১.
বস্তির পোলাপানগুলো বেজায় বদ হয়ে গিয়েছে। ছোট ছেলেপেলেগুলোকে নিয়েও কীসব করে বেড়ায়। বাসায় আজকে বাবা নেই বলে আহমাদকে তার সাথে নিজের খালাম্মার বাসায় নিয়ে এল রাবেয়া। খালাম্মা বলতে রাবেয়া যার বাসায় কাজ করে সে। তিনদিন যাবৎ জ্বরে পুড়ছে রাবেয়া। দুইদিন কাজে যায়নি তাই। তার খালাম্মা এজন্য বেজায় নাখোশ। আজ যেতেই হবে। কোনো ধরনের বাহানা চলবে না, বলে দিয়েছেন খালাম্মা। ঝা চকচকে ফ্ল্যাট বাড়িটার ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে আহমাদকে।
আহমাদ বুঝতে পারছে না, কী করবে বসে বসে। মাকে কত করে বলল সে আসতে চায় না। আবেদন তো গৃহীত হয়নি, তার ওপর মাথায় কতগুলো চাটি পড়েছে। ড্রয়িং রুমের একটা টেবিলের ওপর কতগুলো খেলনা দেখতে পেল সে। সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। একটা ঘোড়া দেখতে পেল, সেটার ওপর একটা মানুষ বসা। এগিয়ে গিয়ে উঠিয়ে নিল খেলনাটা। কিছুক্ষণ এটার সাথেই সময় ক্ষেপণ করার সীদ্ধান্ত নিল সে। ঠিক তখনই খালাম্মা এসে হাজির। এসেই ধমক দিয়ে উঠলেন তিনি,
‘হাতে কী ওইটা তোর? মগের মুল্লুক পেয়েছিস, যা খুশি তাই করবি? চুরি করার ধান্দা, না?’
চিৎকার শেষ করে আহমাদের হাত থেকে খেলনাটা কেড়ে নিলেন তিনি। ততক্ষণে রাবেয়াও ভেতরের ঘর থেকে চলে এসেছে। জ্বরের প্রকোপে মাথাটা ভনভন করছে তার।
‘ছোটলোকের বাচ্চা সব তোরা। মিথ্যা বাহানা করে কাজে আসে না একজন আর তারই ছেলে এদিকে চুরি করছে।’
রাবেয়া তার খালাম্মার চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তার সাথে সবসময়ই বাজে আচরণ করেন তিনি। নিজের ছেলেকেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেনে সে। আর যাই হোক চুরির শিক্ষা সে ছেলেকে কখনো দেয়নি। খালাম্মাকে কিছু বলেও লাভ হবে না। এখানে তার দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কিছু করার নেই।
ততক্ষণে আহমাদের গালে দু চারটা চড়-থাপ্পড় পড়ে গিয়েছে। চকচকে মেঝের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। নিজেকে একটা অপদার্থ মনে হচ্ছে তার। হোক না এগারো বছরের শিশু, আত্মসম্মান তো আছে, না কি? গাল বেয়ে দু ফোঁটা নোনা পানি গড়িয়ে পড়ে নিচে। ঝকঝকে মেঝের ওপর অশ্রুবিন্দুগুলোকে শিশিরের মতো দেখায়।
‘খালাম্মা, মাফ কইরা দেন, ছোড পোলা বুঝে নাই।’ তামাশা না দেখতে পেরে কাকুতি বেরিয়ে এল রাবেয়ের মুখ থেকে।
‘নিজের অবস্থান বুঝিস না? তোরা ছোটলোক, ছোটলোকের মতো থাকবি। জানি তো তোদের স্বভাব ভালো না। চুরি করার জন্য তক্কে তক্কে থাকস। এই ছেলেকে আর কোনোদিন আনবি না, বুচ্ছস?’ ক্রোধান্বিত খালাম্মা বলে উঠলেন।
‘জে, খালাম্মা বুচ্ছি।’
কথা শেষ করেই মুখ ঝামটা দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন বাড়ির কর্ত্রী। হাটার মাঝে অস্বস্তিকর দাম্ভিকতা।
২.
রাবেয়া ভেবেছিল কাজ শেষে বের হয়ে ছেলেকে আচ্ছা ঝাড়ি দেবে। কিন্তু শরীরে তেমন শক্তি নেই। জ্বরটা কাবু করে ফেলেছে তাকে। এরকম দুর্বল কখনোই অনুভব হয়নি। হাটতেও হচ্ছে অনেক কষ্ট করে।
মায়ের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে আহমাদ। ছোট হলেও বুঝতে পারে যে মায়ের শরীর ঠিক নেই।
৩.
খালেদ ঘরের দরজার বাইরে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। স্ত্রী তার আজ দুপুরেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। সে ভেবেছিল, সামান্য জ্বর-ই তো। এমনিই সেরে যাবে। তিনদিন বিছানায় দিনাতিপাত করার পর দুপুরের দিকে আহমাদ বলল, তার মা না কি নড়ছে না। দৌড়ে ডাক্তার ডেকে এনেছিল সে। কিন্তু না, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। রূহ দেশান্তরি হয়ে গিয়েছে। ফিরিয়ে আনার সাধ্যি কারও নেই। ছোট আহমাদ তাকিয়ে আছে মায়ের নিথর দেহটার দিকে। দেখে মনে হয় ঘুমাচ্ছে।
৪.
মাসজিদের পাশের কবরস্থানটাতেই কবর দেয়া হবে রাবেয়াকে। শেষ বারের মতো মায়ের মুখখানা দেখে নিল আহমাদ। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার।
কবর ভরাট করছে খালেদ। মায়ের কবরের কয়েক কদম সামনেই আরেকটা খোড়া কবর দেখতে পেল আহমাদ। কিছুক্ষণ পরই কিছু লোক একটা লাশ নিয়ে এল। দলটার সাথে একটা বাচ্চাও দেখতে পেল সে। হ্যা চিনতে পেরেছে। তার মা যার বাসায় কাজ করে তার ছেলেই তো এটা। ছোট বাচ্চা। বুঝে উঠতে পারছে না ঘটনাপ্রবাহ। পেছনদিকের লোকগুলো কী যেন বলাবলি করছে। একজনের গলার আওয়াজ কানে এল আহমাদের।
সাথে একটা বাচ্চাও দেখতে পেল সে। হ্যা চিনতে পেরেছে। তার মা যার বাসায় কাজ করে তার ছেলেই তো এটা। ছোট বাচ্চা। বুঝে উঠতে পারছে না ঘটনাপ্রবাহ। পেছনদিকের লোকগুলো কী যেন বলাবলি করছে। একজনের গলার আওয়াজ কানে এল আহমাদের।
‘আহারে, মহিলাটার বয়স অনেক কম ছিল। গাড়ি এক্সিডেন্ট করে আজকে সকালেই চলে গেল। তার স্বামীটা বেঁচে গিয়েছে। হাত আঘাত পাওয়া বাদে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ছোট বাচ্চাটার কী হবে এখন?’
আহমাদ বুঝতে পারল, ওই খাটিয়ার সাদা কাফনের ভেতরে তার মায়ের খালাম্মাই ওটা। পড়ন্ত বিকেলে লালচে আকাশের নিচে কিছুক্ষণ আগেও জীবিত থাকা দুটো দেহকে গ্রাস করছে কবরের মাটি। দুজন দুরকম পৃথিবীর বাসিন্দা। খালাম্মার ভাষায় একজন ছোটলোক, আরেকজন আলিশান ফ্ল্যাটের কর্ত্রী। কিন্তু অন্তিম ঠিকানা দুজনের একই। পোকামাকড় আর কীটের বসবাস যেই মাটির তলদেশে সেখানে। এক অনন্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল আহমাদ।
কাহিনি শেষ করে দূরে কলাগাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন জমিরউদ্দিন। মুনির আর মাসুদ যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কিছু সময় পর মাসুদ বলল, ‘সত্যি কইরা কন তো হুজুর, ওই আহমাদ পোলাটা কি আপনে?’
মুচকি হাসেন জমিরউদ্দিন আহমাদ। যেন হাসিতেই উত্তর পেয়ে যায় মাসুদ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জমিরউদ্দিনের দিকে। জমিরউদ্দিন মাসুদের চোখের দিকে তাকালে গভীরতা খুজে পেতেন। কিন্তু লতিফের দৃষ্টির মতো খেই হারিয়ে যায় না সেই গভীরতায়। বরং তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। যেখানে আশা আর বিশ্বাসের আভাস পাওয়া যায়, সেখানে খেই হারাবে কেন কেউ।