১২ ডিসেম্বর ২০২১ 

জীবনে সবকিছু বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। কিছু ঝামেলা ছিল, তবে সম্প্রতি বুঝলাম, আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার কলিগ রাতুল। যদিও ছেলেটা খারাপ না, তবু...। যাই হোক, ঘটনা সোজাসুজি বলি। প্রতিদিন দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, ব্রেড-জেলি মুখে গুঁজে অফিসের জন্য দৌড়ানো, রাস্তায় জ্যামে আটকে থেকে শেষে বসের ঝাড়ি খাওয়া—এভাবেই চলছিল দিনগুলো। তবে সবকিছুতে মশলার মতো যোগ হতো রাতুলের সঙ্গ। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটা বদলে গেল। একদিন দেখলাম, ওর চোখের নিচে কালো দাগ, চুল অগোছালো, চাপ ভাঙা। কেমন যেন লাগল। সবটা জানার জন্য একদিন তাকে চেপে ধরলাম। সে যা বলল, তা শুনে আমি আরও টেনশনে পড়ে গেলাম। বুঝলাম, ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ওকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তাই দ্রুত ওর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

১৩ ডিসেম্বর ২০২১

রাতুলের বাসা নবীনগরের শেষ প্রান্তে। সাড়ে এগারোটায় পৌঁছালাম। মোটামুটি ভালো বাসা—দুটো বেডরুম, কিচেন, ড্রয়িংরুম, আর ফার্নিচারও বেশ দারুণ। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বেলকনিটা—পশ্চিমমুখী, যেখানে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায়। ভাবলাম, একদিন কফি আর বই নিয়ে এখানে সময় কাটাবো। তবে বাসার রঙটা একটু অদ্ভুত লাগল!

‘তোর বাসাটা দারুণ রে, ভাই!’ ভাত মুখে পুরতে পুরতে বললাম। হয়তো মুখ ভর্তি থাকায় কথাটা ঠিকমতো বুঝল না রাতুল। সে তাড়াহুড়ো করে ভাত-ডাল আর আলু ভর্তা বানিয়েছে। সবই ঠিক ছিল, শুধু ডালে লবণ একটু বেশি। তবুও আমি গপগপ করে খেয়ে নিলাম—পেট খালি থাকলে সবই অমৃত মনে হয়। রাতুল প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে, ভাত নাড়ছে, কিন্তু মুখে দিচ্ছে না।

‘খেয়ে নে। এভাবে চললে তুই বাঁচবি কেমন করে?’

‘আমার খেতে ভালো লাগছে না, ফিয়াদ। তুই খা।’ বলে প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেল সে।

বিছানায় শোবার সাথে সাথেই ওয়াশরুম থেকে বিকট একটা চিৎকার শুনলাম—’ফিয়াদ!’ 

সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিলাম। রাতুলের ঘরের ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ আসছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল। দরজা ধাক্কালাম, লাভ হলো না। শেষে দরজা ভেঙে ঢুকলাম। বেসিনের কাছে উবুড় হয়ে পড়ে আছে রাতুল!

‘কী হয়েছে?’

‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

কাঁদতে শুরু করল রাতুল। পুরুষ মানুষ যে এমন অসহায়ের মতো কাঁদতে পারে, তা আগে দেখিনি। ওকে সামলাবো, না নিজেকে সামলাবো, বুঝতে পারছিলাম না। অনেক জোরাজুরির পর ও মুখ খুলল।

‘ফ্রেশ হতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বেসিনের আয়নায় তাকিয়ে…’

‘আর কী? থামলি কেন, কী দেখলি?’

‘ওকে দেখলাম। বিদঘুটে চেহারা। তার মুখ মনে করতে চাই না, তবুও সামনে ভেসে ওঠে। খুবই ভয়ের!’ ঘেমে একাকার হয়ে রাতুলের গেঞ্জিটা শরীরে লেপ্টে গেছে। রুমাল বের করে দিলাম, সে কপালের ঘাম মুছে আবার বলতে শুরু করল।

‘খুব ভয়ানক দেখতে সে। ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যতক্ষণ না নজর সরাই, ততক্ষণ সে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসে।’ পানির গ্লাস এক দমে শেষ করে রাতুল।

‘শান্ত হয়ে যা। আমি দেখতে চাই, কে সে। এখনই যাচ্ছি।’ বলতে বলতে উঠলাম। রাতুল আমার হাত চেপে ধরল। 

‘যাস না, সহ্য করতে পারবি না ওর চেহারা।’

জোর করে গেলাম, কিন্তু ওয়াশরুমে গিয়ে কিছুই পেলাম না সন্দেহ করার মতো।

দিন দিন রাতুলের সমস্যাটা বাড়ছিল। একদিন সে কিচেনে সবজি কাটছিল। হঠাৎ চিৎকার করে পড়ে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে তুলে বসানোর চেষ্টা করলাম। পরে ও বলল, জানালার কাঁচে দেখেছে পেছনে সেই জন্তুটা দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর রাতের ঘুমও বন্ধ করে দিল রাতুল। স্বপ্নে সে ঐ জিনিসটাকে দেখে। আমি আরও চিন্তিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ডাক্তার দেখাব, ওর চিকিৎসা দরকার।

২৭ ডিসেম্বর ২০২১

আজ দ্বিতীয়বারের মতো রাতুলকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনার রুমটা খুব সুন্দর। ফিকে নীল রঙের ঘরটি বেশ পরিপাটি। পশ্চিমের বড় জানালা গলিয়ে নরম আলো প্রবেশ করছিল। জানালার পাশে ঘন সবুজ গাছের টব। ঘরের মাঝ বরাবর রয়েছে একটি বড় ডেস্ক, যেখানে রোগীর ফাইল, নোটবুক এবং কম্পিউটার রাখা। ডেস্কের অপর পাশে রোগী বসার জন্য আরামদায়ক একটি সোফা। দেয়ালে কিছু শান্তিপূর্ণ শিল্পকর্ম ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের পেইন্টিং ঝুলছিল।

এক কোণে একটি বইয়ের শেলফ রয়েছে, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য, আত্ম-উন্নয়ন ও সম্পর্ক বিষয়ক বিভিন্ন বই রাখা ছিল। এসেনশিয়াল অয়েলের সুবাস ঘরজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। অনুমতি নিয়ে আমরা ভেতরে গেলাম। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, কালো ফ্রেমের চশমা, গভীর দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। মুখে লেগেছিল এক প্রসন্ন হাসি। উনি আমাদের সালাম দিলেন।

ডাক্তার হাসিমুখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন?’ 

রাতুল শুধু তাকিয়ে রইল, কোনো উত্তর দিল না। তাই আমি শুরু করলাম—আপনি যা যা পরামর্শ দিয়েছিলেন সবই করেছি, তারপরও কোনো উন্নতি হচ্ছে না, স্যার। বুঝতে পারছি না কী করব এখন...

হঠাৎ রাতুল বলে উঠল, ‘ও সব জায়গায় থাকে। রাতে পায়ের কাছে বসে থাকে, ঘুম ভাঙলেই দেখি ও তাকিয়ে আছে। জানালায় তাকালেই দেখি বাইরে থেকে আমাকে দেখছে। বিদঘুটে চেহারাটা আমি আর সহ্য করতে পারছি না!’ কথাগুলো বলে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল সে। আমি হতাশ হয়ে ওকে দেখছিলাম।

‘স্যার, ওর অবস্থা খুব খারাপ। প্লিজ, ওকে বাঁচান।’ 

ডাক্তার কিছুক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, ভ্রু কুঁচকে দাড়িতে হাত বোলালেন। তারপর বললেন, ‘ঔষধগুলো চলুক। তবে আমি আপনাদেরকে আরেকটি পরামর্শ দিই। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা বেশিই ক্রিটিক্যাল এবং প্যারানরমালও। উনাকে একজন ভালো রাকির[১] কাছে নিয়ে রুকইয়াহ[২] করিয়ে দেখুন। আর হ্যাঁ, আয়না দেখার সময় অবশ্যই—

اَللَّهُمَّ حَسَّنْتَ خَلْقِيْ فَاَحْسِنْ خُلُقِيْ  [৩]

এই দুআটি পড়বেন রাতুল সাহেব! আর ইবাদতে মনোযোগী হবেন।’ 

রাতুল নীরবে সবকিছু শুনল।

আমাকে নিয়ে বাইরে এসে উনি বললেন, ‘উনি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সম্ভবত ফোবিয়ার কারণে এমনটা হয়েছে, যা সময়ের সাথে বাড়ছে। আর আমি সন্দেহ করছি হয়তো প্যারানরমাল বিষয় অর্থাৎ জিন ঘটিত সমস্যাতেও ভুগছেন উনি।’ ডাক্তারের কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠল। কত অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে এই পৃথিবীতে!

৩রা মার্চ ২০২২

প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। রাতুল এখন প্রায় সুস্থ।

যদিও আমি ওসবে তেমন ইন্টারেস্টেড নই, তারপরও মানতেই হচ্ছে ডাক্তার সাহেবের পরামর্শ কাজে দিয়েছে! যাই হোক,আমারও কাজ শেষ, তাই ফিরে এসেছি নিজের বাসায়। সবকিছু আবার আগের মতোই হয়ে গেছে। সেই লেইট করে ঘুম থেকে ওঠার খারাপ অভ্যাস, নাকেমুখে খাবার খুঁজে দৌড়ানো, জ্যাম, বসের ঝাড়ি—এটাই আমার জীবনচক্র।

৬ মে ২০২২

আজকে আবারও ওকে দেখলাম। কাল রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলতেই দেখি, ও আমার পাশে বসে আছে। ও…..

রবিন ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে নীল ফাইলটা হাতে নিল। ফাইলের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় একটি পেপার কাটিং-এ চোখ পড়ল। সেখানে দু’বছর আগের একটি দুর্ঘটনার খবর। শিরোনাম:

‘অটোরিকশা থেকে ঝাঁপিয়ে রাস্তায় পিষ্ট  এক অফিসকর্মী, আত্মহত্যা না  অন্যকিছু?’ রবিন ফাইলটা বন্ধ করে রেখে দিল। ফিয়াদ শাহরিয়ারের নামটা লাল মার্কার দিয়ে লেখা ফাইলের ওপর।

‘ফিয়াদ সাহেবের কেইসটা বেশ অদ্ভুত, তাই না, স্যার?’ শফিক আহমেদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রবিন।

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালেন ডা. শফিক।

‘সত্যিই অদ্ভুত। প্রথমে উনি নিজের কলিগের সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। পরে কলিগ সুস্থ হলেও উনি নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আয়নায় তাকাতে ভয় পেতেন, অদ্ভুত সব জন্তু দেখতেন!’

‘আপনি উনার ডায়েরিটা কীভাবে পেলেন, স্যার?’ ভেতরের উৎসাহ চেপে রাখতে পারল না রবিন।

‘উনার মৃত্যুর পর এগুলো মি. রাতুল—মানে, ফিয়াদ সাহেবের কলিগ—আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত কারণে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিয়াদ সাহেবের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসেন।’

‘আচ্ছা, সেদিন উনি হঠাৎ মাঝপথে কেন লাফ দিয়েছিল? আপনার কী মনে হয়?’

শফিক আহমেদ ডায়েরিটা হাতে তুলে নিয়ে আবারও পড়তে লাগলেন।

‘আমার ধারণা, উনার মানসিক অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তিনি খুব সম্ভবত স্পেক্ট্রোফোবিয়া (Spectrophobiaতে ভুগছিলেন। এটি একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি, যেখানে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার ভয় তৈরি হয়। ্তার আয়নাভীতিটা মারাত্মক রূপ নিয়েছিল। এর পাশাপাশি হয়তো জিনের দ্বারাও প্রভাবিত হচ্ছিলেন উনি। এ ধরনের রোগীরাও আয়নায় ভয়ানক জিনিস দেখতে পায় (জিন)। উনার কলিগের ক্ষেত্রে যে পরামর্শগুলো দিয়েছিলাম, উনি নিজেও যদি এগুলো মানতেন তাহলে উনি উপকৃত হতে পারতেন হয়তো। আর সঠিক সময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে সমস্যা এতটা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারত না। অবশ্য এটাই হয়তো তার ভাগ্যে ছিল তাই…।

আমাদের দেশে ও সমাজে এখনো মানসিক অসুস্থতাকে বড্ড অবহেলা করা হয়। অথচ শারীরিক রোগের যেমন চিকিৎসা দরকার, মানসিক রোগেরও চিকিৎসার দরকার আছে। অবহেলার কারণে দুটোই মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। ফিয়াদ সাহেব বিষয়টা এড়াতে এড়াতে এই বিপত্তি ঘটিয়েছেন। আমার খুব খারাপ লেগেছে উনার ঘটনাটা দেখে। শিক্ষক হিসেবে তোমার প্রতি আমার উপদেশ রইল, পরিচিতদের এ বিষয়ে সতর্ক করবে তুমি। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে।’

শফিক আহমেদ ফাইলটা টেবিলে রেখে বললেন, ‘ফিয়াদ শাহরিয়ার, আল্লাহ আপনার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাত দিক। আমীন।’


[১] রাকি - যে ব্যক্তি কোনো সুস্থ/অসুস্থ ব্যক্তির পাশে অবস্থান করে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দুআর মাধ্যমে শারঈ ঝাড়ফুঁক তথা রুকইয়াহ করে থাকেন, তাকে (সাধারণত) রাকি বলে।

[২] রুকইয়াহ- ব্যবহারিক অর্থে রুকইয়াহ শারইয়াহ বলতে ‘ইসলামসম্মত ঝাড়ফুঁক’ বুঝায়। রুকইয়ার পারিভাষিক অর্থ হলো, “কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নামের যিকর, হাদীসে রাসূল ﷺ অথবা সালাফে সালেহীন থেকে বর্ণিত দুআ পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কোনো বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া কিংবা রোগ থেকে আরোগ্য কামনা করা।” একদম সহজে বললে, রুকইয়াহ হলো বদনজর, জিন, জাদু ইত্যাদি প্যারানরমাল সমস্যার পাশাপাশি কিছু শারিরীক-মানসিক রোগের জন্য ইসলামসম্মত ঝাড়ফুঁক। এই চিকিৎসায় সাধারণত কুরআনের আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত দুযআ পড়ে সরাসরি ঝাড়ফুঁক করা হয়, অথবা পানি, মধু, তেল ইত্যাদিতে ফুঁ দিয়ে ব্যবহার করতে বলা হয়। এ ব্যাপারে জানার জন্য দেখো- https://ruqyahbd.org/

[৩ ] অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি আমার চেহারায় সৌন্দর্য দিয়েছেন। অতএব আমার চরিত্রও সুন্দর করে দিন।” মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়না দেখার সময় এই দুআটি পড়তেন। (আহমদ ২৪৩৯২, আবু ইয়ালা ৫০৭৫)

[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত]