১.

ভোরের রেখাটা তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। আঁধারের চাদরটা একটু একটু করে সরতে শুরু করেছে মাত্র। ফজরের জামায়াতটাও এই কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে।

একটু পর শুরু হলো পাখিদের কিচিরমিচির। মুক্ত আকাশে পাখিগুলোর মিষ্টি কোলাহল আর পূব আকাশে একটু একটু করে উঁকি দেওয়া সূর্যি মামার মিশেলটা হ্রদয় ছুয়ে যাওয়ার মতো। প্রিয় নগরীর ব্যস্ততম সড়কগুলো বলতে গেলে তখন একেবারেই ফাঁকা। মাঝে মাঝে দুয়েকটা দানবরূপী ট্রাক আর ইয়া বড় বড় কন্টেইনার বাহনগুলো ছুটে যাচ্ছে রাস্তার মাঝ দিয়ে, অন্যসময়ের চেয়ে প্রায় কয়েকগুণ বেশি বেগে।

নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন আদনান। আদনান শরীফ। থাকেন এই সদরঘাটেই। মাস্টার্স অবধি পড়াশোনা করা এই আদনান চাকরি করেন পতেঙ্গার একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে। বেতন ষোলো হাজার দু'শো টাকা। আচ্ছা, অল্প এই কয়েকটা টাকা দিয়ে কি এই ইট পাথরের নগরীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায়? একটু কষ্ট হয়তো হয়, কিন্তু আদনানের তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। আল্লাহ যদি সম্পদে বরকত দেন, তাহলে সংখ্যাটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।

আদনানের পরিবার বলতে গেলে খুব ছোটই। মা, স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়ে নামিরাকে নিয়েই আদনান ভাড়া থাকেন দু' কামরার একটা টিনশেড বাসায়। বাবাকে হারিয়েছেন ছোট্টবেলায়। সেই ছোটবেলা থেকেই মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে আদনানের বেড়ে ওঠা, পড়াশুনা শেষ করা, সবকিছুই। ভালোই চলছিলো সব।

কিন্তু সমস্যাটা হয় এর পর। সিভি, অ্যাপ্লিকেশান লেটার নিয়ে অসংখ্য দৌড়ঝাঁপ, অসংখ্যবার ভাইভা ফেস করার পরও কোনো জায়গায় ভালো একটা চাকরি মিলছিল না তার। শেষ পর্যন্ত অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে একটা চাকরি পাওয়া যায় পতেঙ্গার সেই গার্মেন্টসে। দ্রুত রেডি হয়ে কাজে নেমে পড়ে সে।

মসজিদ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের বাসষ্ট্যান্ডটার নিচে এসে দাঁড়ালো আদনান। মিনিট দশেকের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেল জায়গাটা। গুটি কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই গার্মেন্টসের চাকরিজীবী। সকাল ছ’টার মধ্যেই তাদের অফিসে এসে পৌঁছতে হবে। অফিসগুলোও অনেক দূর। তাই এত তাড়াহুড়ো করে, খাওয়া-আধাখাওয়া পেট নিয়েই সবার হাজির হওয়া। পাশের দোকানটা অবশ্য সকাল থেকেই খোলা পাওয়া যায়। যারা একদমই খেয়ে আসার সময় পান না, তাদের জন্য এই দোকানটাই একমাত্র সম্বল।

পাশ দিয়ে একজন হকার হেঁটে যেতেই, তাকে থামালো আদনান।

‘কাকা,আমাকে একটা পেপার দিন তো; আর এই নিন আপনার টাকা।’

হাতের পেপারের ভাঁজ থেকে একটা পেপার বের করে দিল সেই হকার। টাকাটা পকেটে পুরেই হাঁটা দিল সে।

বাসে বসে পত্রিকা পড়াটা আদনানের নিয়মিত একটা অভ্যাস। ফলে, মাঝখানের সময়টা অনয়াসেই কেটে যায় তার।

একটু পরেই চলে এলো বাস। সবাই উঠে পড়ল বাসে। বাস একেবারে ‘ফিলআপ্ড’। চলতে শুরু করল গাড়িটা। খবরের কাগজে একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল আদনানের। ‘মাদকের টাকা জোগাতে না পেরে আত্মহত্যা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর।’

শিরোনামটা দেখেই মন খারাপ হয়ে গেল তার। প্রতিদিন আর এসব খবর শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। পেপারটা ভাঁজ করে রেখে দিল একপাশে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ দুটো বুজে মাথাটা এলিয়ে দিল সিটে।

২.

বাসটা তখন টাইগারপাস এসে পৌঁছেছে। কয়েকজন যাত্রী নেমে গেল সেখানে, বিপরীতে দু'জন উঠল। এক ভদ্রলোক এসে বসল আদনানের পাশের সিটটায়।

‘আরেহ, বুলবুল ভাই না? আস্সালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনি?’

‘আরেহ, আদনান নাকি, ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। তোমার কী খবর?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভাই, আপনার সাথে তো অনেকদিন হলো দেখা হয় না।’

‘আসলে গত কয়েকমাস ধরে একটু ধকল যাচ্ছে বেশি। অফিসের কাজ এখন কয়েকগুণ। একটা সিক্রেট মিশন হাতে নিয়েছে অধিদপ্তর। তাই আশপাশ থেকে নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখা। যাই হোক, পরিবারের সবাই ভালো আছে তো, তোমার চাকরিটার কী খবর?’

এভাবেই অনেকক্ষণ কথা চলতে থাকে দু’জনের। বাসটা তখন গোসাইলডাঙ্গা, সল্টগোলা পেরিয়ে ইপিজেড এসে পৌঁছেছে। সামনেই সিমেন্ট ক্রসিং। হেল্পাার যখন  হাঁক ছাড়ল ‘এ ক্রসিং, ক্রসিং। ক্রসিং আছেননি?’, তখন নড়েচড়ে বসল বুলবুল আহমেদ।

‘এই থামাও থামাও, নামিয়ে দাও আমাকে।’ উঠে দাঁড়াল বুলবুল। 

‘আদনান, আজ তাহলে যাই। মিশনের কাজটা শেষ হলেই একদিন তোমাদের ওখানে যাব।’

‘আচ্ছা ভাইয়া, মনে করে আসবেন তাহলে।’

‘ঠিক আছে, আদনান। আল্লাহ হাফিজ।’

‘আল্লাহ হাফিজ, ভাইয়া।’

বুলবুল আহমেদ, আদনানের বন্ধু নাঈমের বড় ভাই। নাঈম আর আদনান এক স্কুলেই পড়ত। অনেক ভালো বন্ধু ছিল দুজন। সেখান থেকেই নাঈমের পরিবারের সাথে আদনানের ঘনিষ্ঠতা। গার্মেন্টসের চাকরিটার খোঁজ দিয়েছিলেন এই বুলবুল ভাই-ই।

৩.

ক্রসিং পেরিয়ে কিছুদূর যেতেই যে বড় ব্যাংকটা পড়ে, তার ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওই পাড়ে বারকোডের কফিশপ। নতুন খোলা সেই কফিশপটাতে এসে বসেছে বুলবুল। তাও প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে। ‘না, ছেলেটার তো এত দেরি করার কথা না।’ মিনিট পাঁচেক পর একটা ছেলেকে কফিশপের ভিতর ঢুকতে দেখলে বুলবুল। ছেলেটা এগিয়ে আসছে তার টেবিলের দিকে।

‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আজ একটু দেরী হয়ে গেল।’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম, ইন্তেসার। তোমাকে কিন্তু আগেও বারণ করেছি, আমাকে স্যার বলে না ডাকতে। ভাই বলবে; বুলবুল ভাই। তা দেরী হলো যে আজ?’

‘আর বলবেন না স্যা...। সরি সরি, বুলবুল ভাই, আসলে রাতে আমি বাসায় ফিরতে পারিনি। শহরমুখী গাড়িও পাচ্ছিলাম না। তাই ক্যাম্পাসের হলেই রাতটা কাটাতে বাধ্য হলাম। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতেই দেরী হয়ে গেল।’ থামল ইন্তেসার।

‘ক্যাপাচিনো অর্ডার দেওয়া যাক দু'কাপ? এখানকার এই একটা জিনিসের খুব সুনাম।’

‘ওকে ভাই।’

ইন্তেসার জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী। আর বুলবুল আহমেদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন সিনিয়র অফিসার। তাদের পরিচয় সূত্রপাতটা হয় আগে, একটা অভিযানের সময়। গত কয়েক মাস আগে রেলস্টেশন বস্তিতে একটা মার্ডার হয়। মাদক চোরাচালান নিয়ে দু’গ্রুপের একটা সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে। তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক অভিযানও পরিচালনা করা হয় সেখানে। কিন্তু ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা লাপাত্তা হয়ে যায়। একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। খবর পাওয়া যায় পাশেই একটা মেস আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রের। সেখানকারই কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রাগ সাপ্লায়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ঘটনার সাথে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকলেও থাকতে পারে। তবে সেই ছাত্ররা আগে থেকেই ঘটনা টের পেয়ে গেলে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু মেসের কিছু নিরীহ ছাত্র, যারা ঘটনার কিছুই জানত না তারা সেদিন আটক হয় পুলিশের হাতে। তাদের মধ্যে ইন্তেসারও একজন।

অবশ্য, জিজ্ঞাসাবাদ আর অনুসন্ধানে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাদের বিরুদ্ধে। ঠিক তখনই একটা ফোন আসে থানার ওসি সাহেবের কাছে। ফোন করেছিলেন শহরের বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যবসায়ী জনাব মাহবুব মোর্শেদ খান। ইন্তেসার তার একমাত্র সন্তান। তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো পুলিশ। তাছাড়া, ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি, আগেও কোনো অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে নেই। সুতরাং, এখানে শুধু শুধু আটকে রাখার কোনো মানে হয় না।

ঘটনার কিছুদিন পরপরই ইন্তেসার নিজে বুলবুল আহমেদের অফিসে আসে দেখা করতে। সেদিনের সেই আলাপের পর কিছুটা অনুশোচনাবোধ কাজ করে বুলবুলের মধ্যে। যে ছেলেটা এত প্রকটভাবে মাদকমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখে তাকে কি না বুলবুলরা গ্রেপ্তার করেছিল ড্রাগ সাপ্লায়ার চেইনের সদস্য মনে করে।

সেদিন অনেক কথা হয় দু’জনের। বুলবুল এটা জেনে অবাক হয় যে, জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ইন্তেসার অনেকদিন ধরেই মাদকের বিকল্প কিছু একটা তৈরি নিয়ে কাজ করছে, যেটা নিয়মিত সেবন করলে অনেক কড়া ডোজের মাদকাসক্তরাও ধীরে ধীরে এই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চার থেকে শুরু করে মেডিকেলে সার্জনসহ অত্যন্ত মেধাবী কিছু ছাত্রকে নিয়ে একটা টিম এই কাজটা করে যাচ্ছে, অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে। সেদিনকার সেই আলাপে বিষ্ময়ে বিমোহিত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না বুলবুলের।

মিনিট দশেক পরেই দুটো কাপ নিয়ে হাজির হলো ওয়েটার। ট্রে থেকে নামিয়ে একটা কাপ এগিয়ে দিল বুলবুলের দিকে, আরেকটা ইন্তেসারের দিকে।

‘আচ্ছা ভাইয়া, আপনার বাবা তো একজন ডাক্তার। আপনার মাও একজন ডেন্টালিস্ট। তাহলে আপনি ডাক্তার না হয়ে সরকারি অফিসের চাকরিজীবী হতে গেলেন কেন?’

‘সেটা অনেক বড় ঘটনা, ইন্তেসার। যাই হোক, প্রশ্ন যখন করেছ, তখন উত্তর তো দিতেই হবে।’

বুলবুল ভাইয়ের কথায় একটু নড়েচড়ে বসলে ইন্তেসার। শার্টের পকেট থেকে একটা খাম বের করলে বুলবুল। এগিয়ে দিল ইন্তেসারের দিকে। খামটা খুলে ভিতরের কাগজটা বের করল সে। পড়তে শুরু করল ইন্তেসার,

‘একটা কাজে সেদিন আন্দরকিল্লা যাচ্ছিলাম। কাজটা শেষ করে যেই বের হলাম, দেখলাম একটা লোক আমার শার্টটা টেনে ধরল পেছন থেকে। পিছন ফিরলাম, চিনতে পারলাম না লোকটাকে। আসার সময়ও লোকটা আমাকে খেয়াল করছিল। ভালো করে তাকালাম, উসকোখুসকো চুল, ময়লা গোঁফ, আর মলিন চেহারার ভেতর যে ছেলেটাকে আবিষ্কার করলাম, সে আর কেউ নয় আমাদের নাঈম। জড়িয়ে ধরলাম সাথে সাথে। হু হু করে কেঁদে ফেলল ছেলেটা। ওর সাথে আজ দশ দশটা বছর পর দেখা। নাঈম আর আমি একই স্কুলে পড়তাম। খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। ক্লাসের সেরা দশের মধ্যে নাঈম কোনো-না-কোনো একটা পজিশনে থাকতই। কিন্তু হঠাৎ করেই রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে তার। এর কারণ অবশ্য আমরা জানতাম। এলাকার বাজে কিছু ছেলের সাথে ওর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল হঠাৎ করে। ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে নাঈম। প্রথম প্রথম সিগারেটে দু-একটা টান, তারপর পুরোদস্তুর সিগারেট-আসক্ত। অতঃপর গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ, সবশেষে ইয়াবা। নেশার টাকা জোগাতে গিয়ে হয়ে ওঠে অপরাধ জগতের শীর্ষ সদস্য।’

এতটুকু পড়েই কাগজ থেকে মাথা উঠাল ইন্তেসার। তাকালো বুলবুলের দিকে। এরপর আবার মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগল কাগজটা।

‘এভাবেই ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে আমাদের নাঈম। ওর কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে হঠাৎ একদিন নাঈমকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন বাবা ডা. আনোয়ার আহমেদ। পরিবারের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় নাঈমের। ডা. আনোয়ার ফ্যামিলিসহ চলে যান ঢাকায়। কিছুদিনের মধ্যেই মাদকাসক্ত নাঈমের শরীরে ধরা পড়তে শুরু করে নানা ধরনের রোগ। টাকার অভাবে যেখানে নিজের নেশার টাকাই যোগাড় করতে পারছিল না, সেখানে চিকিৎসা করানোর চিন্তা, সে তো অনেক দূরের কথা। যাই হোক, সেদিন নাঈমকে পাশের একটা হোটেলে ভালো করে খাইয়ে হাতে পাঁচ হাজারটা টাকা দিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। টাকাটা হাতে গুঁজে দিয়েই বিদায় নিলাম ওর কাছ থেকে। বলেছিলাম যে, কয়েকদিন পর আবার আসবো দেখা করতে। আমার টাকাটা নিয়ে সে সেদিন হাসপাতালেই গিয়েছিল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ পর আদনানের ফোন পেয়ে শুনলাম নাঈম আর বেঁচে নেই। খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সাথে সাথে। মনে হচ্ছিল মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।’

লেখাটা পড়ে শেষ করল ইন্তেসার। তাকালো বুলবুলের দিকে। বুলবুলের চোখের দু ফোঁটা অশ্রু চোখ এড়ালো না ইন্তেসারের। নাঈম নামে যে বুলবুলের এক ভাই ছিল সেটা আগে থেকেই জানত সে। কিন্তু নাঈমের মৃত্যুটা কীভাবে হয়েছিল সেটা জানতো না আগে।

চোখের অশ্রু মুছেই বুলবুল বলল, ‘লেখাটা নাঈমের এক বন্ধু ইফতেশামের। নাঈমের মৃত্যুর পরদিন একটা চিঠির সাথে এই লেখাটা পাঠিয়েছিল আদনান, নাঈমের আরেক বন্ধু। তখন আমরা ঢাকায় থাকি। আমরা মানে আমি, মা আর বাবা। মা সেদিন অনেক কেঁদেছিল, বাবাও ভেঙ্গে পড়েছিলেন খুব। সেদিন থেকেই প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, আর কারও পরিণতিই আমার ভাইয়ের মতো হতে দেবো না। মূলত এ জন্যই আমার এই পথে আসা।’

‘দুঃখিত ভাইয়া, আমি এসব কিছু জানলে আপনাকে এই প্রশ্ন করতাম না।’

‘না, না, সমস্যা নেই, ইন্তেসার। যাই হোক এবার বলো, মিশনের কাজের কতটুকু অগ্রগতি হলো।’

‘হুম, কাজ ভালোই এগুচ্ছে। আমাদের রিসার্চ টিম ওই এন্টিড্রাগ মেডিসিনটা প্রায় বানিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু এক্সপেরিমেন্টের কাজটাই বাকি।’

‘হুম... চমৎকার। আমরাও কয়েকজন মাস্টারমাইন্ডকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এদের নির্দেশে শতশত এজেন্ট ড্রাগ সাপ্লাই এবং ড্রাগ বিজনেসের কাজ করে যাচ্ছে গোপনে গোপনে।’

‘এদের তো নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতা, ভাইয়া। তাহলে...’ কথা পুরোপুরি শেষ হতে দিল না বুলবুল।

বুলবুল বলল, ‘দেখো ইন্তেসার, আমি আমার কাজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো বাধা যদি আসে, আমি আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। দেখা যাক, শেষ লড়াইয়ে কারা জেতে।’

কফির কাপ দুটো এখন শূন্য। খানিক বাদে ওয়েটার এসে একটা ট্রেতে করে কাপ দুটো নিয়ে গেল। সাথে টেবিলে দিয়ে গেল একটা মেমো স্লিপ। চেয়ার থেকে উঠল দুজনেই। ওদের আলোচনা আজ এ পর্যন্তই। বিলটা পরিশোধ করে বাইরের দিকে পা বাড়ালো ওরা।

৪.

আদনানের একমাত্র মেয়ে নামিরা ভীষণ অসুস্থ। নামিরা আজ হাসপাতাল ভর্তি সপ্তাহখানেক হলো। এই কদিন সব ঠিকঠাকই ছিল; কিন্তু বিপত্তিটা হয় এরপর দিন। ডাক্তার এসে বলেন, ‘আপনার মেয়ে কিডনির রোগে আক্রান্ত। ওর একটা অপারেশন করাতে হবে জলদি। দ্রুত অপারেশনের টাকা জমা দিন হাসপাতালে।’

ডাক্তারের কথা শুনেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আদনান। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। একে তো সীমিত আয়, তার ওপর মেয়ের চিকিৎসার জন্য এতগুলো টাকা এত অল্প সময়ে কীভাবে জোগাড় করবে সে। কিন্তু হার মানলো না আদনান। যে করেই হোক নামিরার চিকিৎসার টাকা সে জোগাড় করবেই। আদনানের স্ত্রী রেশমি, তারও চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু না, তারপরও টাকাটা জোগাড় হলো না। এভাবেই দুটো দিন চলে গেল। আদনানের অবস্থা পাগল প্রায়।

দুদিন ধরে একটা ছেলের মেডিকেলের করিডোর দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করাটা চোখ এড়ালো না রমিজের। রমিজ, সবাই ডাকে বিচ্ছু রমিজ। মাদক ব্যবসার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় একবার জেলেও যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অদৃশ্য শক্তিবলে আবার ফিরে আসে এই লোকালয়ে। রমিজ আবার মেতে ওঠে তার পুরোনো অপরাধে।

সারাদিন শত চেষ্টা করেও টাকাটা জোগাড় করতে পারল না আদনান। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে একটা বড় গাছের ছায়ায় এসে বসল সে। পেছন থেকে একটা হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করতেই পেছন ফিরল সে। টাক মাথা লোকটার চোয়াল কিছুটা ভাঙ্গা, পানের পিকের লাল রঙে লোকটার পুরো মুখ ভর্তি। পরনে একটা নীল শার্ট আরেকটা চেক লুঙ্গি। ইনিই বিচ্ছু রমিজ। মুখ থেকে পানের পিকটা ফেলেই রমিজ বলল, ‘ভাইজানের কি কোনো সমস্যা হইছে না কি? দুইদিন ধইরা দেখতাছি মেডিকেলের করিডোর ধইরা ছোটাছুটি করতাছেন!’

রমিজকে ভালোমতো একবার দেখল আদনান। তারপর পুরো ঘটনাটা খুলে বলল তাকে।

‘ভাই, যদি টাকাটার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন তাহলে খুবই উপকার হতো।’

‘হুম... বুঝছি ভাই। টাকাটা আপনার খুব দরকার। তা ভাই, একটা উপায় অবশ্য আছে আমার কাছে। একটা কাজ করতে হইব আপনারে, পারবেন?’

‘অবশ্যই, কী করতে হবে সেটা বলুন একবার।’ রমিজের কথা শুনে বুকে যেন প্রাণ ফিরে পেল আদনান।

‘কানডা একটু কাছে আনেন।’ কান কাছে আনলো আদনান।

‘হুনেন, আইজ বিকালে ইস্টিশনের বাইরে রুপসা হোটেলের সামনে একটা পোলা একটা প্যাকেট লইয়া দাঁড়ায়া থাকব। সেই প্যাকেটটা আপনারে এক জায়গায় পৌঁছায়া দিতে হইব। পারবেন? আর হ, প্যাকেট যাতে একদম ইনটেক থাহে।’

‘কিন্তু কীসের প্যাকেট ভাই?’

‘দেখেন কীসের প্যাকেট সেইডা কবার পারুম না। আপনারে একটা জায়গায় জিনিসটা পৌঁছায়া দিতে হইব। বাস শেষ, এতটুকুই আপনার কাম।’

আদনান কিছুটা আন্দাজ করতে পারে রমিজ কীসের কথা বলছে। আদনানের হঠাৎ নাঈমের কথা মনে পড়ল। কত ভালো বন্ধু ছিল তারা। কত মেধাবী একটা ছেলে, তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে গেল মাদকের জন্য। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। কিন্তু পরক্ষণেই তার হৃদয়ে ভেসে উঠে হাসপাতালের বিছানায় রোগাক্রান্ত অতিকষ্টে দিনাতিপাত করা একমাত্র মেয়ের করুন চেহারাটা। আদনান রাজি হয়ে যায় রমিজের প্রস্তাবে। রমিজ অর্ধেক টাকা তাকে অগ্রিম দিয়ে দেয়, বাকি অর্ধেক কাজের পরে দেবে। রমিজের দেওয়া অগ্রিম সেই টাকাটা নিয়েই হাসপাতালের দিকে ছুটে যায় আদনান। টাকাটা জমা দেওয়ার পরই শুরু হয় অপারেশান। বাকি টাকাটা অপারেশন শেষ হওয়ার আগেই জমা দিতে হবে। রমিজের দেওয়া আরও কিছু কাজ করতে হয়েছিল আদনানকে সেদিন। তারপরেই আদনান তার বাকি টাকাটা হাতে পায়। মেয়ের অপারেশন ভালোভাবেই শেষ হয় সেদিন। ডাক্তার বলল, ‘সব ঠিকঠাক আছে, তবে আরও কটা দিন থাকতে হবে হাসপাতালে।’

৫.

অফিসের চেয়ারটাতে কোট-স্যুট পরা একটা লোক এসে বসল। পোশাক-আশাকে একেবারে নিরেট ভদ্রলোক। সামনের টেবিলটাতে কয়েক ধরনের টেলিফোন। একেক টেলিফোন দিয়ে একেক কাজ সারেন এই ভদ্রলোক। শহরের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদের এই অফিসটি একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হলেও চৌধুরী সাহেব ড্রাগবিজনেসসহ নানা অবৈধ ব্যবসা এই অফিস থেকেই পরিচালনা করেন। চৌধুরী সাহেব ভদ্রলোকের ছদ্মনাম। আসল নাম-পরিচয় বিশ্বস্ত দু-একজন ছাড়া কেউই জানে না। অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্য ছাড়াও তার বৈধ অনেক ব্যবসাপাতি রয়েছে। সেখানেও প্রতিষ্ঠিত তিনি। সম্পদও অঢেল তার। কিন্তু এরপরও টাকার লোভ ছাড়তে পারেননি। রাতে অনেক সময় ভালো ঘুমও হয় না তার, টাকার চিন্তায়।

টেবিলের বাম পাশের সাদা টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। ফোনটা ওঠালেন চৌধুরী সাহেব।

‘বস, আমি রমিজ কইতাছি। আদনান নামে যে পোলাডারে দিয়া সেদিন বড় একটা চালান পাঠাইছিলাম। হেই পোলাডা আর কথা হুনতাছে না। কিছুতেই তারে রাজি করান যাইতেছে না বস। সোর্স থেইকা খবর পাইলাম পোলাটার লগে বুলবুল আহমেদ মানে ওই সরকারি অফিসারটার সম্পর্ক আছে।’

‘এই পথে যে একবার পা দিয়ে দেয়, সে আর পেছন ফিরতে পারে না, রমিজ। আরও দুয়েকবার চেষ্টা করে দেখ। তাতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে ডিরেক্ট শুট করে দিবি।’

‘ওকে বস। রাখি তাইলে।’

‘হুম... ওকে।’

পাঁচ মিনিট পর আরও একটা কল এলো ফোনে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘বস, বস, খুব জরুরি কথা। ফোনে বলা যাবে না এক্ষুনি অফিসে আসছি আমি।’

‘ওকে, তুমি এসো। অফিসে আছি আমি।’

ফোনটা রাখার দশ মিনিট পরই অফিসে এসে পৌঁছল রেজা। পুরো নাম সুমন রেজা। শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ড্রাগ ডিলিংয়ের কাজটা সে-ই করে।

‘বস, একটা গুরুতর খবর আছে।’

চিন্তিত দেখালো রেজাকে। রীতিমতো হাপাচ্ছে সে। রেজার দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে চৌধুরী সাহেব তাকে সেখানে বসতে বললেন। চেয়ারে বসেই রেজা বলতে শুরু করল, ‘ভার্সিটির ড্রাগ সাপ্লাই চেইনগুলো ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে, বস। আর হ্যাঁ, যে খবরটা শুনে সবচেয়ে বেশি অবাক হবেন সেটা হলো, বাজারে খুব শীঘ্রই এমন একটা মেডিসিন আসতে চলেছে, যেটা নিয়মিত সেবন করলে অনেক কড়া মাদকে নেশাগ্রস্তদেরও নেশা কেটে যাবে।’

কথাটা শুনে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল বসের, কপালে চিন্তার ভাঁজ।

‘কথাটা কতটুকু সত্য, রেজা?’

‘সোর্স অথেন্টিক, বস। মেডিসিনটার এক্সপেরিমেন্টও শুরু হয়ে গেছে শুনলাম।’

‘হুমম... বুঝতে পেরেছি। খবরটা আনার জন্য ধন্যবাদ। তুমি এখন যাও, তবে আশেপাশেই থেকো। বিষয়টার খুব দ্রুত একটা বিহিত করতে হবে।’

না, আদনানকে আর কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না। ভীষণ চিন্তিত রমিজ ওরফে বিচ্ছু রমিজ। বসকে বিষয়টা জানিয়েছিল সে। বস কিছু বলেননি। বসের কিছু না বলাটা ভালো করেই বুঝতে পারে রমিজ। হাতের রিভলবারটা ভালো করে চেক করে নেয় রমিজ। বুলেটগুলো সব ঠিকঠাক জায়গাতে লাগানো হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।

৬.

‘এখন কী করার কিছুই বুঝতে পারছি না, বুলবুল ভাই। প্রতিনিয়ত ওরা আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ওদের ভয়ে পরিবারসহ আপনার কাছে আশ্রয় নিয়েছি।’

একটু থেমে এক গ্লাস পানি খেলো আদনান। তারপর বুলবুলকে বুঝিয়ে বলল পুরো ঘটনাটা। ওরা আঠার মতো পেছনে পড়ে রয়েছে আদনানের। ওদের এই অবৈধ কাজগুলো এখন থেকে আদনানকেও করতে হবে। টাকার লোভ দেখাচ্ছে ওরা। কিন্তু আদনানও নাছোড়বান্দা। যার জন্য সমাজের একের-পর-এক তরুণ তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে, সেই কাজের সঙ্গ কিছুতেই দিতে পারে না আদনান।

‘কোনো চিন্তা কোরো না, আদনান। তোমরা এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ। আর হ্যাঁ, যে বা যারা তোমার পেছনে লেগে রয়েছে, তাদের নাম-পরিচয় কিছু জানো তুমি?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আমি বলছি, আপনি লিখুন।’

একটা খাতা আর কলম নিয়ে সবকিছু লিখতে লাগল বুলবুল। পরদিন রমিজকে কল দেয় আদনান। আদনান রমিজের কাজ করতে রাজি, কিন্তু টাকার সংখ্যাটা আরও বাড়াতে হবে রমিজকে। তার কথা মেনে নেয় রমিজ।

কড়া রোদের মধ্যে স্টেশন রোডের রূপসা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদনান। যেখানে প্রথম সে এই অপরাধের সাথে জড়িয়েছিল। ঘড়ির কাঁটাটা তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। কাঁটাটা যখন ঠিক বারোটা নির্দেশ করল, ঠিক তখনই উদয় হলো রমিজের। আদনানকে চোখের ইশারায়, রূপসা হোটেলের পাশে যে বড় মাজারটা আছে সেই মাজারটাতে ঢুকতে বলল রমিজ। মাজারের একেবারে নির্জন প্রান্তে চলে গেলে আদনান।

দু'মিনিট পর দুটো ব্রিফকেস নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল রমিজ। একটাতে গাদা গাদা টাকা, আর পরেরটাতে বিফকেস ভর্তি ইয়াবা। রমিজ যেই আদনানের খুব কাছে চলে গেল, অমনি একটা রিভলবারের স্পর্শ অনুভব করল সে। একেবারে ঘাড় বরাবর পেছনদিকে। মেরুদণ্ড দিয়ে রক্তের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল রমিজের। রিভলধারী আর কেউ নয়, স্বয়ং বুলবুল আহমেদ। এটা একটা ট্র্যাপ ছিল! মুহূর্তেই পুরো এলাকা পুলিশে ভরে যায়। বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ মাদকসহ গ্রেপ্তার হলো রমিজ। রমিজের দেওয়া তথ্যানুযায়ী তার কিছুদিন পরই একে একে গ্রেফতার করা হয় রেজা, নয়ন আর শিপনকে। এরা সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডের বড় বড় ড্রাগ ডিলার।

৭.

নিজের অফিসে ভীষণ রকম পায়চারী করছেন ‘বস’ ওরফে চৌধুরী সাহেব। গত কয়েকদিনে তার বড় বড় এজেন্টরা একের পর এক পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। ব্যবসায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো তার। এদিকে কী একটা মেডিসিনের জন্য রাতের ঘুম তো অনেক আগে থেকেই হারাম। রাগে-ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তার। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। মনে মনে ভাবলেন বস। কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছেন আদনান-বুলবুলরা এখন ওই ভার্সিটিতেই আছে। আর অপেক্ষা করলেন না বস। তার সন্ত্রাসীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভার্সিটির উদ্দেশে। আজ একটা চূড়ান্ত সমাধান চান তিনি। গাড়িতে উঠেই গান হোলস্টারটা ভালো করে চেক করে নিলেন। সব ঠিকঠাক আছে। চলতে শুরু করল গাড়িটা।

৮.

‘ইন্তেসার, আদনান, ইফতেশাম তোমরা কাজটা শেষ করেই দক্ষিণ গেইটে এসে দাঁড়াবে। আমিও এসে মিলিত হব সেখানে। তারপর সেখান থেকে যেতে হবে ফৌজদারহাট। ওকে?’ বলল বুলবুল।

‘ওকে, ভাইয়া।’ সমস্বরে বলল বাকিরা।

‘বস, ওই যে কালো রংয়ের শার্ট পরা ছেলেটাকে দেখছেন না, ও-ই আদনান। ওই যে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।’ আদনানকে দেখতে পেয়েই বসকে ইঙ্গিত করলে তার এক গুন্ডা।

‘আর হ্যাঁ...’ কথা পুরোপুরি শেষ করতে পারল না বুলবুল। গুলির শব্দ ছুটে এলো কানে। আদনানের দিকে গুলি ছুটে আসতে দেখেছিল ইন্তেসার। সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয় আদনানকে। একটা গুলি এসে লাগে ইন্তেসারের বুকের বাম পাশে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে সে।

‘বাবা, তুমি!?’

চমকে ওঠল ইন্তেসার।

এ কী করলেন মোরশেদ খান! গুলি করে দিলেন নিজের ছেলেকেই!

ইন্তেসারের বাবা মোরশেদ খানই ‘চৌধুরী সাহেব’। গানটা পড়ে যায় তার হাত থেকে। নীরব হয়ে যায় চারপাশ। দ্রুত দৌড়ে যান ছেলের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। ইন্তেসারের শ্বাস-প্রঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। চিৎকার করে উঠলেন মোরশেদ খান।

সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে গেল তার। নিজেকে আবিষ্কার করলেন ঘরের বিছানায়। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চারপাশটা একটু বোঝার চেষ্টা করলেন। এতক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে ছিলেন তিনি!

পাশের রুম থেকে ছুটে এলেন তার স্ত্রী, ছুটে এলো ইন্তেসারও।

‘কী হয়েছে আপনার? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?’ চিন্তিত ইনন্তেসারের মা।

‘হুমম... একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তেমন কিছু নয়। এক গ্লাস পানি দাও আমায়।’

পানি খেয়ে তাকালেন ইন্তেসারের দিকে। ইন্তেসারের হাতটা ধরে বললেন, ‘তুই ঠিক আছিস তো, বাবা?’

‘হ্যাঁ, বাবা। একদম ঠিক আছি আমি। পুরোপুরি সুস্থ।’

দুঃস্বপ্নটা গভীরভাবে ভাবাতে লাগল মোরশেদ খানকে। 

এই তো কিছুদিন আগে নেশার টাকা জোগাড়  করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। নেশায় বিভোর হয়ে ঝগড়া করে মা-বাবাকে খুন করে ফেলে ঐশী। মাদক ব্যবসার ভাগাভাগি নিয়ে এই তো কিছুদিন আগে মারা গেল রেলস্টেশন বস্তির রহিম।

না, এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মোরশেদ খান। আর কারও জীবন তিনি নষ্ট করবেন না, নষ্ট হতে দেবেন না। পাশের টেলিফোনটা তুলেই কল দিলেন কাকে যেন। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই মোরশেদ খানের কড়া নির্দেশ, ‘শোনো, গত কয়েক দিনে ড্রাগ বিজনেসের যতগুলো ডিল সাইন করা হয়েছে, সবগুলো ক্যানসেল করো, সব।’

‘কিন্তু স্যার, সেগুলো ক্যানসেল করলে কোটি কোটি টাকা লোকসান হবে আমাদের।’

‘আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। আজ থেকে এই অভিশপ্ত ব্যবসার এখানেই সমাপ্তি ঘটবে। আর কারও জীবন নষ্ট হবে আমার জন্য, সেটা আমি চাই না। আজ থেকে এসব ছেড়ে দাও। সবাইকে বলো, কাল থেকে আমার ফ্যাক্টরিতে জয়েন করতে। ব্যস, রাখি।’

বিছানা থেকে উঠে পড়লেন মোরশেদ খান। দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। আজকের সূর্যটা কেন জানি অন্য দিনের চেয়ে বেশি উচ্ছল, বেশি প্রাণবন্ত। চারদিকের উড়ন্ত পাখিগুলোর মনের সুখ যেন অনেক বেশি আজ। চায়ের টং, পিচঢালা রাজপথ, রিকশার টুংটাং শব্দ, স্কুলগামী ছোট ছোট বাচ্চাদের ছোটাছুটি আর থেমে থেমে দমকা বাতাস—সবকিছু নতুনভাবে উপলব্ধি করছেন মোরশেদ সাহেব। কত সুন্দর এই সমাজ, কত সুন্দর এই দেশ। অথচ তিনি কিনা একে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন ধ্বংসের কিনারায়। ভাবনাগুলো যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। মোরশেদ খান গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলেন। আজ সব অপরাধের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ হবে।