দৌড়াচ্ছি অনেকক্ষণ ধরে…

আকাশে কার্তিকের চাঁদ। ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। চাঁদের আলোয় শূন্য মাঠের শূন্যতা আরও বেড়েছে। গত পাঁচ মিনিট ধরে দৌড়াচ্ছি। আমি একা না। আমার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও ৪/৫ জন। সবুজ, সজীব, আপন, শামীম, মানিক। একই স্কুলের একই ক্লাসে পড়ি আমরা। এলাকার সবাই একবাক্যে আমাদের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেয়—ওরা খুব ভদ্র ছেলে!

তবে আর বোধহয় এমন সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে না। গত পাঁচ মিনিট ধরে আখ খেতের মালিকের তাড়া খেয়ে ছুটছি আমরা। স্কুলের মাঠ, রাস্তা পাড়ি দিয়ে এখন শূন্য খেতের মধ্যে নেমেছি। মালিক টর্চ জ্বালিয়ে পিছু নিয়েছে আমাদের। ধরাই পড়ে যাব মনে হচ্ছে। মাঠের শেষে চলে এসেছি আমরা প্রায়। আর কিছুদূর গেলেই নদী শুরু। গরমের রাত হলে কথা ছিল না। তবে এই শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানিতে নামার কোনো উপায় নেই।  কাল সকালে এলাকায় যে কী করে মুখ দেখাব! সব দোষ ওই ব্যাটা আপনের। সে-ই আমাদের বুদ্ধি দিয়েছিল! এখন কী এক মুসিবতে পড়লাম!

দু মিনিটের মাথায় নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। পালাবার আর উপায় নেই। নিয়তির হাতে সব ছেড়ে দিয়ে আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। ধাওয়াকারী টর্চটাও কাছে চলে আসলো একেবারে। টর্চ মালিক আমাদের মুখে টর্চ মারল। ২০ সেকেন্ড তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।

কথা বের হলো না আমাদের মুখ দিয়েও।

এরপর সবার মুখ থেকেই একযোগে বেরিয়ে আসলো – অ্যাঁএএ!

দুই.

বছর শেষের পরীক্ষা হয়ে গেছে। কোনো কাজ কাম নেই। আমরা সকালে বের হই সাইকেল নিয়ে। দুপুরে একবার বাসায় গিয়ে নাকেমুখে কিছু গুঁজে দিয়ে আবার সাইকেল নিয়ে বের হই। কোনো কোনো দিন মাঠে ক্রিকেট খেলি। তবে বেশিরভাগ পোলাপানই গেইম আর টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ক্রিকেট তেমন একটা খেলা হয় না। মাঝে দুদিন মানিকের কোনো খবর নেই। আজ সাইকেল নিয়ে ঝড়ের বেগে উড়ে আসলো। আমরা তখন বসে ছিলাম মাঠের পাশের বাগানে। সাইকেলটা কোনোমতে স্ট্যান্ড করেই আমাদের পাশে এসে বসে কথা বলতে শুরু করল। তবে এত দ্রুত সাইকেল চালিয়ে এসেছে যে, খুব জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছিল। উত্তেজনায় কোনো কথাই বের হচ্ছিল না তার মুখ দিয়ে। একটু স্বাভাবিক হবার পর সে শোনাল এই দুই দিনের তার এডভেঞ্চারের কথা…

মানিক গিয়েছিল তার ফুপির বাসায়। ফুপাতো ভাই আছে কয়েকটা। কয়দিন খুব মজা করেছে ও। ফুপিদের বাড়ির পাশেই ছিল এক মস্ত বিল। সেই বিলই ছিল তাদের এডভেঞ্চারের কেন্দ্রবিন্দু। শীতকাল। বিলে পানি খুব বেশি নেই। যা আছে তাও শুকিয়ে যাচ্ছে। সেখানে দুপুর পর্যন্ত ওরা মাছ মেরেছে কাদার ভেতর। দেশি মাগুর, শিং, কই মাছের ঝোল দিয়ে জম্পেশ একটা খাওয়া দিয়েছে দুপুরে। এরপর পড়ে পড়ে ঘুমাইছে অনেকক্ষণ। উঠেছে একবারে সূর্য ডুবতে বসা সন্ধ্যায়। এরপর আবার চলে গিয়েছে বিলে। ধান কাটা হয়ে যাওয়া শূন্যক্ষেতে হাঁস দিয়ে পিকনিক করার জন্য। বেশ রাত পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া, আনন্দ-ফুর্তি করার পর বাড়ির পথ ধরেছে ওরা। লাইন দিয়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা আখ ক্ষেতের পাশে চলে আসে ওরা। মানিকের ছোট ফুপাতো ভাই সাদের মাথায় চেপে বসে। সবার পেছনে ছিল সে। চুরি করা ফল না কি খুব সুস্বাদু হয়। কয়েকটা আখ সাবাড় করে দিলে কেমন হয়? হাতের কাছেই তো আছে। হাঁস জবাই করার বটিটা দিয়ে কয়েকটা কোপ দিতে হবে কেবল। তাহলেই হলো! 

বেশিক্ষণ ভাবাভাবিতে সময় নষ্ট করল না সে। বটি দিয়ে কয়েকটা পোচ দিল আখের গাছে। নিপুণ দক্ষতায় আখগুলো হাতে তুলে নিল।

‘দৌড় দে, মানিক। ভাইয়া, দৌড় লাগান।’ 

বাকিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দৌড়ে অনেকদূর চলে গেল সাদ। আখ খেতের অপর পাশ থেকে শক্তিশালী একটা টর্চ জ্বলে উঠল। পুরুষালী একটা কন্ঠে হাঁক আসলো—কে রে, আখ চুরি করে কে?

এবার মানিক আর অন্যরাও বুঝল সাদ কী করেছে। ভৌ দৌড় দিল তারাও। পুরুষালী কণ্ঠও বুঝতে পেরেছে ঘটনা সত্যি। শেয়াল টেয়াল নয়,  আসলেই আখ চুরি হচ্ছে তার ক্ষেতে। ‘ধর, ধর’ চিৎকার করে দৌড় দিল সেও। কিন্তু ততক্ষণে মানিকরা পগার পাড়।

‘বুঝলি, আমার খুব ভয় লাগছিল। উত্তেজনায় বুকের মধ্যে হৃদপিন্ডটা লাফাচ্ছিল। কিন্তু যখন একেবারে নিরাপদ জায়গায় চলে আসলাম আর আখে প্রথম কামড়টা দিলাম, তখন মনে হচ্ছিল এত সুস্বাদু আখ আমি আমার জীবনে আর খাইনি। চুরির ফলের আসলেই খুব স্বাদ হয়!’ হাসি হাসি মুখে বলছিল মানিক।

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।’ সহমত জানাল শামীম। ‘মামার বাসায় গিয়ে আমিও একবার এরকম ফল চুরি অভিযানে অংশ নিয়েছিলাম। চুরির ফল আসলেই খুব সুস্বাদু হয়।’

‘তুই কী চুরি করেছিলি?’ প্রশ্ন করল মানিক।

আমি চুরি করেছিলাম ডাব। আমি আর আমার দুই মামাতো ভাই মিলে। মামার গাছেই!   

সে কী! নিজের মামার গাছেই! কেন? প্রচণ্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা সবাই।

আর বলিস না। মামা ছিল ভীষণ কৃপণ। কী কচি কচি ডাব ধরে আছে গাছে। কিন্তু আমাদের খেতে দেবে না। বিক্রি করবে। আর টাকা জমাবে। তাই এই ব্যবস্থা আরকি।

তা কীভাবে চুরি করলি? বল দেখি পুরো ঘটনা। 

সেদিন বিকাল থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল। সন্ধ্যা না যেন ঘুটঘুটে রাত। কারেন্ট নেই। মামা গিয়েছে হাটে। বাসায় আমরা ছাড়া পুরুষ মানুষ বলতে কেউ নেই। নানীকে বললাম—নানী, আমরা মাগরিবের সালাত পড়তে যাচ্ছি। আগে থেকেই বাহিরে একটা ধারালো বটি লুকিয়ে রেখেছিলাম আমরা খড়ের গাদায়। বড় মামাতো ভাই বাদুড়ের মতো তরতর করে উঠে গেল গাছে। ছোট মামাতো ভাই বাইরে থেকে মেইন গেটের শেকল আটকে দিল। আমি রইলাম গলির মুখে পাহারায়। ডাব গাছটা ছিল একেবারে বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষা। কারেন্ট ছিল না, আগেই বলেছি। তারপরেও গাছের ওপরের শব্দে নানী ঠিকই টের পেল গাছে কেউ উঠেছে। নানী চিৎকার দিয়ে উঠল, গাছে কে উঠেছে রে?

ছোট মামাতো ভাই ছিল ভীষণ চালাক। গলা মোটা করে সে বলল, আমরা ডাকাত। চুপ করে থাকো। চিৎকার চেচামেচি করলে ফল ভালো হবে না। বাইরে থেকে দরজা লাগানো। তোমরা কেউ বের হতেও পারবে না।

বাড়ির ভেতর থেকে শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেল।[1]  বড় ভাই আর বেশি সময় নিল না। ঝটপট নেমে আসলো অনেকগুলো ডাব নিয়ে। সুন্দরমতো খড়ের গাদার পেছনে আমাদের গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে মাগরিবের সালাত পড়ে ফিরলাম এমন ভাব নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাড়ি ফিরতেই মামীম খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। ডাব কেটে নিয়ে গেছে। আমরা লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলাম।

মামা বাসায় ফিরলে মামাকেও জানালেন তিনি। মামা কিছুক্ষণ বকাবকি করলেন ডাকাতদের। আফসোস করলেন কত ক্ষতি হয়ে গেল তার এই ভেবে।

সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমরা বের হয়ে আসলাম। গোপন জায়গা থেকে ডাব বের করে প্রাণভরে খেলাম।

‘বাহ! তোরও তো দেখি চুরির অভিজ্ঞতা আছে।’ বেশ মুগ্ধতা নিয়েই বলল সজীব। 

তন্ময় হয়ে আমরা এতক্ষণ গল্প শুনছিলাম।  

আমাদের পাশে বসে শয়তানও বোধহয় খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছিল। চুরির গল্প শেষ হতেই হুশ ফিরল তার। আমাদের লাড়াচাড়া দেওয়া শুরু করল। আপন বলে উঠল, ‘চল, আমরাও আজকে কিছু একটা চুরি করি।’

সবাই একবাক্যে সাড়া দিলাম। সত্যি কথা বলতে মানিক আর শামীম যখন চুরির গল্প বলছিল, তখন আমাদের একটু হিংসা হিংসা লাগছিল। ওরাও এমন ভাব নিয়ে গল্পগুলো বলল, যেন তারা একেকজন হিরো। তাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম আমরা।  

সবই তো বুঝলাম। কিন্তু চুরি করব কী?

বেশ কিছুক্ষণ ভাবলাম আমরা।

ইউরেকা! চিৎকার দিয়ে উঠল আপন।

সবাই ওর দিকে তাকালাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। সজীব অস্থিরতার রোগে ভোগে। সে আপনের প্রায় কোলে উঠে তার কাঁধের দুইপাশে ধরে ঝাকাতে লাগল।

‘কী পেয়েছিস তাড়াতাড়ি বল।’

সবজান্তার হাসি হেসে আপন বলল, সবাই আমার কাছে আয়। আস্তে আস্তে বলি। আশেপাশের কেউ শুনে ফেললে আমাদের খবর হয়ে যাবে।

আপনকে একটু ক্যাবলাকান্ত টাইপের মনে হয় আমার কাছে। ও যে কী পেয়েছে তা নিয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। কিন্তু সবাই যেহেতু যাচ্ছে, আমিও গেলাম। ফিসফিস করে ও পরিকল্পনা বলে গেল। সব শুনে হাসি ফুটল আমাদের সবার মুখেই।

       তিন.

রাত আটটা ঠিক করা ছিল আমাদের একশান টাইম। সাক্ষাতের জায়গা সেই মাঠের পাশের আম বাগানই। সাক্ষাতের সময় ৭ টা ৪৫ মিনিট। ৭ টা ৩০ এর দিকে চুপি চুপি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। আমবাগানে পৌঁছে দেখি এরইমধ্যে বাকিরা সবাই চলে এসেছে। চকচকে একটা বটি নিয়ে এসেছে সজীব। আপন এনেছে ছোট্ট একটা টর্চ লাইট।

আমাদের টার্গেট হলো মাঠের ওইপাশের বারোমাসি আখক্ষেত। বিকেলেই আপন আর মানিক আশপাশ রেকি করে এসেছে। পাহারা থাকে না কোনো। তাই তেমন কোনো বিপদ নেই। তবুও সাবধানের মার নেই। প্রায় নিখুঁত একটা প্ল্যান সাজিয়েছে আপন, মানিক আর শামীম মিলে।

মূল একশান অর্থাৎ আখ কাটতে যাবে আপন আর শামীম। প্রথমে মানিক আর শামীম যেতে চেয়েছিল, যেহেতু ওরা অভিজ্ঞ। কিন্তু প্ল্যান যেহেতু আপনের মাথা থেকে বের হয়েছে, তাই আপন নিজেই যাবে বলে গো ধরল। আসলে আখ চুরির এই বিরল সম্মান অর্জনের সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে আমরা মানিককে রাজি করালাম।

মাঠের এই পাশের অর্থাৎ আমবাগানে পাহারা দেবার দায়িত্বে থাকলাম আমি আর সজীব। সজীবকে আমি সাথে নিতে চাচ্ছিলাম না। অস্থিরতা আর তাড়াহুড়ার জন্য না জানি আমাকে কী বিপদে ফেলে। কিন্তু সবাই মিলে আমাকে গছিয়ে দিল। সিগন্যাল ঠিক হলো কোকিলের ডাক। কেউ আসলে মূল দলকে সতর্ক করে দেবার জন্য দুইবার কোকিলের ডাক ডাকব আমরা।

- এই শীতকালে কোকিল ডাকে না কি? আপত্তি জানালাম আমি।

- ‘আরে ব্যাটা, মাথা খারাপ! কোকিল থাকে না, হুটহাট করে ডাকে? মনে কর ওইরকম কোকিল।’ ভূগোল বোঝানোর চেষ্টা করল আমাকে আপন। আগেই বলেছি ও একটা ক্যাবলাকান্ত। কিন্তু ওই যেহেতু মূল পরিকল্পনা করেছে আর বাকিরা সবাই ওকে সমর্থন দিচ্ছে দেখে আমি আর তেমন কিছু বলতে পারলাম না।

মাঠের ওইপাশের অর্থাৎ আখ ক্ষেতের পাশে পাহারার দায়িত্ব একাই নিল সবুজ। কেউ আসলে ও ডাকতে থাকবে শেয়ালের ডাক। নিখুঁত শেয়ালের ডাকতে পারে সে।

মানিক চালাক চতুর। ওর ডিউটি পড়ল আমবাগান যে মেইনরোডের ধারে সেইখানে। কেউ আমবাগানের এদিক থেকে আখক্ষেতের এদিকে আসতে লাগলে এই কথায় সেই কথায় তাকে ভুলিয়ে রাখবে।

৮ টা বাজতেই শুরু হয়ে গেল আমাদের অপারেশন। 

প্রথমে গেল এডভান্সড পার্টি অর্থাৎ সবুজ। আশেপাশ ভালো মতো জরিপ করল সে। এরপর একবার শেয়ালের ডাক শুনতে পেলাম আমরা। বিসমিল্লাহ বলে বুকে দুআ দরুদ পড়ে ফু দিতে দিতে বেরিয়ে গেল আপন আর শামীম।

আমরা দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছি। সজীব অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর হাতের আঙ্গুল মটকাচ্ছে। আপনরা যাওয়ার ২ মিনিটও হয়নি, এমন সময় ধুপধাপ শব্দ শুনলাম আমরা। চাঁদের আলোয় দেখলাম ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসছে ওরা তিনজন। পেছনে টর্চ লাইট নিয়ে আরও একজন আসছে। নিশ্চয়ই আখক্ষেতের মালিক বা পাহারাদার!

- কী হয়েছে, কী হয়েছে? কাছাকাছি আসতেই দৌড়ে ওদের দিকে গেল সজীব।

- দৌড় না থামিয়েই উচ্চস্বরে ঘনঘন শ্বাস ফেলে শামীম বলল, দৌড় লাগা ব্যাটা। ধরতে পারলে খবর আছে।

এক সেকেন্ড দেরি না করে দৌড় দিলাম আমি। একটু পর পিছু ফিরে দেখি সজীব সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাকে বলে। আমি তার হাত ধরে এক হ্যাচকা টান মারতেই হুশ ফিরল তার। এক দৌড়ে সবাইকে ছাড়িয়ে সবার সামনে চলে গেল সে। সজীব আমাদের স্কুলের সেরা দৌড়বিদ। প্রত্যেকবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়ে ফার্স্ট প্রাইজ পায় সে।

দৌড়াতে দৌড়াতে শামীমের পাশে আসলাম।

- ঘটনা কী?

দৌড়াতে দৌড়াতে শামীম যা বলল তার সারমর্ম হলো—

সবুজ প্রথমে গিয়ে আশপাশ ভালোমতো দেখে আমাদের গ্রিন সিগন্যাল দেয়। আমরা সেখানে গেলাম। দুইটা ভালো মোটা আখ দেখে কোপ মেরেছি। আপন হালকা করে আলো জ্বালিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে আখক্ষেতের ওইপাশ থেকে কে জানি হই হই করে উঠল- দাঁড়া, আমি আসছি। 

সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভিয়ে ফেলল আপন। এরপর আমরা দৌড় দিলাম দুইজন। একটু পর দেখি সবুজও দৌড়ে আসছে। আসলে গ্রিন সিগন্যাল দেবার পরপরই সবুজ সেই লোকটাকে দেখতে পায়। কিন্তু সে তখন ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। গলা দিয়ে আমাদের সতর্ক করার জন্য শেয়ালের ডাক বের করতে পারেনি একটাও।

চার.

গল্পের প্রথম অংশে ফিরে যাই। ধাওয়া খেয়ে আমরা সবাই নদীর একেবারে কিনারে। ধাওয়াকারী টর্চ লাইটওয়ালা আমাদের মুখে আলো ফেলল। আমরা ও টর্চওয়ালা…  সবাই চমকে উঠলাম। আসলে আমরা কেউই কাউকে আশা করিনি।

টর্চওয়ালা হলো আমাদের পাড়ার মাসুদ কাকু। গাঞ্জাখোর হিসেবে আশেপাশের দশগ্রামে এবং অবশ্যয় থানার পুলিশদের কাছে বেশ সুখ্যাতি আছে তার। আখক্ষেতের ঐপাশে সে গিয়েছিল গাজা খেতে। অপেক্ষা করে বসে ছিল সে। তার ইয়ার দোস্তরা আনতে গিয়েছিল গাজা। দেরি হচ্ছিল বোধহয় অনেক। তাই মাসুদ কাকু অস্থির হয়ে পড়ে। শামীমদের আখ কাটার শব্দ শুনে সে ভেবেছিল, বোধহয় তার দোস্তরা গাজা নিয়ে ফিরেছে। কিন্তু এদিকে শামীমরা আবার ভেবে বসে আখক্ষেতের মালিক ক্ষেত পাহারা দিয়েছে। তাই ওরা ছুট লাগায়। গাজা খাবার নেশায় অস্থির মাসুদ কাকু ভাবল, দোস্তরা বোধহয় তাকে গাঁজার ভাগ দেবে না। তাই সেও শামীম অর্থাৎ আমাদের সবার পিছু নেয়।  

ইয়ার দোস্তদের বদলে আমাদের দেখে মাসুদ কাকু একটু নিরাশ হয়। আমরা স্বস্তির হাফ ছেড়ে বাঁচি।

‘এত রাতে তোমরা এখানে কী করছ? দৌড়াদৌড়ি করছিলা কেন?’ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে মাসুদ কাকু।

‘না মানে, আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম। জ্যোৎস্না রাত তো… পরীক্ষা শেষ।’ মানিক উত্তর দিল আমাদের সবার হয়ে। 

বাহ! বাহ! বেশ ভালো। ছোট থাকতে আমরাও কত খেলেছি। কিন্তু এখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আর বাইরে থেকো না। যাও বাসায় যাও।

কাকুর কথা মেনে নীরবে যে যার বাসায় চলে গেলাম আমরা। একদিনের জন্য যথেষ্টেরও বেশি এডভেঞ্চার হয়ে গিয়েছে! 

                          ****

প্রাসঙ্গিক কিছু কথা……

- লস্ট মডেস্টি

মূল গল্প এখানেই শেষ। চমৎকার এই গল্পটার পর কিছু জ্ঞানের কথা বলে তোমাদের মজাটা নষ্ট করে দিতে চাচ্ছি না। তবে গল্পের বিষয়টি আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দু চারটা জ্ঞানের কথা ঝেড়েই ফেলি, কী বলো?

১। এরকম চুরি করে ফলমূল খাবার অভ্যাস আমাদের অনেকেরই কমবেশি ছিল আরকি ছোটবেলায়। তখন আমরা অবুঝ ছিলাম। অনেক কিছুই বুঝতাম না। তবে এই বড়বেলায় এসে কিন্তু আর ফল চুরি করে খাওয়া যাবে না।

২। তোমরা যারা ছোট আছ, এখনই শপথ করো আর এভাবে ফল চুরি করে খাবে না। এভাবে চুরি করে ফল খাওয়াটা ঠিক নয়। এতে অন্য মানুষের হক নষ্ট হয়। এটাতে ক্ষণিকের মজা পাওয়া গেলেও পরে অনেক আফসোস করতে হবে। 

৩। যারা ইতোমধ্যেই ফল চুরি করে খেয়েছ, তারা কী করবে? আলিমগণ বলেন[2]- ছোটবেলায় চুরি করে ফল খাওয়ার অপরাধ মাফ পাবার জন্য যা যা করা যেতে পারে :

ক) ফলের মালিকের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

খ) চুরি করা ফলের মূল্য হিসেব করে (আনুমানিক) সেই ফলের মালিককে পরিশোধ করতে হবে। মালিক বেঁচে না থাকলে মালিকের উত্তরাধিকারীদের কাছে দিতে হবে। গ) যদি মালিকের কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে, মূল্য পরিশোধ করতে গেলে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবার, ঝগড়া-বিবাদের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ফলের আনুমানিক মূল্য দান করে দিতে হবে। আল্লাহর কাছে ফলের মালিকের জন্য দুআ করতে হবে।


[1] নানী আসলে বুঝতে পেরেছিল, এমন কাজ আমরা ছাড়া আর কেউ করার সাহস পাবে না।

[2] ছোটবেলায় কারও গাছের ফল চুরি করে খেয়ে ফেলেছি, এখন কী করব? শায়খ আহমাদুল্লাহ- https://tinyurl.com/folchuri

ছোটবেলায় অন্যের গাছ থেকে চুরি করে খাওয়া ফল এখন যে ভাবে মাফ পেতে পারেন | Mawlana Zahirul Islam- https://tinyurl.com/y9vbhexb