্যন্ত ছিল না। এমনকি চিৎকার করে ডেকে ডেকেও তাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

অগত্যা আমেরিকান নাবিকদল ‘অউরাং মেডান’-এ নামার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকজন ডেকে নামে।  এবং যা দেখে, তা দুঃসপ্নের মতো তাদের তাড়া করে বেড়ায় বাকি জীবন। ডেকের যত্রতত্র  নাবিকদের লাশ পড়ে আছে। তাদের বিকৃত মুখমণ্ডলগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল—মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তারা খুব ভয়ঙ্কর কিছু দেখেছে। এমনকি জাহাজের কুকুরটি পর্যন্ত মরে পড়ে ছিল, নিদারুণ যন্ত্রণায় এর মুখমণ্ডলও ছিল বিকৃত। জাহাজের কাপ্তানের লাশ পাওয়া যায় ব্রিজের ওপর। আর যোগাযোগ কর্মকর্তা তখনো যথাস্থানেই ছিলেন, তার শীতল হয়ে যাওয়া আঙ্গুলগুলো তখনো বেখেয়ালে টেলিগ্রাফ টাইপ করে চলেছিল।

আমেরিকান নাবিকদল জাহাজের বয়লার রুমে যায়। বয়লার রুমও সমান ভয়ংকর ছিল।  তাপমাত্রা শতডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেও ভয়ে তাদের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামছিল।

ভীতসন্ত্রস্ত আমেরিকান নাবিকদল নিজেদের জাহাজে ফিরে যায়। ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নেন ‘অউরাং মেডান’-কে বন্দরে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ‘অউরাং মেডান’-এ গুণ বেঁধে নিজেদের জাহাজের সাথে যুক্ত করেন। ঠিক এর পরেই সেখান থেকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ঠিক পরমুহূর্তেই বুউউউম... শব্দে বিস্ফোরিত হয় ‘অউরাং মেডান’। আক্ষরিক অর্থেই সলিল সমাধি ঘটে। সকল রহস্য নিয়ে ডুবে যায় সাগরে।

কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, অউরাং মেডানের সাথে অতিপ্রাকৃতিক কোনো ঘটনা ঘটেছে। হয়তো অতৃপ্ত জলদস্যুর আত্মা অউরাং মেডান-এর উপর দলবেঁধে হামলে পড়েছিল। অথবা  এলিয়েনদের কোনো দলের খপ্পরে পড়েছিল।

অনেকেই ধারণা করে থাকেন যে, ডাচ জাহাজটি পটাশিয়াম সায়ানাইড ও নাইট্রোগ্লিসারিনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের মতে, সমুদ্রের লবনাক্ত পানি কার্গো বোঝাই রাসায়নিকের সঙ্গে বিক্রিয়া করে থাকতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে বিষাক্ত গ্যাস বের হওয়া শুরু হয়। নাবিকেরা এই গ্যাসের বিষক্রিয়ায় মারা পড়ে। পরবর্তীতে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা হয়তো নাইট্রোগ্লিসারিনের কারণে। অথবা হতে পারে, বয়লার রুম ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় নাবিকদল মারা পড়েছিল। বয়লার রুমের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জাহাজে আগুন লাগে। সেখান থেকে বিস্ফোরণ।

তবে এই ঘটনার টুইস্ট এখানেই শেষ নয়। সিলভার স্টার নামে জাহাজ আসলেই ছিল। কিন্তু  রেজিস্ট্রেশনরেকর্ড ঘাঁটলে জাহাজটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এই প্রশ্নও চলে আসে, অউরাং মেডান নামের ভুতূরে জাহাজ কি আসলেই ছিল? নাকি এটি নিছকই নাবিকদের একটি বানোয়াট কেচ্ছা?


[1] আগের পর্বগুলো পড়ো এখান থেকে: ১ম পর্ব, ২য় পর্ব

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]