১.
ছেলেটার নাম অয়ন। পুরো নাম অয়ন মাহতাব। পড়াশুনা সেন্ট্রাল বয়েজ স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। দুরন্ত আর দস্যিপনায় রীতিমতো ‘উস্তাদ’ সে। যে ক’জন ছেলে ক্লাসে না আসলে পুরো ক্লাসটাকেই ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাদেরই একজন এই অয়ন মাহতাব।
২.
– ‘কীরে সজীব, অয়ন আজ অমন মুখ গোমরা করে বসে আছে কেন?’
– ‘আমিও বুঝতে পারছি না রে, আবির। যে ছেলেটা কোথাও স্থিরভাবে দাঁড়াতেই চায় না, সে কি না আজ কারও সাথে কথাই বলছে না, চুপ করে বসে আছে ব্যাকবেঞ্চের এক কোণে!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সজীব।
– ‘ঠিক বলেছিস, সজীব। ব্যাপারটা আমার কাছেও কেমন জানি বেখাপ্পা ঠেকছে।’ সম্মতির সুর ইমাদের।
মাহী প্রশ্ন করল,
– ‘রক্বীব, তুই কি কিছু জানিস?’
– ‘ঠিক শিওরভাবে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমার ধারণা, অয়নের মূল্যবান বা দরকারি কোনো জিনিস হয়তো হারিয়ে গেছে।’ জবাব রক্বীবের।
– ‘হুমম..., হতেও পারে। চল তো, একটু গিয়ে দেখি আসল ব্যাপারটা কী।’ বলল ইশরাক।
– ‘হ্যাঁ, চল!’ সমস্বরে বলল বাকিরা।
৩.
সকাল ১০টা। সপ্তাহের ২য় দিন। বাস স্টেশন সংলগ্ন সেন্ট্রাল রোডটা তখন মহাব্যস্ত। সকাল ৭টা থেকেই রিকশার টুং টাং শব্দ আর যানবাহনের মোটরগুলোর ধাতব শব্দে মুখর রাস্তাসহ পুরো এলাকা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শোরগোল আর গার্মেন্টস শ্রমিকদের আনাগোনাও কম হয় না এই রাস্তায়।
রাস্তার ডানপাশের ফুটপাত ধরেই হাঁটছিল অয়ন। পিঠে ব্যাগ আর পরনে স্কুল ড্রেস। দিবা শাখার ক্লাস শুরু হয় দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে। তবে যেদিন কোচিং থাকে সেদিন তাড়াতাড়ি বের হতে হয় অয়নকে।
সকাল সাড়ে ১০ টায় শুরু হওয়া দেড় ঘণ্টার ক্লাস শেষ করেই রওনা দিতে হবে স্কুলে। আজ আবার বেতন জমা দেওয়ার শেষ দিন। আজকে যদি বেতন দেওয়া না যায়, তো পরের দিন গার্ডিয়ান নিয়ে এসে কৈফিয়ত দাও, এতদিন সময় থাকতেও বেতন কেন যথাসময়ে পরিশোধ করা যায়নি। শুধু কৈফিয়তেই শেষ না, ঠিক টাইমে বেতন জমা না হলে সমপরিমাণ টাকা জরিমানাও দিতে হবে।
৪.
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কোচিং এর পথে হাঁটছিল অয়ন। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ পেয়েই থমকে দাঁড়াল সে। কান্নার আওয়াজের উৎস খুঁজতে খুঁজতেই অয়ন দেখতে পেল, রাস্তার বাম পাশটার ফুটপাতে তার বয়সী একটা ছেলে বসে বসে কাঁদছে। তাকে দেখে কোনো ‘টোকাই’ বা ‘পথশিশু’ বলে মনে হচ্ছে না অয়নের। কাপড়ের অবস্থা বেশ পরিপাটি পরিচ্ছন্ন না হলেও, খুব একটা খারাপ না। নীল রঙের চেক শার্ট আর কালো রঙের জিন্সে ছেলেটাকে ভালোই লাগছিল। চোখের পানিতে শার্টের একাংশ প্রায় ভিজে গেছে। কতক্ষণ ধরে কাঁদছিল কে জানে! ছেলেটা অমনভাবে কাঁদছিল দেখে মন খারাপ হয়ে গেল অয়নের। নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে ছেলেটা, আর উপায় না দেখে এখানে বসে বসে কাঁদছে। কিন্তু কেউ তার কাছ ঘেঁষে জানতেও চাচ্ছে না, সে আসলেই কেনো বিপদে পড়েছে কি না। দু এক টাকার পয়সা ছুড়ে মেরেই যেন সব দায়িত্ব শেষ। আজকালকার মানুষ বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিকতা আর ভোগবাদী জীবনে সবাই নিজেকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত। সেই মানুষগুলোর সময় নেই সমাজের অসহায়দের দিকে একটু চোখ তুলে তাকানোর।
অয়ন কিছুটা দুষ্টু আর চঞ্চল স্বভাবের হলেও প্রচন্ড দায়িত্বশীল। কোনো দায়িত্ব যখন তার কাঁধে আসবে তখন সেটা পালন করে তবেই থামবে।
৫.
পিঠে আলতো হাতের ছোঁয়া পেতেই পিছন ফিরে তাকাল আল-আমিন। সে দেখল, শহুরে স্কুলড্রেস পরা আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল আল-আমিন। স্কুলড্রেস পরা ছেলেটার প্রশ্ন শুনতেই সংবিৎ ফিরে পেল সে।
— ‘ভাইয়া, তোমার নাম কী?’ প্রশ্ন করল অয়ন।
— ‘ভাই, আমারে কইতাছেন?’ জলদি দু’হাতে চোখ মুছে, পালটা প্রশ্ন করল আল-আমিন।
— ‘হ্যাঁ, ভাইয়া।’
— ‘ভাই, আমার নাম আল-আমিন।’ অনেকটা উৎসাহ নিয়েই জবাব দিল ছেলেটা।
— ‘ভাইয়া, তোমার কি কিছু হয়েছে? এভাবে এখানে বসে কাঁদছ যে?’
— ‘ভাই, আমি গেরাম থেইকা শহরে আইছিলাম একটা চাকরির খোঁজে!’
— ‘তুমি কি একাই এসেছে?’ আল-আমিনের কথা পুরোপুরি শেষ না হতেই প্রশ্ন করল অয়ন।
— ‘না ভাইয়া, আমি আমার বড় ভাইয়ের লগেই শহরে আইছিলাম। কিন্তু বাস থেইকা নামার পর আমি ভিড়ের মধ্যে পইড়া গেলে ভাইরে হারায়া ফেলি।’ বলেই সে আবার কেঁদে ফেলল।
— ‘তোমার ভাই কি শহরে চাকরি করে?’
— ‘হ ভাই, হের মাধ্যমেই চাকরি পাইতে শহরে আইছিলাম। কিন্তু ভিড় কমার পর অনেক খুঁইজাও তারে আর পাই নাই।’
— ‘তোমার কি টাকা-পয়সা কিছু আছে?’
— ‘না ভাইয়া, আমার তিন হাজারটা টেকা, বাড়ির ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বার সব এক জায়গায় আছিল। কিন্তু ভিড় থেইকা বাইর হওয়ার পর দেখলাম সব হারায়া গেছে। আমি এর আগে গিরাম থেইকা বেইর হই নাই কুনোদিন। আইজক্যাই পরথমবার। গিরামের নাম কবার পারমু! কিন্তু আর কিছু না’
— ‘বাসের টিকেটটাও নিশ্চয় হারিয়ে গেছে?’
— ‘না না, ভাই। টিকেট আমার কাছেই আছে। বাস থেইকা নামার সময় টিকিটটা হাতের ভিতরেই ছিল। হেইডা হারায় নাই।’
— ‘দেখি তো টিকেটটা।’ অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিতে বলল অয়ন।
আল-আমিন টিকেটটা অয়নের হাতে দিলে অয়ন দেখল, টিকেটে ক্রেতার নাম লেখা আছে ‘করিম হোসেন’। সম্ভবত আল-আমিনের বড় ভাই। টিকেটের মূল্য ২০০ টাকা। টিকেট ইস্যুর জায়গায় গতকালের তারিখটি লেখা। সবশেষে রেজিষ্ট্রেশন নাম্বারের জায়গায় নয় অংকের একটা ডিজিট দেওয়া আছে। আর নিচে একটু ডানপাশে ষ্টেশন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর।
অয়নের মনে পড়লে তার এক বন্ধুর মামা সেন্ট্রাল রোড সংলগ্ন বাস ষ্টেশনটায় চাকরি করেন। তার কাছ থেকে হয়তো কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অয়ন আল-আমিনকে নিয়ে ষ্টেশনের পথে পা বাড়াল।
৬.
বাস যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় আর গ্রীষ্মের ঝলসানো রোদে ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থা পুরো ষ্টেশনে। কোথাও দাঁড়িয়ে দম ফেলবার কোনো সুযোগ নেই। হাঁটার সময় কখনো এর সাথে ধাক্কা লাগছে তো কখনো ওর সাথে। পাশাপাশি সমানতালে বাস ড্রাইভারদের বিরক্তিকর হর্ন তো আছেই। ‘মানবজ্যাম’ পেরিয়ে কোনোরকমে ষ্টেশন অফিসে এসে পৌঁছল অয়ন আর আল-আমিন। অয়নের বন্ধুর মামার নাম বলতেই তাকে ডেকে দিলেন অফিসের ক্লার্ক জনৈক ভদ্রলোক।
— ‘আরে, অয়ন যে! কেমন আছো তুমি?’ অয়নকে এভাবে অফিসে দেখে চমকে গেলেন রিয়াদ সাহেব।
— ‘আসসালামু আলাইকুম, মামা। এইতো ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?’
— ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, অয়ন। আমিও ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ।’ উত্তর দিলেন রিয়াদ সাহেব।
— ‘মামা, একটা সমস্যায় পড়েছি। আপনার একটু সাহায্য দরকার।’
— ‘হ্যাঁ, বলো। কীভাবে আমি তেমার সাহায্য করতে পারি?’
— ‘মামা, সমস্যাটা আসলে আমার না। সমস্যা মূলত এই ছেলেটার।’ আল-আমিনের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল অয়ন।
— ‘ও, আচ্ছা আচ্ছা। আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। কী নাম তোমার?’ আল-আমিনকে প্রশ্ন করলেন রিয়াদ সাহেব।
— ‘মামা, আমার নাম হইল আল-আমিন।’ রিয়াদ সাহেবকে অয়ন ‘মামা’ বলে ডাকায় আল-আমিনও তাকে ‘মামা’ বলে সম্বোধন করল।
— ‘তা, কী সমস্যায় পড়েছে তুমি?’
— ‘মামা, আমি সব খুলে বলছি। কোথাও কি বসে কথা বলা যাবে?’ বলল অয়ন।
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বসো তোমরা।’
অয়ন আর আল-আমিনের দিকে দুটো চেয়ার ইশারা করলেন রিয়াদ সাহেব। এর মধ্যে আবার চা অর্ডার করতে বললেন ক্লার্ক ভদ্রলোককে। চেয়ার দুটির একটিতে আল-আমিন এবং অপরটিতে অয়ন বসল। রিয়াদ সাহেবও তার চেয়ারে এসে বসলেন।
৭.
— ‘এখন বলুন, কীভাবে আমরা তার ভাইয়ের সন্ধান পাব?’ ঘটনা বিস্তারিত বলার পর মামাকে প্রশ্ন করল অয়ন।
— ‘হুম, বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, গ্রামের নাম কী জানি বললা?’ আল-আমিনকে প্রশ্ন করলেন মামা। গ্রামের নাম শুনে গুগলে সার্চ দিলেন। অয়ন, আল-আমিন কৌতুহলী হয়ে মামার কর্মকাণ্ড দেখছেন। কিন্তু গুগল সার্চে কিছু আসল না। খুব ছোট গ্রাম মনে হয়। কিছুটা চিন্তিত দেখা গেল মামাকে।
— ’আচ্ছা, বাসের টিকেটটা আমাকে একটু দাও তো।’ অয়নকে বলল মামা।
— ‘এই নিন, মামা।’ টিকেটটা এগিয়ে দিল অয়ন।
ইতিমধ্যেই অফিস ক্লার্ক এসে তিন কাপ চা দিয়ে গেল। অয়ন আর আল-আমিনের দিকে চা এগিয়ে দিয়ে রিয়াদ সাহেব অবশিষ্ট কাপটি নিলেন।
চা পর্ব শেষে অয়নদের বসতে বলে টিকেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রিয়াদ সাহেব। দুই মিনিট পর ফিরে এলেন একটা কাগজ নিয়ে।
— ‘মামা, কিছু কি জানতে পেরেছেন?’ রিয়াদ সাহেব তার চেয়ারে বসতেই প্রশ্ন করল অয়ন।
— ‘হ্যাঁ, অয়ন। টিকেটের রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে কম্পিউটার থেকে টিকেট ক্রেতার প্রয়োজনীয় সকল তথ্য বের করা গেছে।’ অয়নের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিলেন রিয়াদ সাহেব।
অয়ন দেখল, কাগজটিতে আল-আমিনের ভাইয়ের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বারসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য দেওয়া আছে।
— ‘মামা, কাগজে থাকা নাম্বারটাতে কি কল করে দেখবেন?’
— ‘আমিও একই কথা ভাবছিলাম, অয়ন। নাম্বারটাতে কল দিলে আল-আমিনের ভাই করিমের কোনো খোঁজ হয়তো পাওয়া যেতে পারে।’
রিয়াদ সাহেব তার মোবাইল থেকে নাম্বারটিতে কল দিলেন। প্রথমবার কল রিসিভ না হলেও, দ্বিতীয়বার কল রিসিভ করল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এক তরুণ।
— ‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি করিম হোসেন, আল-আমিনের বড় ভাই?’ প্রশ্ন ছুড়লেন রিয়াদ সাহেব।
— ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই করিম হোসেন। আল-আমিনের বড় ভাই। আল-আমিন কি আপনার কাছে আছে?’ উত্তেজিত করিম।
— ‘হ্যাঁ, সে এখন আমার কাছেই আছে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। যে বাস ষ্টেশনে আপনারা নেমেছিলেন, শীঘ্রই তার অফিসে চলে আসুন।’
— ‘আচ্ছা, আমি জলদি আসছি। আসসালামু আলাইকুম।’
— ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
সালামের জবাব পেয়েই ফোন কেটে দিয়ে ষ্টেশন অফিসের দিকে দ্রুত রওনা দিল করিম হোসেন।
৮.
আল-আমিনকে দেখতেই জড়িয়ে ধরল করিম। আল-আমিনও করিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। দুই ভাইয়ের এমন ভালোবাসা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন অফিসের সকল কর্মকর্তা।
ষ্টেশন মাস্টার করিম হোসেনকে বললেন,
— ‘দেখো করিম, বাস, লঞ্চ, ট্রেন এসব যানবাহনে ভ্রমণ করার সময় খুব সাবধান! বিশেষ করে তোমার সাথে যখন ছোট কেউ থাকবে। আর হ্যাঁ, আজকের ঘটনা থেকে শিক্ষা নাও, পরবর্তীতে যাতে এমন ভুল আর না হয়।’
— ‘জি, স্যার। দুআ করবেন।’ জবাব দিল করিম হোসেন।
— ‘আর হ্যাঁ, অয়ন, তোমার মহৎ কাজের জন্য তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।’ বললেন ষ্টেশন মাস্টার।
— ‘স্যার, আপনাকেও ধন্যবাদ।’
আল-আমিনকে কাছে ডেকে তার সাথে কোলাকুলি করল অয়ন। পকেটে থাকা বেতনের টাকাগুলো আল-আমিনের হাতে গুঁজে দিল সে। বলল, এগুলো দিয়ে কিছু কিনে খেয়ো। আল-আমিন প্রথমে না করলেও, অয়নের জেদে টাকাটা নিতেই হলো তাকে।
অয়ন ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল, স্কুল শুরুর আর বেশি দেরি নেই। অর্থাৎ, আজকের কোচিংটাও মিস। জলদি স্কুলের পথে হাঁটা দিল অয়ন।
৯.
পুরো ঘটনা শোনার পর সজীব প্রশ্ন করল,
— ‘তাই বলে তুই সব টাকা দিয়ে দিবি?’
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন তুই বেতন দিবি কীভাবে?’ প্রশ্ন বাকিদেরও।
— ‘কিছু বুঝতে পারছি না রে!’ ভ্রুযুগল কুঞ্চিত অয়নের।
— ‘কিছু তো একটা করতে হবে। এভাবে চুপ করে বসে থাকলে কোনো লাভই হবে না।’ অয়নকে শান্তনা দিল আবীর।
এরই মাঝে মাহীর হঠাৎ একটি আয়াতের কথা মনে পড়ল। আজ সকাল বেলা হুজুর যখন বাসায় পড়াতে আসেন, তখন এই আয়াতটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। আয়াতটি হলো-
‘তোমরা উত্তম কাজের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অগ্রসর হও।’ (সূরা বাকারাহ, ২ : ১৪৮)
আয়াতটি মনে পড়তেই একটি বুদ্ধি চলে আসলো মাহীর মাথায়। কানে কানে বাকিদের পুরো আইডিয়াটা খুলে বলল সে।
— ‘আরে, দারুণ আইডিয়া তো! এত সুন্দর একটা বুদ্ধি কীভাবে এল তোর মাথায়!?’ বিস্মিত সজীব।
মাহী বলল,
— ‘আরে, কী যে বলিস! এমন শত শত আইডিয়া আমি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বের করে দিতে পারব।’
— ‘বেশি অহংকার করিস না, মাহী। মনের ভেতর অণু পরিমাণ অহংকার থাকলেও কিন্তু জান্নাতে যেতে পারবি না।’ বলল ইমাদ।
— ‘স্যরি স্যরি, একটু মজা করছিলাম আরকি। কিছু মনে করিস না প্লিজ!’ হাসিমুখে জবাব দিল মাহী।
— ‘যাক সে কথা। এবার সবাই আসল কথায় মনোযোগ দে।’ আদেশের সুর আবীরের।
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, প্ল্যান অনুযায়ী সজীব, রক্বীব আর ইশরাক পুরো ক্লাসকে ঘটনাটা খুলে বলবি। অয়ন যেহেতু একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে, সেহেতু তাকে সাহায্য করাটা বন্ধু হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। অয়নের বেতনের ফি’টা আমরা সবাই মিলে দেব। যে যতটুকু পারে ততটুকু যেন সাহায্য করে। এরপর ইমাদ আর আবীর যাবে টাকা তুলতে। টাকা উঠানো শেষে সেটা জমা থাকবে অয়নের কাছে।’ সবাইকে প্ল্যানটা আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল মাহী।
সময় তখন ১২ টা ১০ মিনিট। আর মাত্র ২০ মিনিট পরই শুরু হবে ক্লাস। যা করার এই অল্প সময়ের ভিতরেই করে ফেলতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুতই কাজে নেমে পড়ল অয়নের বন্ধুরা। প্রথম দিকে তেমন একটা সাড়া পাওয়া না গেলেও শেষের দিকে সবাই সাহায্য করতে থাকে। ইমাদ আর আবীর টাকাগুলো গুনে দেখল মোট ৮’শ টাকা হয়েছে।
অয়ন বলল,
— ‘বেতনের ফি এক হাজার টাকা। কিন্তু এখানে তো দুইশ টাকা কম।’
— ‘হুম, এখন কারও কাছেই তো এত টাকা নেই। থাকলেও সেটা আমাদের দিয়ে দিলে, যে দেবে সেও হয়তো বেতন দিতে পারবে না।’ চিন্তিত ইমাদ।
— ‘এখন উপায়?’ হতাশ অয়ন।
— ‘কী রে মাহী, তোর মাথা না বুদ্ধির জাহাজ। এবার সমাধান বের কর।’ মাহীর উদ্দেশ্যে টিপ্পনী কাটল আবীর।
— ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। একটু সময়তো লাগবে না কি?’ উত্তর দিল মাহী।
রক্বীব বলল,
— ‘ক্লাস শুরু হতে তো বেশি দেরি নেই। তিন মিনিট পরই কিন্তু ক্লাস শুরু হবে।’
— ‘আচ্ছা আচ্ছা, বিষয়টা নিয়ে আর বেশি টেনশন করিস না। এতটুকু কাজ যখন হয়েছে বাকিটুকুও হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’ আশ্বাস দিল সজীব।
১০.
নাসির স্যারের মেজাজটা আজ খুবই ফুরফুরে। সকালে তার এক বন্ধু তাকে কল করেন। বন্ধুটি আর কেউ নন, সেন্ট্রাল বাসষ্ট্যান্ডের ষ্টেশন মাস্টার জনাব রফিক সাহেব। স্যার তার কাছ থেকে জানতে পারেন, তারই স্কুলের এক শিক্ষার্থীর এক মহৎ কাজের ঘটনা। ছাত্রটি কীভাবে একটি হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে তার ভাইয়ের কাছে ফেরত আনলো, তার পুরো বর্ণনা শুনলেন বন্ধু রফিক সাহেবের কাছ থেকে।
ক্লাস শুরুর ঘণ্টা পড়তে আর বেশি দেরি নেই। হাজিরা খাতা, কালো রঙের ডাস্টার আর দুটো মার্কার নিয়ে ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন নাসির স্যার।
নাসির স্যার ক্লাসরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় দুই মিনিট হলো। স্যার খেয়াল করলেন, তার ছাত্ররা কোনো একটি বিষয় নিয়ে খুবই ব্যস্ত। রীতিমতো জটলা বেঁধে আছে ক্লাসের পিছন দিকটায়।
— ‘আসসালামু আলাইকুম।’ ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য জোরে একটি গলা খাঁকারি দিয়ে সালাম দিলেন স্যার।
— ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, স্যার।’ সমস্বরে জবাব দিল ছাত্ররা।
স্যার ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন,
— ‘তোমরা কি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছ? এভাবে জটলা বেঁধে আছো যে?’
— ‘ইয়ে মানে, স্যার, অয়ন একটা সমস্যায় পড়েছে তো, তাই তার সমস্যাটা কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়েই আলোচনা করছিলাম।’ বলল মাহী।
— ‘তাই না কি অয়ন, কী সমস্যা হয়েছে তোমার?’ অয়নের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লেন স্যার।
— ‘আমি বলছি স্যার, কী হয়েছে।’ অয়ন জবাব দিতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করায়, সজীব উত্তর দিল।
স্যারকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল সজীব। সজীবের কথা শেষ হতেই মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল নাসির স্যারের। খুশিতে অয়নকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। স্যার বললেন,
— ‘কিছুক্ষণ আগেও আমার স্টেশন মাস্টার বন্ধু আমাকে ঘটনাটা সম্পর্কে কল করে জানিয়েছিল। সে বলেছিল, ছাত্রটি আমাদের স্কুলের। কিন্তু ছেলেটি যে আমাদের অয়ন সেটা জানতাম না।’
হঠাৎ মাহী প্রশ্ন করল,
— ‘কিন্তু স্যার, এখন বেতনের ব্যাপারটা কীভাবে সমাধান করা যায়?’
মাহীর প্রশ্ন শুনে মুচকি একটা হাসি দিলেন স্যার। তারপর বললেন,
— ‘তোমাদের একটা হাদীস বলি শোনো,
“বান্দা যতক্ষণ তার অপর ভাইকে সাহায্য করতে থাকে, ততক্ষণ আল্লাহও তাকে সাহায্য করতে থাকেন।”
(মুসলিম, নাসায়ি ও তিরমিযি)
স্যারের কথা শেষ হতেই পুরো ক্লাস হৈ হুল্লোড় জুড়ে দিল!