লেখক মার্ক টোয়েনের একটি উক্তি আছে, ‘সত্য কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত’। ইতিহাস টিকেই আছে এমন বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে। ঠিক তেমনই এক ঘটনা হলো ‘পাখির বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ’! কী, ভাইয়াপুরা, শুনতে অবাক লাগছে? না! শুনতে আশ্চর্যকর শোনালেও এটি কোনো মিথ্যা বানানো গাল-গল্প নয়; বরং সত্যিই ইমু নামের এক ধরনের পাখির সাথে মানুষের লড়াই হয়েছিল। যা ইতিহাসে ‘The Great Emu War’ নামে পরিচিত। যুদ্ধটি অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৩২ সালে বছরের শেষ দিকে সংঘঠিত হয়। মাত্র এক মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রাণপন লাগাতার চেষ্টা করেও সৈন্যবাহিনী সর্বসাকুল্যে প্রায় এক হাজারের মতো ইমু পাখি মারতে সক্ষম হয়। কিন্তু তবুও যেন ইমুদের সংখ্যা কমছিলই না। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই হার মেনে নিতে হয় মানুষকে। পক্ষান্তরে জিতে যায় ইমুরা!

কিন্তু কীভাবে সংঘটিত হলো এই যুদ্ধ[1]? চলো, জেনে নিই।

১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হলো। সৈনিকেরা সবাই নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। যারা অস্ট্রেলিয়া থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারাও ফিরে এসেছে। কিন্তু তারা খাবে কী? আর কাজই-বা করবে কী? কেননা বন্দুক চালনা ছাড়া তাদের তো বিশেষ কোনো দক্ষতাই ছিল না। তাই অস্ট্রেলিয়ান সরকার তাদের চাষাবাদের জন্য আবাদি জমি দান করে। ক্ষেতে কাজ করার জন্য তাদের পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পুনর্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে তারা গম উৎপাদন শুরু করে। কেননা গম তাদের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। কিন্তু ১৯২৯ সালের The Great Depression এর ফলে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। একইসাথে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের ভর্তুকির অভাবে আটার দামে ধ্বস নামে। তাই চাষীরা সিদ্ধান্ত নেন পর্যাপ্ত মূল্য না পেলে ফসল বিক্রি করবেন না।

কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক বিপত্তি! সেসব ফসলি জমির আশেপাশে দেখা দেয় অসংখ্য ইমু পাখি। আকারে বড়সড় দ্বিপদী লম্বা এই পাখিটি উড়তে না পারলেও, বেজায় দ্রুতগতিতে দৌড়াতে সক্ষম। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি। কেননা এই অঞ্চল ছিল ইমুদের আবাসস্থল ও বংশবিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। পর্যাপ্ত শস্য ও পানি জোগান থাকায় এটি হয়ে উঠেছিল ইমুদের জন্য একটি আদর্শ বিচরণক্ষেত্র।

হঠাৎ করে ইমুদের এত বিস্তার কৃষকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলো। এরা ক্ষেতের সমস্ত গম খেয়ে সাবাড় করে ফেলা থেকে নিয়ে শুরু করে, জমির সীমানার বেড়া ভেঙ্গে অন্য প্রাণীর জন্যও প্রবেশপথ তৈরি করে দিত। ছোট ছোট গর্ত তৈরি করত, যা দিয়ে খরগোশ আসা-যাওয়া করত। শুধু গমই নয়; বরং অন্য ফসলগুলোও ধ্বংস করে ফেলত। 

কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে চাষীদের ক্ষেতের সীমানায় নতুন করে বেড়া দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। ইমুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চাষীদের নিকট যেসকল বন্দুক ও গুলি ছিল, তা ইমু নিধনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। 

এত ইমুদের উৎপাত ঠেকাতে তবে করণীয় কী? তারা চিন্তা করতে লাগলেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। তারা চলে গেলেন তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ পিয়ার্সের কাছে। নিজেদের সার্বিক পরিস্থিতির  কথা খুলে বলে তার কাছে সাহায্য চাইলেন। পিয়ার্স তাদের অনুরোধ  রাখলেন। ইমু নিধনের জন্য সৈন্য এবং সামরিক সুবিধার ব্যবস্থা করলেন।

অপারেশন ইমু এক্সিকিউশনের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হলো রয়াল অস্ট্রেলিয়ান আর্টিলারির মেজর জি. পি. ডব্লিউকে। তার সাথে ছিল আরও দুজন সৈন্য, সাথে দুটি লুইস মেশিনগান ও দশ হাজার রাউন্ড গুলি। এসব সরঞ্জাম নিয়েই তারা প্রস্তুতি নিতে লাগলেন ইমুদের বিরুদ্ধে। ক্যালেন্ডারে  তখন ১৯৩২ সালের অক্টোবর মাস। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির  কারণে যুদ্ধ পিছিয়ে দেওয়া হলো ২ নভেম্বরে। যুদ্ধের প্রথম দিন নির্ধারিত স্থান ঠিক করা হলো পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ক্যাম্পিওন অঞ্চল। সৈন্যরা পরিকল্পনা মোতাবেক লুইস মেশিনগান দুটো নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। তাদের নজরে আসে অর্ধশতাধিক ইমুর একটি দল। কিন্তু পাখিগুলো তাদের পরিধি থেকে অনেক দূরে ছিল। যথাসম্ভব কিছুটা কাছে এসেই গোলাগুলি আরম্ভ করা হলো। গুলি ছোড়ার সাথে সাথেই হকচকিত ইমুরা এদিকসেদিক দ্রুত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া শুরু করে। ছোট ছোট দলবেঁধে নানাদিকে পালানোর ফলে সৈন্যদের টার্গেট বারংবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। ফলে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়া ছাড়া তারা আর তেমন কিছুই করতে পারেননি। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি খরচ করেও সেদিন পুরোপুরি ইমু মারতে ব্যর্থ হন তারা।

ঠিক তার দুই দিন পর ৪ নভেম্বর। দ্বিতীয় দিন সৈন্যরা নতুন পরিকল্পনা হাতে নেন। ইমু পাখিদের নজর এড়াতে আড়ালে একটি গুদামে লুকিয়ে সেখান থেকে গুলি করা আরম্ভ করেন। কিন্তু তাতেও খুব বেশি একটা সুবিধা হয় না। দুর্ভাগ্যবশতঃ বন্দুকের ব্যারেল জ্যাম হয়ে যাওয়ায় সেদিনটিও ভেস্তে যায়। হাজারখানেক ইমুর মধ্যে মাত্র বারোটি ইমু মারতে সক্ষম হন তারা। বাকি সবগুলো পাখি এদিকসেদিক পালিয়ে যায়।

এভাবেই বেশ কিছুদিন যুদ্ধ চলে৷ সৈন্যরা প্রতিবারই বিফল হচ্ছিল। তারা চিন্তা করতে লাগল, এভাবে লুকিয়ে খুব বেশি ইমু হত্যা করা সম্ভব নয়। তাই এবার চলন্ত ট্রাকে মেশিনগান সংযুক্ত করে পাখিদের উপর গুলির চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয়।

এ যেন প্রতিবারই সৈন্যদেরকে ইমুদের বিজয়ের জানান দিয়ে যাচ্ছিল। ৮ নভেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। এই ছয়দিনে সৈন্যরা ২৫০০ রাউন্ড গুলি খরচ করে সবমিলিয়ে মাত্র ৫০টি ইমু মারতে সক্ষম হয়।

সৈন্যরা যুদ্ধবিরতিতে চলে গেলে ইমুদের সংখ্যা আবারও বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। ফসলের উপর ইমুদের আক্রমণ বাড়তে থাকায় চাষীরা এবারও সরকারের শরণাপন্ন হন। যথাযথভাবেই পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় ইমু যুদ্ধ। ১৩ নভেম্বর থেকেই জোরেশোরে যুদ্ধ চলে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতি সপ্তাহেই শতাধিক ইমু হত্যা করা হচ্ছিল। মেজর জি. পি. ডব্লিউ এর নেতৃত্বে সর্বমোট ৯৮৬টি ইমু মারা হয়। এর সাথে আরও ২৫০০ পাখি গুরুতর আহত হয়। প্রতিটি ইমু মারতে খরচ হয় গড়ে ১০টি করে বুলেট। কিন্তু এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ইমু পাখিরা শিক্ষা নিতে ভুলে যায়নি। তাই ক্রমান্বয়ে তারা হয়ে উঠে আরও চতুর ও ধূর্ত।

এই যুদ্ধের পরেও কোনোভাবেই চাষীরা তাদের থেকে রেহাই পাচ্ছিল না। তাই ফসল বাচাঁতে পরবর্তীতে বিশেষ সীমানাবেষ্টনীর ব্যবস্থা করা হয়। সংখ্যার বিচারে মানুষের জন্য ২০ হাজার পাখির বিপরীতে ১ হাজার পাখি নিধনে খুব বেশি গৌরবের কিছু নেই। ফলে পরোক্ষভাবে ইমুরাই এই যুদ্ধে জয়লাভ করে, পাখিদের কাছে পরাজয়বরণ করে মানুষ!


[1] https://www.thecollector.com/great-emu-war/

https://www.britannica.com/topic/Emu-War

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]