সৌদি আরবের একজন প্রখ্যাত শাইখ আব্বাস আল বাত্তাউয়ী রহিমাহুল্লাহ। তিনি বেশ কয়েক বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। শাইখ আব্বাস স্বেচ্ছায় ভলান্টিয়ার ভিত্তিতে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মৃত ব্যক্তিদের গোসল দিয়েছেন। কাজেই তিনি বিভিন্ন মানুষের মৃত্যু দেখেছেন, অনেক অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ আমরা তোমাদের সামনে উপস্থাপন করব।

একদিন শাইখ আব্বাসের কাছে এক ভদ্রলোক ফোন দিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আসতে পারবেন আমাদের এখানে? একজন ব্যক্তি মারা গেছে। মৃতদেহ গোসল দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই আমি আসছি।’ এরপর শাইখ আব্বাস সেখানে গেলেন। গিয়ে দেখেন সেই বাড়িটি বিশাল। বিশাল বাড়ি বললেও ভুল হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এটাকে কোনো দুর্গের সাথে তুলনা দেওয়া হয়। এত বিরাট বিত্তশালী ধনী একজন মানুষের বাড়ি থেকে উনার ডাক এসেছে। শাইখ আব্বাস বলেন, ‘শুধু মেইন গেট থেকে বাড়ির কাছাকাছি পর্যন্ত হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে, এত আলিশান বাড়ি! তিনি বাড়ির ভেতরে গেলেন এবং ভেতরে গিয়ে আরও অবাক হয়ে গেলেন। চারিদিকে এত প্রাচুর্য, এত ধন-সম্পদের ছড়াছড়ি!

ভেতরে একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিল। সেই লোকটি শাইখকে বলল, ‘সোজা ওপর দিকে যেতে থাকুন। ওপরে একটা সিঁড়ি আছে। এরপরে যে রুমটা আছে সেখানে যাবেন।’

শাইখ একজন সম্মানিত ব্যক্তি। এই বাড়িতে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। অথচ সেই লোকের কথাবার্তার মধ্যে ভদ্রতার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। খুবই কঠোরভাবে লোকটা কথা বলছিল। সাধারণত কাউকে যখন আমরা কোনো কাজে সহায়তার জন্য ডাকি, তিনি যখন আমাদের অনুরোধে আসেন তখন আমরা ন্যূনতম ভদ্রতা হলেও দেখাই, সালাম বিনিময় করি। কুশলাদি বিনিময় করি। কিন্তু লোকটা এই ধরনের কিছুই বলল না। এ ধরনের আচরণ দেখে শাইখ খুবই মর্মাহত হলেন।

‘আপনি কি নিজে যেতে পারবেন নাকি আমাদের কোনো কাজের লোককে বলব আপনাকে নিয়ে যেতে?’ শায়খকে সেই লোকটি আবার কঠোর ভাষায় প্রশ্ন করল। শাইখ নিজে থেকে এখানে আসেননি; বরং সেই লোকটি তাকে ফোন দিয়ে আসতে অনুরোধ করেছে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম ভদ্রতাটুকুর সাথে পথ এগিয়ে দেওয়ার কাজটুকুও সে করছে না। যাই হোক, শাইখ বললেন, ‘দরকার নেই আমি নিজেই যেতে পারব।’

শাইখ সেই নির্ধারিত কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি বলেন, ‘সেই প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ির চারিদিকে সবকিছু এত পরিষ্কার ছিল যে, কোথাও একটা ময়লার চিহ্নমাত্র নেই। মেঝেতে তাকালে সত্যিকার অর্থেই নিজের চেহারার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। সবকিছু চক চক ঝক ঝক করছে’। শাইখ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন। নির্দিষ্ট বেডরুমে গেলেন।
বেডরুমটি ছিল বিশাল। সেখানে অনেক কাজের লোক দাঁড়িয়ে আছে। কমপক্ষে দুই থেকে তিনজন লোক বিভিন্ন কাজ করছে। কিন্তু মৃতব্যক্তির পরিবারের কোনো সদস্যকে সেখানে দেখা গেল না।

শাইখ সরাসরি মৃতদেহের দিকে হেঁটে গেলেন। মৃতদেহটি একটা খাটিয়া বা টেবিলের ওপরে রাখা ছিল। কাপড় দিয়ে ঢাকা মৃত ব্যক্তিকে দেখার জন্য তিনি মুখের অংশ থেকে কাপড় উঠালেন। যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি দেখেন লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা দেহ ছোট ছোট লাল পিপড়া দিয়ে ঢাকা। এত পিপড়া যে, দেখে মনে হচ্ছে যেন এটা পিঁপড়ার কোনো বাসা। যেন এটা কোনো লাশ নয়। সারা গায়ে পিপড়ারা হেঁটে বেড়াচ্ছে, ছুটে বেড়াচ্ছে। লাশের নাক দিয়ে মুখ দিয়ে পিঁপড়া বের হচ্ছে আবার ঢুকছে। লাশের গোটা শরীরে পিপড়ারা কামড়াচ্ছে। যে ধরনের লাল পিপড়া কামড়ালে আমাদের শরীরে খুবই যন্ত্রণা হয় সেই ধরনের লাল পিঁপড়া দিয়ে লাশের সারা দেহ ছেয়ে গেছে।

শাইখ এত পিঁপড়া দেখে খুবই অবাক হলেন। এত পিঁপড়া কোত্থেকে আসলো? শাইখ আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও কোনো ময়লা বা এই ধরনের কিছু দেখতে পেলেন না। আশেপাশে কোনো কিছু না দেখে শাইখ তাড়াতাড়ি কাপড় দিয়ে আবার লোকটার চেহারা আগের মতো ঢেকে দিলেন। আর অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, এই মৃতদেহ গোসল দিবেন কীভাবে। তিনি সাহায্যের জন্য আরেকজন শাইখের কাছে ফোন দিলেন। শাযইখ আব্বাসের ঘটনা শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এবং তিনি ফোনে বললেন, ‘এরকম ঘটনা তো কখনো শুনিনি। ফিকহের কিতাবে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা আছে। যেমন- কোনো ব্যক্তি যদি আগুনে পুড়ে মারা যায় তার লাশ কীভাবে ধুতে হবে, কোনো ব্যক্তি যদি টুকরো টুকরো খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়, সেই মৃতদেহ কীভাবে ধুতে হবে তার বর্ণনাও আছে। কিন্তু এই ধরনের ক্ষেত্রে কী করণীয় সে ব্যাপারে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।’ তাই সেই শাইখ বললেন, ‘আপনি নিজে যা ভালো মনে করেন সেটাই করুন। আমার কাছে এর কোনো পরামর্শ নেই।’

শাইখ আব্বাস তখন আশেপাশে থাকা কাজের লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন এই মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন ছেলে, ভাই, আত্মীয় কাউকে দেখছি না। ওরা কোথায়? ওরা সেই বাড়িতেই ছিল। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। যে লোকটা শাইখকে ফোন করে আসতে বলেছিল, সে ছিল ওই মৃত ব্যক্তির সন্তান। সেও সেখানে ছিল না। কাজেই পরিবারের লোকেদের কাছ থেকে জানার কোনো সুযোগ ছিল না এই মৃতব্যক্তির এই অবস্থা কীভাবে হলো। শাইখ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন এখন কী করা যায়। অবশেষে খেয়াল করলেন, বেডরুমের পাশে একটা বাথরুম আছে। আগেই বলা হয়েছে, সেই বাড়ির সবকিছু খুবই আলিশান, সবখানে বিলাসিতার ছাপ। বাথরুমটাও ছিল বিশাল। বাথরুমে সুন্দর, বিরাট একটি বাথটাব আছে।

শাইখ কল ছেড়ে পুরো বাথটাবের চৌবাচ্চা পানি দিয়ে ভর্তি করলেন। এরপর কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে মৃত দেহটাকে সেখানে চৌবাচ্চার মধ্যে ছেড়ে দিলেন। এর আগে সেই মৃতদেহের নাক-কানগুলো তুলা দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। মৃতদেহটি পানিতে ডুবে গেল আর পিঁপড়াগুলো ওপরের দিকে উঠতে লাগল। এভাবে কিছুক্ষণ রাখার পর সবগুলো পিঁপড়া পানির কারণে ভেসে চলে গেল। এই অবস্থায় তিনি সেই লাশটাকে গোসল দিলেন। শাইখ ভেবে পাচ্ছিলেন না যে, এত পরিষ্কার, কোথাও একটু ময়লা নেই, চারিদিকে সবকিছুই চকচকে ঝকঝকে। সেখানে এতগুলো লাল পিপড়া কোত্থেকে আসলো। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত লাশের গোসল দেওয়া শেষ হলে কাফন দিয়ে সেটাকে ঢেকে দেওয়া হলো।

শাইখ আব্বাস তার কাজ শেষ করে সেখান থেকে বের হয়ে আসলেন। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলেন। নিচে নামার সময় মৃত ব্যক্তির পরিবারের একজনের সাথে দেখা হলো। সে ছিল মৃত ব্যক্তির অন্য একজন ছেলে। এই লোকটাও তার ভাইয়ের মতোই শায়খের সাথে অভদ্র ব্যবহার করল। অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় শাইখকে বলল- ওখানে ড্রাইভারের রুম আছে। সেখানে গিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে নিন।

শাইখ অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তিনি লোকটার চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখো, আমি এখানে খাওয়া-দাওয়া করতে আসিনি, টাকা-পয়সার জন্যেও আসিনি। আমি এসেছি এই কাজের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে সেই কারণে। ধর্মীয় দায়িত্ব থেকেই আমি এখানে এসেছি। আমার কাজ শেষ, আমি এখন যাচ্ছি।’

শাইখ পাঁচ মিনিট হেঁটে বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় এসে পৌঁছালেন। তিনি দেখতে পেলেন, সে রাস্তায় আগে থেকেই একটা গাড়ি শাইখের জন্য অপেক্ষা করছে। যেই লোকটা শাইখকে ফোন দিয়েছিল, সে আগেই সেখানে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরের ব্যবহারের কারণে শাইখ তাদের কোনো ধরনের সেবা বা সার্ভিস নিতে চাচ্ছিলেন না। শাইখ জানালেন, তিনি সেই গাড়িতে উঠবেন না। এমন সময় সেখানে ওই মৃত ব্যক্তির নাতি এসে উপস্থিত হলো। সে ছিল ১৮ বছর বয়সের একজন ছেলে। শাইখ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন দেখে সে নিজেই সেখানে এসেছিল। এই ছেলেটা তার বাবা কিংবা চাচার মতো বেয়াদব নয়। বরং বেশ ভদ্র স্বভাবের ছিল। সে খুব বিনয়ের সাথে বাবা ও চাচার ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করল। ভদ্রতার সাথেই বলল, ‘শাইখ, আপনি কষ্ট করে এসেছেন। আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি। দয়া করে গাড়িতে উঠুন।’

শাইখ, প্রথমে রাজি হলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেটার অনুরোধে গাড়িতে উঠলেন। সেই মৃত ব্যক্তির নাতি গাড়ি চালাতে লাগল। আমরা আগেই বলেছি, শাইখ আব্বাস যখন কাউকে গোসল দিতেন তখন সেই মৃত ব্যক্তির জীবন, তার আমল ইত্যাদি ব্যাপারে জানতে চাইতেন। গাড়িতে বসে শাইখ আব্বাস ছেলেটির সাথে কথাবার্তা চালাতে থাকলেন। শাইখ ছেলেটিকে বললেন, ‘আমি এমন একটি বিষয় দেখেছি সে ব্যাপারে তোমরা কি কিছু জানো?’

ছেলেটি বলল, ‘আমরা সবাই জানি। বাড়ির সবাই জানে। দাদার লাশ থেকে লাল লাল পিঁপড়া বের হচ্ছিল। পুরো শরীর পিঁপড়ায় ভরে যায় এবং পিঁপড়াগুলো দাদাকে কামড়াতে থাকে। কিন্তু এগুলো কোত্থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে, এগুলো কীভাবে সরাবো সেটা আমরা জানি না। এই কারণে পরিবারের কেউ সেই লাশের পাশে দাঁড়ানোর সাহস করছিল না।’

তোমার দাদা বেঁচে থাকতে কী করতেন, একটু বলবে?
ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল প্রশ্ন শুনে। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘শাইখ, আমার দাদা তার মায়ের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করত। এমনকি দাদা তার মাকে মারধর করত। পরিবারের কারও কথা শুনত না। যতভাবে আঘাত করা সম্ভব; হাত দিয়ে, পা দিয়ে, চড়-থাপ্পড় সবভাবেই আঘাত করত।’

চিন্তা করতে পারো, একজন ব্যক্তি তার মায়ের সাথে এ ধরনের আচরণ করত! শাইখ সেই মৃত ব্যক্তির নাতির মুখ থেকে এ-কথা শুনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। নাতি বলতে থাকল, ‘শুধু তাই না। এমনভাবে মারধর করত যে, দাদার মায়ের গায়ে সেই আঘাতের কালচে দাগ পড়ে যেত। চোখের নিচে, চেহারায় মুখে হাতে-পায়ে দাগ বসে যেত। এ অবস্থা দেখে আমার আব্বা তার দাদীকে অর্থাৎ সে মৃত ব্যক্তির মাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেত। পুলিশ ইন্সপেক্টর দাদীর গায়ে আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে জিজ্ঞাসা করত এগুলো কীসের আঘাত। কিন্তু তিনি কিছুই বলতেন না। কোনো অভিযোগ করতেন না। তিনি বলতেন- না, এমন কিছু না, এই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। তার ছেলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো রিপোর্ট করতেন না। দাদা, তার মাকে ঘন ঘন মারধর করত। আমার বাবা, থানায় গিয়ে বারবার দাদার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাত। পুলিশরাও সবকিছু বুঝতে পারত। কিন্তু যেহেতু দাদার মা নিজে থেকে থানায় কোনো অভিযোগ করতেন না, তাই পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারত না।’

গাড়ি চলতে লাগল। জমাটবাঁধা নীরবতা নেমে এলো গাড়ির ভেতরে। কেউ কোনো কথা বলল না। শাইখ জানালা দিয়ে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার করার পরিণতি দুনিয়াতে থাকতেই ভোগ করতে হয়। সেই লোকটা যখন মারা যায় তখন মৃত্যুশয্যায় তার আশেপাশে কেউ ছিল না। তার ছেলে, নাতি কেউই তার পাশে এগিয়ে আসেনি। মৃত্যুর পরে যখন ছোট ছোট লাল পিঁপড়া দিয়ে লোকটার সারাদেহ ঢেকে যায় তখনো কেউ তার পাশে দাঁড়ানোর সাহস পায়নি। শেষ পর্যন্ত এভাবেই লোকটাকে দাফন করা হয় এবং তার কাফনের সময়, জানাজার সময়েও কোনো আত্মীয়স্বজন তার পাশে ছিল না।

যদি মৃত ব্যক্তির ওপর কোনো আঘাত করা হয়, তাহলে সে জীবিত ব্যক্তির মতোই ব্যথা অনুভব করে। রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি হাদীসে জানিয়েছেন মৃত ব্যক্তির হাড় ভেঙে ফেলা, জীবিত ব্যক্তির হাড় ভেঙে ফেলার মতোই। (সুনানু আবী দাউদ, হাদীস নম্বর- ৩২০৯) অর্থাৎ একই রকম ব্যথা তারা উভয়েই অনুভব করে। তাহলে এবারে সেই লোকটার কথা চিন্তা করো, যার গোটা দেহ লাল পিঁপড়া কামড়াচ্ছিল। নাকের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল এবং সারা দেহ কামড়াচ্ছিল। জীবিত ব্যক্তি যখন ব্যাথায় চিৎকার করে আমরা সেই চিৎকার শুনতে পাই। কিন্তু মৃত ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পাই না।

আলিমরা বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি তার পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে এর শাস্তি এবং পরিণতি দুনিয়াতে থাকতেই সে ব্যক্তিকে ভোগ করতে হয়। আর আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। বড়দেরকে সম্মান করা, পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করা, তাদের আনুগত্য করা এবং তাদের খিদমত করা, সেবা-যত্ন করা এই বিষয়গুলো ধীরে ধীরে সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে। এমনকি সন্তান যদি বিপথে যায় এবং পিতামাতা যদি তাদেরকে শাসন করার চেষ্টা করেন, তখন কিছু হলেই সেইসব সন্তানরা বলে ওঠে, পিতামাতা নাকি তাদের ওপর অত্যাচার করছে। পিতামাতা নাকি দুর্ব্যবহার করছে। পিতামাতাকে তারা নাম দেয় এবিউসিভ প্যারেন্টস!

এ সম্পর্কে আরেকটি কাহিনি বলি। একবার এক ব্যক্তি তার বাবার সাথে তর্ক করছিল কোনো এক বিষয় নিয়ে। বাবা-ছেলের মধ্যে মনোমালিন্য হচ্ছিল, কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। এই অবস্থায় বাবা ছেলেকে আঘাত করল। একটা চড় মারল। ছেলের বয়স আঠারো বছর। উপযুক্ত আদব-আখলাক এগুলো তার মধ্যে নেই। এগুলো সে শেখেনি। কাজেই তার রিঅ্যাকশন কী হতে পারে, সেটা তোমরা অনুমান করতে পারছ। সেই ছেলেটা তার বাবাকে পাল্টা আঘাত করল। একবার-দুইবার নয়, আঘাত করতেই থাকল। বাবা রাগ করে তাকে বলল, ‘তুই এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।’ তখন ছেলেটি বলল, ‘আমি কেন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব? বরং তোমাকে আমি আজকে বাড়ি থেকে বের করে দেবো। আমি এখানে থাকব আর তুমি বের হয়ে যাবে।’ এই কথা বলে সে বাবাকে টানতে টানতে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়।

তারা সিঁড়ির একেবারে শেষের দিকে যখন এসে পৌঁছায়, তখন বাবা রেলিংয়ের একটা রড আঁকড়ে ধরে আর ছেলেকে বলে, ‘থামো! থামো! এই পর্যন্তই। এর বেশি আর নিয়ো না।’ ছেলে অবাক হয়ে যায়। বাবা কী বলছে! তখন বাবা বলে, ‘একদিন আমিও আমার বাবাকে মারতে মারতে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলাম। আর এ জন্যই আজ আমাকে এর পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে।’

এ কারণেই আলিমরা বলেন, পিতামাতার সাথে যেমন আচরণ করবে দুনিয়াতে থাকতেই তার প্রতিফল পাবে আর আখিরাতের প্রতিফল তো রয়েছেই।


গল্প দুটো নিয়ে কিছু কথা (লস্ট মডেস্টি)

ভাইয়া/আপু,
গল্প দুটো কিন্তু কোনো বানানো গল্প নয়। একেবারে সত্যিকারের ঘটনা। আসো, আমরা আমাদের বাবা-মার সঙ্গে সবসময় ভালো আচরণ করব। কোনো বাবা-মা তার সন্তানদের খারাপ চান না। হয়তো তাঁরা তোমাকে ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না। তোমার যুগ, তোমার সময়, তোমার সংগ্রাম তাঁরা ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেন না। হয়তো তাঁরা তোমার ভালো চাইতে গিয়ে, ভালো করতে গিয়ে, মাঝেমাঝে ভুল সিদ্ধান্ত নেন। তোমার ভালো চাইতে গিয়ে ভুল কিছু করে বসেন। কিন্তু আল্লাহ এবং রাসূল ﷺ এর পরে তাঁরাই তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তুমি যেন একটু ভালো থাকো, একটু সুখে থাকো এ জন্য সারাজীবন শত দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করে নেন।

তোমার এই বয়সে হয়তো এসব ভালোমতো বুঝতে পারবে না। নিজের বাবা-মার চেয়ে গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড, বেস্টু, বেস্টি বা গ্যাংদের বেশি আপন মনে হবে। রাতে বাইরে থাকা যাবে না, একা একা ট্যুরে যাওয়া যাবে না, অমুক বন্ধুর সাথে মেশা যাবে না, টিকটক করা যাবে না, গেইম খেলা যাবে না… ইত্যাদি নানা ব্যাপারে বাবা-মার শাসনের কারণে হয়তো তাঁরা তোমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। কিন্তু বিশ্বাস করো ভাইয়া/আপু, আর কয়েকটা বছর পরেই বোঝা শুরু করবে তোমার সবচেয়ে আপন কারা ছিল—তোমার কথিত এবিউসিভ বাবা-মা নাকি গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড, বেস্টু, বেস্টি আর গ্যাং মেম্বাররা? কিন্তু তখন হয়তো জীবনের অনেক কিছুই হারাবে, জীবনখাতার সাদা কাগজ ভরে যাবে ক্লেদাক্ত কলুষতায়! আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। তোমার আশেপাশে বয়স তিরিশের কাছাকাছি, বিয়েশাদি করেছে, ১/২ টা বাচ্চা আছে, এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখো। উত্তর পেয়ে যাবে।

[লেখাটি ‘ষোলো’ পঞ্চম সংখ্যায় প্রকাশিত]