অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। প্রচুর অপচয় করতাম। মিনিটে মিনিটে জিনিসপত্র ধ্বংস হয়ে যেত আমার মাধ্যমে। আম্মু-আব্বু আমাকে ‘উৎপাত’ নামে চিনত। বাসায় প্রচুর বকা খেতাম। তাও আমি ঠিক হতাম না। একদিন আব্বু আমাকে বলল, ‘গরিব হলে বুঝতে যে, অভাব কী জিনিস। যা চাচ্ছ, তা তুমি সহজে পেয়ে যাচ্ছ। তাই অপচয়ের পরিণাম কী হতে পারে তা তুমি বুঝতে পারছ না।’ সেদিন এই ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব দিইনি।

প্রতিদিন আসরের সময় আব্বু তার অফিস থেকে পাশের মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করেন। আমাদের বাসা ও আব্বুর অফিস একই এলাকায় হওয়ায় আব্বুর সাথে প্রতিদিনই আসরের সময় মাসজিদে দেখা হয়।

প্রতিদিনের মতো একদিন আসরের সময় আব্বুর সাথে মাসজিদে দেখা হলো। সালাত শেষে আব্বু অফিসে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং আমিও বাসার দিকে ফিরে যাব, এমতাবস্থায় ঘটল এক আজব কাণ্ড।

মাসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় আব্বু লক্ষ্য করল, তার জুতাজোড়া উধাও হয়ে গিয়েছে। আব্বু এবং আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করেও জুতাজোড়া পেলাম না। সৌভাগ্যক্রমে, আমার ও আব্বুর জুতার সাইজ একই। সেই সুবাদে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। আমি আব্বুকে বললাম, আমার জুতা পরে অফিসে চলে যেতে। আব্বু এই বিষয়টি মানতে ইতস্তত বোধ করল। বাবার পায়ে জুতা রেখে সন্তানকে খালি পায়ে বাড়ি পাঠানোটা আব্বুর কাছে নির্দয় কাজ মনে হলো।

আমার জোরাজুরির এক পর্যায়ে আব্বু আমার জুতা পরে যেতে বাধ্য হলো। মাসজিদ থেকে আমাদের বাসা খুব বেশি দূরে নয়। তাও আমার যেন খালি পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে না হয় তাই আব্বু আমার জন্য রিকশার ব্যবস্থা করে দিল।

রিকশায় বাসায় যেতে যেতে আমার কিছুটা লজ্জা ও অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। আমার চোখ যায় শুধু মানুষের জুতার দিকে। সকল পথচারীর পায়ে জুতা ছিল, ছিল না শুধু আমার পায়ে। এমনটা দেখে নিজেকে আরও অসহায় লাগছিল। অস্বস্তিতে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।

আমার রিকশা বাসার প্রায় কাছে চলে এসেছিল। সবার পায়ের দিকে নজর করতে করতে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল ধূলিমাখা একজোড়া পায়ের দিকে। খেয়াল করে দেখলাম যে, তিনি হয়তো একজন অভাবী মানুষ, আস্তে আস্তে হেঁটে কোথাও যাচ্ছেন, অথচ তার পায়ে কোনো জুতা নেই।

বাসায় ফেরার পর বিষয়টি আমাকে বেশ ভাবালো। আমার মনে হলো, আমার মাথার উপর তো ছাদ আছে। রুটি-রুজির বন্দোবস্ত আছে। আলমারি ভর্তি পোশাক আছে। শেলফে আছে কয়েক ধরনের জুতা। অথচ পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা অভাবের কারণে ঠিকমতো খেতে পায় না, ভালো জামাকাপড় কিনতে পারে না, পায়ে জুতা পরতে পারে না। তাদের চাইতে আমাকে আল্লাহ কতই না ভালো রেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। 

সাথে সাথে আমার আব্বুর সেই দিনের কথাটাও মনে পড়ল। অপচয় করা নিয়ে আমার আব্বু সেদিন যে কথা বলেছিলে, তা এখন বুঝতে পেরেছি। মহান আল্লাহ আমাকে সাময়িকভাবে জুতার অভাব অনুভব করিয়ে সতর্ক করে দিলেন। অপচয় করা বন্ধ না করলে সম্পদশালী মানুষও একদিন হয়ে যেতে পারে গরিব ও অসহায়—এই বার্তাটি উপলব্ধি করিয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম যে, অপচয় করা নিয়ে সতর্ক না হলে সামনে কঠিন দিন দেখতে হতে পারে।

জি ভাইয়া, আপু। অনেক বছর ধরে আমি ‘অপচয়’ নামক এই খারাপ কাজটা করে আসছিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি যে, এমন করতে থাকলে একদিন আমারও অসহায় অবস্থা দেখতে হতে পারে।

এসো, আমরা অপচয় না করি। কারণ, অপচয়কারীকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না। কুরআনে আল্লাহ তাআলা যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো অপচয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘হে আদম সন্তান! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক গ্রহণ করো, আর খাও এবং পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।’ [সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত-৩১]

এবং বিশেষভাবে মনে রেখো, অপচয়কারী হলো শয়তানের ভাই। হ্যাঁ, সেই শয়তান, যে আমাদের একমাত্র শত্রু। এই শয়তানই আমাদেরকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেহনত করে। অপচয় করা মানেই হলো শয়তানকে খুশি করে জান্নাত থেকে দূরে সরে যাওয়া। তাই আমরা সবাই যেন অপচয় বন্ধ করে আল্লাহকে খুশি করতে পারি। কারণ আল্লাহ তাআলা খুশি থাকলে আমরা চিরশান্তির জায়গা জান্নাত যেতে পারব। সেখানে একসাথে আনন্দ করতে পারব। আল্লাহ আমাদের সকলকে অপচয় করা থেকে বিরত থাকার এবং সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষদের সাহায্য করার তাওফিক দান করুন। আমীন।