এই স্বাধীনতা চেয়েছিলে বুঝি? ভালোবাসার প্রতিদান বুঝি এভাবে দিতে হয়? বহুতল ভবনের ফুটপাতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা, থ্যাঁতলানো শরীর, খুলি ফেটে চৌচির, মগজ এদিকসেদিক ছড়ানো?

পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করত তোমার, ভালোবাসতে ঐ নীল আকাশ আর একদুপুর স্বাধীনতা। দশতলা ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিলে যখন, তখনো কি ভালোবেসেছিলে ঐ আকাশ? মিটেছিল কি ডানা মেলে উড়বার সাধ?

শুরুটা হয়েছিল ফাগুনের দিনে। কী ছিল না সেদিন? প্রহর শেষের রাঙা আলো, বাতাসে মাতাল সুবাস। প্রেমে পড়ার জন্য এরচেয়ে উপযুক্ত দিন আর হয় না। প্রেমে পড়লে তুমি। প্রেমে পড়লে প্রথম এবং শেষবারের মতো। সেদিন কেউ কি জানত মায়াবী এই ফাগুনের ক্ষণ কী কাল হয়ে দাঁড়াবে তোমার জন্য?

এরও কিছুদিন আগে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত বাইক তোমাকে কিনে দেওয়া হলো। বাইকের জন্য কত পাগলামিই না তুমি করেছ! দিনের পর দিন ভাত খাওনি, মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছ, ভাইয়া যখন বোঝাতে গিয়েছে, ‘আরেকটু বড় হ! তারপর বাবা তোকে বাইক কিনে দেবেন। বাবার ওপর এখনি অত চাপ দিস না। টানাটানির সংসার…’, ভাইয়াকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলেছ তুমি। বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে রেখেছিলে।

বাইকের পেছনে তোমার জানের জিগরি দোস্তকে বসিয়ে রাউন্ড দিচ্ছিলে তুমি সেদিন। হঠাৎ করেই তোমার চোখ পড়ল তার ওপর; তোমার হলুদ বসন্ত পাখি। কলেজের ইউনিফর্ম পরা। ওড়নাটা প্যাঁচ লেগেছে রিকশার হুডের সঙ্গে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্যাঁচ খোলার, কিন্তু প্যাঁচ খুলছে না। ছোটখাটো একটা জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। রিকশার টুংটাং, সিএনজির হর্ন তাড়া দিচ্ছে। সে একবার প্যাঁচ খোলার চেষ্টা করে, আরেকবার জ্যামের দিকে চেয়ে বিব্রত হাসি দেয়। সেই হাসি দেখে তোমার একটা হার্টবিট মিস হলো। তুমি প্রেমে পড়লে!

তাহসান গান আর নাটকে তোমাকে প্রেম করা শেখালো। আরও কত কিছু শিখলে তুমি! রাত জেগে ফোনে কথা বলা, বাবার পকেট কাটা, মায়ের কাছে মিথ্যে বলা, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া। হাল ফ্যাশনের হেয়ারকাট, ছেঁড়া জিন্স, হাতে বালা—পুরুষ হতে চাইবার তোমার কত চেষ্টা! হররোজ তোমার হলুদ বসন্ত পাখিকে বাইকের পেছনে বসিয়ে স্পিডোমিটারের কাটা ছোঁয়াতে লাগলে তুমি নব্বইয়ের ঘরে। ভাবতে লাগলে, ‘জীবন তো এটাই, এই তো স্বাধীনতা, এই তো দু’ডানা মেলে আকাশে উড়া, এই তো হলুদ বসন্ত সুখ!’

এরপর আসলো রুদ্রঝড়। সেই ঝড়ে অচিন হয়ে গেল তোমার হলুদ বসন্ত পাখি। একদিন তোমার যে হাত তুমি রাখতে চেয়েছিলে আরেকটা নরম মেহেদিরাঙা হাতের ওপর, তোমার শীতার্ত হৃদয় ভালোবাসার উষ্ণতা শুষে নিতে চেয়েছিল, সেই হাতেই তুমি খুলতে শুরু করলে ফেন্সিডিলের বোতল। গাঁজা, হিরোইন কিছুই বাদ দিলে না। চুলে জট বাঁধল, তোমার গা দিয়ে দুর্গন্ধ বের হতে লাগল। আজীবন ফার্স্ট হয়ে আসা তুমি ফেইল করলে এক সাবজেক্টে। তোমার বাবা অফিসে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও রাতে ঘুমাতে পারেন না তোমার চিন্তায়। ভাবেন, ‘কী ভুল ছিল আমার?’ মা নীরবে চোখের পানি ফেলেন। আহা! জনমদুঃখিনী মা।

তারপর যেদিন তুমি শুনলে, তোমার হলুদ বসন্ত পাখি এক বাজপাখির সঙ্গে উড়াল দিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়, সেদিন কঠিন সে সিদ্ধান্তটা নিলে তুমি। গাঁজার কল্কিতে শেষ সুখটান দিলে। তারপর একে একে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসলে দশতালার ছাদে। পাখির মতো মেলে ধরলে দু’ হাত। তোমার সামনে ইট, কাঠ, পাথরের এক শহুরে আকাশ আর এক শহুরে মুক্তি। চিরকুটটা চাপা পড়ে রইল এস্ট্রের নিচে—ভালোবাসার জন্য আমি এই জীবন বিসর্জন দিলাম! 

তোমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনগুলো মনে পড়ে খুব। আম্মা একদিন সন্ধ্যায় এসে বলল, ‘পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ওদের দুইটা ছেলে আছে। বড়টা তোর বয়সীই হবে। পরিচিত হয়ে নিস।’ 

তোমার ভাই নাহিদের সঙ্গে সেদিন রাতেই মোড়ের চায়ের দোকানে পরিচয় হয়ে গেল। পরিচয় হবার দশ মিনিটের মধ্যেই সে দুম করে আমার কাছে টিউশনি চেয়ে বসল। আমি অবাক হলাম; বুঝলাম, তোমাদের সংসার টানাটানির। তোমার  বাবার বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করতে চায়। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা আর মলিন, পুরোনো পাঞ্জাবি পরা সহজ-সরল ছেলেটাকে আমার এক নিমিষেই ভালো লেগে গিয়েছিল। কেন জানি তখন নিজেকে অনেক ছোট মনে হলো। আমার বয়সী একটা ছেলে এত কষ্ট করছে, আর আমি গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরাফেরা করে বাপের অন্ন ধ্বংস করছি। একটু বড় হতে মন চাইল। আমার একমাত্র টিউশনিটা দিয়ে দিলাম তোমার ভাইকে। কয়দিন পরে অবশ্য ঠিকই একটা টিউশনি পেয়ে গিয়েছিলাম, আগেরটার চেয়ে ভালো। এই আত্মভোলা মানুষটা তোমাকে কতটা ভালোবাসতো তুমি কোনোদিন বুঝোনি। 

প্রায়দিনই ‘এত সকালে খিদে নেই’ বলে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে টিউশনিতে যেত। সকালের দুটো রুটির সঙ্গে ডিমভাজির পুরোটাই যেন তুমি পাও, এজন্যেই সে এই অভিনয়টুকু করত। রোজ বুধবার দুপুরের পর ক্লাবের মিটিংয়ে কেক, মিষ্টি আর কলা দিত। সে ব্যাগে লুকিয়ে সেগুলো তোমার জন্য নিয়ে আসতো। তুমি খেতে তার সামনে বসে, এতেই তার খাওয়া হয়ে যেত।

তুমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ো। তোমার সহপাঠী গালিবকে তার বিলাতফেরত ভাই শিয়ালকোটের ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিয়েছিল। খেলার মাঠে গালিবের হাতে সেই ব্যাট দেখে তোমার ঐরকম একটা ব্যাট কেনার ইচ্ছে হলো। সাহস করে বাবাকে বলতে পারলে না। বললে তোমার ভাইকে, ‘ভাইয়া, একটা ব্যাট কিনে দাও না!’ তোমার ভাইয়ের পকেট তখন গড়ের মাঠ। পায়ে হেঁটে টিউশনিতে যায়। বাস ভাড়াটুকুও নেই। তারপরে কীভাবে কীভাবে তোমাকে যেন একটা ব্যাট কিনে দিয়েছিল সে। এই ব্যাট দিয়ে মেরেই তুমি একবার তোমার ভাইয়ের মাথা ফাটিয়েছিলে।

একদিন তোমার হলুদ বসন্ত পাখিকে নিয়ে তুমি ওমর ভাইয়ের ফুচকার দোকানে ফুচকা খাচ্ছিলে। দেখে ফেলে তোমার বাবা। সেদিন রাতে বাবা তোমাকে কড়া কিছু কথা শোনায়। অভিমান করে তুমি ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার ভাই, গভীর রাতে তোমাকে ডেকে তুলে। নরম কথায় তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তুমি বিরক্ত হও। তবুও সে কথা চালিয়ে যেতে থাকে। ভাত খাবার অনুরোধ করে। তুমি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করো, শুরু করো ধাক্কাধাক্কি, একপর্যায়ে ব্যাট দিয়ে মেরেই বসলে। দশটা সেলাই পড়েছিল তোমার ভাইয়ের মাথায়।

আরেকদিনের কথা। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সিঁড়িতে। ইফতারির ঠিক পর পর, চাঁদ রাত ছিল বোধহয়। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। মুখ শুকনো। দেখে মনে হচ্ছিল বেশ ক্লান্ত। জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল সে, ‘আর বইলো না! বড়লোকের রঙের কাহিনি, দুই মাস ধরে টিউশনির টাকা দেয় না। টাকা দিবে বলে আজকে অনেকক্ষণ বসাইয়া রাখছিল ড্রয়িংরুমে। ইফতারির সময় হয়ে যাইতেছে তাও কেউ কিছু বলে না। আমি যে একটা মানুষ, ড্রয়িংরুমে বইসা আছি এক দেড় ঘণ্টা ধরে কেউ মনে হয় চোখেই দেখেনি। লাস্টে ইফতারির ১০-১৫ মিনিট আগে ছাত্রের মা এসে হাসিমুখে বলল, ‘বাবা নাহিদ! একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, আমাদের ইফতারির পরে জুয়েলারি কিনতে যেতে হবে, আগামীকাল ঈদ বুঝতেই পারছো। কিছু মনে কইরো না বাবা, ঈদের পরে এসে টাকাটা নিয়ো’। আমি বহু কষ্টে মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম, ‘ঠিক আছে আন্টি, সমস্যা নেই’। কী ছোটলোক দেখো, আমাকে একবারের জন্যও ইফতার করতে বলল না, ওরা বললেও অবশ্য আমি ইফতারি করতাম না’।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার হাতে কী?

ও বলল, পাঞ্জাবি।

‘তোমার জন্য’?

‘না’।

‘তাহলে?’

‘কার আবার! আমার ছোট্ট ভাইটার জন্য’।

পাঞ্জাবি কেনার টাকা কোথায় পেলে জিজ্ঞাসা করাতে সে রহস্যময় একটা হাসি দিয়েছিল। চেপে ধরার পর বলেছিল, ’তার এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছে’।

এই পাঞ্জাবিটাই ছিল তোমার থ্যাঁতলানো শরীরে। রক্ত জমাট বেঁধেছিল। তোমার সেই রক্ত মেশানো পাঞ্জাবিটা জড়িয়ে ধরে এখনো তোমার ভাই কাঁদে।

বাহ! খুব বড় বাহাদুর তুমি, ভালোবাসার জন্য জীবন দিয়েছ! তালিয়া, ইস বীর বাহাদুরকে লিয়ে বহুতই তালিয়া!

সামান্য একটা মেয়ের ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয়ে ভুলে তুমি জীবন দিলে, আর এই অকৃত্রিম ভালোবাসা তোমার চোখেই পড়ল না! আহারে প্রেমিক পুরুষ, ভালোবাসার তুমি কিছুই বুঝো না!

তোমার বাবা... রাতজাগা ট্রেনের হুইসেলে হুঁশ ফিরল। কী পাগলামি করতে বসেছি আমি এই রাতদুপুরে। এমন একজনকে লিখতে বসেছি, যার কাছে কোনোভাবেই পৌঁছানো সম্ভব না।

সশব্দে ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলাম। সবকটা জানালা খুলে দেবার পরেও ঘরের বাতাসে গুমোট লাগছে। বিষণ্ণ নিয়ন আলোয় ভেসে যাচ্ছে ফাঁকা ফুটপাত। অন্ধকার ঘর যেন আততায়ীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর বিভীষিকাময় স্মৃতিগুলো নিয়ে। সুনিপুণভাবে যন্ত্রণার হুল ফোটাতে লাগল আপাদমস্তক। ভুলে থাকতে চাইছি বীভৎস রক্তাক্ত লাশের কথা, নাহিদের চোখের জল, আংকেলের শূন্য চাহনি, আন্টির আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া কান্না... পারছি না কিছুতেই। অসহায় লাগছে। রাগ লাগছে। প্রচণ্ড ক্রোধে সুনীলের কবিতার মতোই দু চারটা নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে কাঁচের চুড়ির মতো গুড়ো গুড়ো করে ফেলি এই পৃথিবী।

হঠাৎ টের পেলাম প্রচণ্ড ঘেমে গিয়েছি আমি।

তারও কিছুক্ষণ পরে টের পেলাম, আমি কাঁদছি।

কোনো মানে হয়?

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]