পরীক্ষার মৌসুম আসলেই উস্তাদ বলতেন, ‘আল ইমতিহানু ওয়াসিলাতুন, লা গা’য়াহ।’ অর্থাৎ, পরীক্ষা জ্ঞান অর্জনের একটি মাধ্যম মাত্র, এটি জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য নয়। তখন আমাদের পরীক্ষা-সর্বস্ব মোহ ও ভয় দুই-ই কেটে যেত। কিন্তু এ পরীক্ষা জিনিসটাই যে আমার জীবনের বড় এক ইমতিহান হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানত!

দাওরায়ে হাদীস পড়ার জন্য গেলাম বড় এক মাদরাসায়। কারণ, বড় প্রতিষ্ঠান থেকে ফারেগ হতে পারলে বড় বড় উস্তাদদের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। ঘটনাটি ২০১৩ সালের।

বৃহত্তম দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পটিয়ায় তখন দাওরায়ে হাদীস পড়ছি। নতুন এসেছি। কেউ আমাকে চিনে না। আমিও বলতে গেলে ব্যাকবেঞ্চার হয়েই থাকি। দেড় হাজার ছাত্রের একটি ক্লাসে ব্যাকবেঞ্চার থাকাই নিরাপদ। আমরা শুনতাম এসব বড় মাদরাসায় জিনের সন্তানরাও পড়তে আসে। তবে তা ছদ্মবেশেই। উস্তাদরা বিষয়টি জানতেন। তাই মাঝেমধ্যে তাদের নসীহাতে উঠে আসত সেই ছদ্মবেশী ছাত্রভাইদের প্রতি বিশেষ দিক-নির্দেশনা।

বাতাসের সাগরে ডুবে থেকেও যেমন আমরা বাতাসের অস্তিত্বের বিষয়ে বেখবর থাকি, অনেকটাই সেরকম জিন-ছাত্রদের কথা জানলেও তা খুব একটা চিন্তার বিষয় ছিল না। এর একটা কারণ হতে পারে এই যে, যেহেতু তারাও দ্বীন শিখতে এসেছে, কারও অনিষ্ট করার মতো তাদের মধ্যে কেউ থাকবে না। তবে প্রায়ই রাতে ছাদের ওপর হুড়োহুড়ি আর দৌড়ঝাঁপের শব্দ শুনতাম আমরা। আচ্ছা! জিনদের কি না ঘুমালেও চলে? তবে আমরা এসব নিয়ে সত্যিই তেমন গা করতাম না।

ক্লাসে সবসময় মেধাবী হিসেবে আলোচিত হতো পূর্বপরিচিত কিছু মুখ। যারা সেই প্রথম শ্রেণি থেকেই এই মাদ্রাসায় পড়ে আসছে। তারা মাদরাসার জন্য এতই আন্তরিক যে, ঈদে-কুরবানেও মাদরাসার জন্য কাজ করতে থেকে যায়। পড়াশোনাতেও খুব ভালো। উস্তাদরা তাদেরকে নিয়েই বেশি আশাবাদী থাকতেন। প্রতি পরীক্ষায় তাদের রেজাল্টের খোঁজখবর নিতেন।

দুর্ঘটনাটা ঘটল অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায়। সে বছর আমার মধ্যে রাত জেগে কিতাব অধ্যয়ন করার একটা নেশা পেয়ে বসল। এত বড় মাদারাসার বিশাল গ্রন্থাগার। কিতাব নিয়ে বসে পড়লে আযানের শব্দ ছাড়া অন্যকিছুতে ধ্যান ভাঙত না। এক সময় পরীক্ষা চলে এল। অন্যন্য ছাত্ররা উর্দুতে বেশি পারদর্শী হলেও আমি আরবিতে পারদর্শী ছিলাম। তারা উর্দুতেই পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখত, আমি আরবিতে লিখতাম।

অর্ধ-সাময়িক পরীক্ষার পর আবার ক্লাস শুরু হলো। উস্তাদরা ক্লাসে এসে জানতে চাইলেন কে ‘মুমতায আওয়াল’ (প্রথম) হয়েছে? বাতাসে আমার নাম উচ্চারিত হলো। অথচ আমি তখনো বসে আছি ব্যাকবেঞ্চে! আমাকে ডেকে সামনে বসানো হলো। অনেকেই অবাক হলো। অনেকেই মারহাবা দিল।

মূল ঘটনা এখনো শুরু হয়নি। আমি ছুটি নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। ৪ দিনের ছুটিতে বেশ বিশ্রাম হয়ে গেল। ৪ দিন পর বাসা থেকে মাদরাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল। রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে গেলাম ওয়াশরুমে। ওয়াশরুম থেকে ফেরার সময় আমার শরীর ভারী হয়ে আসলো। আমি ভাবলাম ভ্রমণের ক্লান্তি। রুমে এসে শুয়ে পড়তেই প্রচণ্ড মাথাব্যাথা। আমি সবসময় খুব আত্মকেন্দ্রিক। নিজের ভালো-খারাপ কাউকেই বলি না। দাঁতে দাঁত চেপে বিছানায় পড়ে আছি। একসময় আমি জ্ঞান হারালাম না কি ঘুমে তলিয়ে গেলাম জানি না।

ফজরে জাগতেই দেখি মাথাব্যাথা আর নেই। উঠে ওযু করতে গেলাম। দেখি আমি কুলি করতে পারছি না। মুখে পানি নিতেই তা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে ওযু সেরে সালাতে চলে গেলাম। সালাত শেষে রুমে ফিরতেই রুমমেট কথা বলতে এল। আমাকে দেখে তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম! বলল- তোমার মুখে কী হয়েছে? আমি বললাম- কই! তখন হাতের কাছে ছোট আয়নাটা নিয়ে চেহারা দেখলাম। সাথে সাথে ধুক করে লাফিয়ে উঠল আমার কলিজা। আমার ঠোঁট অনেকটাই ঝুলে পড়েছে। এতক্ষণে আবিষ্কার করলাম আমি ঠিকমতো কথা বলতে পারছি না। ঠোঁটের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার ভেতরটা আর্তনাদ করে উঠল।

আমাদের ইবনু মাজাহ পড়াতেন মুফতি মুযাফফর (রহিমাহুল্লাহ) হুজুর। তিনি দারসের পাশাপাশি শারয়ী রুকইয়াহ করতেন। দূর-দূরান্ত থেকে উনার কাছে অনেকেই আসত সমস্যা নিয়ে। ছাত্ররাও যেত। আমরা মাঝেমধ্যে উনার বাসায় যেতাম দ্বীনি আলাপ করতে। আমাকে অল্প অল্প চিনতেন। সকালে আমি উনার কাছে গেলাম। এবং জানালাম আমার কী হয়েছে। রাতে বেশ মাথাব্যাথা করেছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখি এই অবস্থা।

উস্তাদ বললেন- তুমি আপাতত একজন ডাক্তারের কাছে যাও। আমি আন্দাজ করতে পারছি কী হয়েছে। এদিকে আমি একটু কাজ করব। বিকেলে ডাক্তার কী বলল আমাকে এসে জানিও।

আমি ডাক্তার দেখাতে গেলাম। ডাক্তার বলল, এটা ‘বেলস পালসি’, মুখের নার্ভ কোনো কারণে আঘাত পেলে এমন ঘটে। উনি মেডিসিন ও থেরাপি দিলেন। আমি বিকেলে আসলাম উস্তাদের কাছে। উস্তাদ বললেন- মাদরাসার কয়েকজন জিন-ছাত্রকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ওরা খুব চরিত্রবান ও সৎ, ওদেরকে দায়িত্ব দিয়েছি তোমার এই ঘটনার পিছনে তাদের জাতির কেউ দায়ী কি না খোঁজ নিতে। তুমি আপাতত চিকিৎসা নাও। আমিও তোমাকে কিছু পানিপড়া দিচ্ছি, এগুলো পান করিও। কাল সকালে একবার এসো আমার কাছে।

যথারীতি পরদিন সকালে উস্তাদের কাছে গেলে তিনি যা জানালেন তা এরকম-

আমার আকস্মিক ভালো রেজাল্টের কারণে জিন ছাত্রদের একজন খুব রেগে যায়। অন্যান্য জিন ভাইদের সাথে এ নিয়ে সে আলাপও করেছিল। পরে যে রাতে আমি বাড়ি থেকে আসি, ওয়াশরুম থেকে ফেরার পথে ঐ জিনছাত্রসহ আরও কয়েকজন ঐ করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে রাগ আবার উথলে উঠে ছেলেটার। সে আমাকে চড় মারতে আসলে বাকি ছাত্ররা তাকে বাঁধা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে তার হাতের ছোঁয়া বা বাতাস লেগে যায় আমার মুখে। এ কারণে নার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকতে পারে।

ঐ ছাত্রকে উপস্থিত করতে না পারলেও বাকিদের মারফত উস্তাদ কড়া করে জানিয়ে দেন, যদি ভবিষয়তে এ ধরনের কোনো অপ-তৎপরতা তিনি দেখেন তা হলে প্রত্যেককেই কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।

সুস্থ হতে আমার কয়েক মাস চিকিৎসা, থেরাপীসহ রুকইয়াহ করাতে হয়েছিল নিয়মিত। কিন্তু এরপর থেকে আমি রাত জেগে আর পড়তে পারতাম না। মাথাব্যাথা করত, ভয় পেতাম। সেই পরীক্ষা আমার জীবনে ইমতিহান হয়ে দেখা দিয়েছিল। ভাগ্যিস, চড়টা মারতে পারেনি!