আমি কিন্তু বেশ সাহসী। সাহসী বলতে ভীষণ সাহসী। একেবারে কুছ পরোয়া নেহী টাইপের অবস্থা। ওদিকে আমার ছোট ভাইবোনগুলো খুবই ভীতু। ভীতু হলে কী হবে, ওরা ভূতের গল্প শুনতে খুব পছন্দ করে। সারাদিন আমার কাছে এসে ভূতের গল্প শোনার আবদার করে। বিভিন্ন ভূতের গল্পের বই থেকে আমি ওদের গল্প পড়ে শোনাই। মাঝে মাঝে নিজেও মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প বানিয়ে বলি। মামদো ভূত, গলাকাট্টি ভূত, শাকচূন্নি, ডাকিনী, মেছো ভূত আরও কত কিছু।

সেদিন বুঝলি শুক্রবার দুপুরবেলা, জুম্মার নামাজ পড়ে আসছি আমি। বারান্দায় আব্বু মোটরসাইকেল রাখে, জানিসই তো। মোটরসাইকেলের ওপর দেখি সাদা কাফন পরা একটা লোক বসে আছে। আমি কাছে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল!

ঐদিন রাতে আমি আর ইমরান ভাই এশার নামাজ পড়ে ফিরছি। সবুজদের কবরবাড়ির ঐখানে বিশাল একটা শিমুল গাছ আছে দেখেছিস না? ওই গাছে দেখি ইয়া লম্বা একটা জিন পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। পা দুটো বাঁশের মতো লম্বা। মাটিতে ঠেকে আছে। হাত বাড়িয়ে আমাদের ধরতে চাইল! আরে না! গুল মারছি না। বিশ্বাস না হলে ইমরান ভাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখ।

ইমরান ভাই আমাদের কাজিনদের মধ্যে সবার বড়। উনার ছেলেই আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়! ইমরান ভাই খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। আমাদের সবাইকে কড়া শাসনে রাখে। কাজেই ওরা যে ইমরান ভাইকে জিজ্ঞাসা করবে না, এটা আমি নিশ্চিতভাবেই জানতাম। এ কারণেই এমন গুলপট্টি ওরা ধরতে পারত না।

আরে জানিস, গতরাতে কি হয়েছে? রাত তখন দুইটা। আমি বাথরুমে গিয়েছি। বাথরুম সেরে বেসিনে হাত ধুচ্ছি। হঠাৎ চোখ পড়ল আয়নার ওপর। আয়নায় আমার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার একটা মানুষকে দেখা যাচ্ছে!

ভয়ে গুটিশুটি মেরে গল্প শুনছিল ওরা। কাপাঁকাপা গলায় প্রশ্ন করল মৌরি (৮ বছর বয়স)- ‘ভাইয়া, তুই তখন কী করলি? তোর ভয় লাগল না?’

‘আরে ধুর! কীসের ভয়। জিন-ভূতে আমার আবার ভয় আছে নাকি!’- তাচ্ছিল্ল্যের স্বরে বললাম আমি।

আয়না থেকে চোখ না সরিয়েই হুমকি দিলাম- ধর শালারে, আজকে তোরে কুরবানি দিব। সঙ্গে সঙ্গে  আয়নার ভেতরের জিন গায়েব!

চৈত্র মাসের ভরদুপুরে বা লোডশেডিংময় ঝড় বৃষ্টির রাতে এসব গল্প বেশি জমে। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে ভয়ও দেখাই। হয়তো ছোট বোন নুহা (১০ বছর বয়স) সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসেছে। টেবিলের পাশে খোলা জানালা। আমি তার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি কোনো একটা কারণে। হঠাৎ থেমে চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে এসে ওকে বললাম, ‘নুহা দেখ দেখ, ওই জানালা দিয়ে একটা কঙ্কাল হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে!’ সে জানালার পাশে না তাকিয়ে ভ্যা করে কেঁদে দেয় ভয়ে। আমি হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।

আবার ধরো, গ্রীষ্মের একেবারে আগুনঝরা দুপুর। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আমরা সবাই বাড়ি আছি। আমার ঘরের পাশেই চাচ্চুদের আম-কাঠাল-লিচুর বাগান। বাড়ির বড়রা সবাই ঘুমাচ্ছে। আমাদের চোখে তো আর ঘুম আসে না। বাগানে গিয়ে আম কুড়াই, লিচু খাই, গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে বানরের মতো লম্ফঝম্প করি। সবার ছোট যে রবিন, সে গাছে উঠতে পারে না। আমরা ভাইবোনেরা হয়তো সবাই গাছের ওপরে। সে নিচে। মাঝে মাঝে আমাদের মনে দয়া হলে একটা আম বা লিচু নিচে ফেলছি। ও খাচ্ছে।

হঠাৎ আমি পিলে চমকানো চিৎকার দিয়ে বলি- ‘এই রবিন, জলদি গাছে ওঠ। তোর পেছনে একটা গলাকাট্টি ভূত দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুনি তোর গলা কেটে নেবে।’

ও ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে!

ইয়ে মানে… একটা সত্য কথা বলি। প্রথমে নিজেকে যে খুব সাহসী হিসেবে দাবি করলাম, আমি কিন্তু আসলে তেমন সাহসী না। হাজার হোক, আমি তো ওদেরই ভাই। নুহা, মৌরি, রবিনকে ভয় দেখাতে ভালো লাগে সত্য। কিন্তু রাতে আমারও ভীষণ ভয় লাগে। রাতে বাথরুমের দরজা খোলা না রেখে বাথরুম করতে পারি না। অনেক রাতে ভয়ে তো বাথরুমেই যেতে পারি না। টয়লেট চেপে শুয়ে থাকি।

এক রাতে চাপ সামলাতে না পেরে ভাবলাম খালি কোকের বোতলে কাজ সারি। কিন্তু কাজ শুরু করার পর ঘটে গেল সর্বনাশ। হাফলিটার কোকের বোতল ভরে গেল, কিন্তু আমার হিসু আর থামে না। বোতল উপচিয়ে পড়ে আমার হাত, ঘরের মেঝে সব ভরে গেল! কী এক বিশ্রী অবস্থা!

ধুরো! গোপন কথা সবই বলে ফেললাম। তোমরা আবার কাউকে কিছু বোলো না কিন্তু। তাহলে আমার মান সম্মান কিছুই থাকবে না। ইমরান ভাইয়ের ছেলে প্রান্ত চাচ্চু বলেছে এটা জানাজানি হলে আমার নাকি আর কোনোদিন বিয়ে হবে না!

দুই.

বৈশাখ মাসের বিকাল। মাসজিদের মাঠে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। চারিদিকে  উৎসব উৎসব ভাব। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষজন এসেছে। আমাদের বাড়িও আত্মীয়স্বজনে ভরে গিয়েছে। খালাতো ভাই শামীম, তানজিল, সোহাগ, মুনতাসির, ফুপাতো ভাই ওমর, গালিব, নাহিদ, শাহরিয়ার সবাই এসেছে। সেই হইহূল্লোড় করছি সবাই মিলে। দুপুরে হাঁসের মাংস আর চালের আটার রুটি দিয়ে জম্পেশ একটা খাওয়া দিয়ে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম ওয়াজের মাঠের উদ্দেশে।

নাহিদ ভাই নতুন চাকরি পেয়েছে। নতুন চাকরির টাকায় প্রাণভরে আমরা জিলাপি, মিষ্টি, সন্দেশ, পিয়াজি, বেগুনি খেলাম সারা বিকেল ধরে। মাগরিবের নামাজের পর শুরু হলো ওয়াজ। আমরা ছিলাম একেবারে পেছনে… মাদুরে বসে। ওয়াজ শোনা আর কীসের কী, এ ওরে চিমটি কাটছে, এ ওর মাথায় গাট্টি মারছে, নিচু স্বরে কেউ কিছু বলছে আর তা শুনে হাসির রোল পড়ছে… এভাবেই আমাদের সময় পার হচ্ছে। আমার চোখ অবশ্য বারবার চলে যাচ্ছিল মাঠের একপাশের পুকুরের ধারের আমগাছটার নিচে। সেখানে বিশাল বিশাল ডেকচিতে মেজবানি রান্না হচ্ছে! না চাইতেও কেন জানি জিহ্বায় শুধু পানি চলে আসছে। ওয়াজ শেষ হলে সবাইকে খেতে দিবে। আজকে যত রাতই হোক মেজবানি খেয়ে যেতে হবে- সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।

এশার নামাজের পর জোর হাওয়া বইতে শুরু করল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দুই এক ফোটা করে বৃষ্টিও পড়ছে। প্রান্ত চাচ্চু বলল- ‘চলো সবাই, বাড়িতে যাই। তুমুল বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। বাসায় যাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে পরে।’

রবিন এদিকে গালিব ভাইয়ের কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে। সবাই চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। থাকবই। ওরা আমাকে অনেক  জোরাজোরি করল। অনেক বোঝাল। কিন্তু আমার এক কথা- আমি থাকবই। ওয়াজ শুনে তবেই বাসায় ফিরব।

ঝড় বৃষ্টির আশঙ্কায় ওদের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই চলে গেল ময়দান থেকে। আমি থেকে গেলাম। অল্প কয়েকজন মানুষ আছে কেবল। আমার খুশি তো আর ধরে না। মেজবানি রান্না এরইমধ্যে শেষ। একজন পাঁচজনের খাবার পাবে আজকে।

প্রান্ত চাচ্চুরা চলে যাবার দশ মিনিটের মাথায় তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। ওয়াজের প্যান্ডেল কোথায়, শামিয়ানা কোথায়, মাদুর কোথায় তার আর কোনো ঠিক ঠিকানা থাকল না। যে যেভাবে পারে পড়িমরি করে মাসজিদের ভেতরে আশ্রয় নিল। আমাদের মাসজিদটা বিশাল। অনেক লোক ধরে। কাজেই ভেতরে কোনো সমস্যা হলো না। সবাই একটু ধাতস্থ হবার পর মাসজিদের ভেতরেই ওয়াজ শুরু হলো।

সবার মধ্যেই একটু দ্রুত ওয়াজ শেষ করার লক্ষণ দেখলাম। আমন্ত্রিত বক্তারা তাদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করছেন। আমিও মনে মনে খুশি হচ্ছি। তাড়াতাড়ি মেজবানী খাওয়া যাবে এখন। শেষ বক্তার আগের বক্তা ওয়াজ করছেন। এমন সময় আমার পেটের মধ্যে একটা চক্কর দিয়ে উঠল। একটু পর আবার।  ঢেকুর উঠল পরপর কয়েকটা। ঢেকুরের পঁচা গন্ধে বুঝতে পারলাম দুপুরের হাঁসের মাংস আর চালের আটার রুটি হজম হয়নি। একটু পর টয়লেটের ভীষণ প্রেসার আসলো। বাইরে অন্ধকার ঝড়-বৃষ্টির রাত। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। মাসজিদের টয়লেট মাসজিদের মূল ভবন থেকে একটু দূরে। এরমধ্যে একা একা কীভাবে টয়লেটে যাব? আশেপাশে তাকালাম, পরিচিত কেউ নেই। প্রেসার চেপে রাখাও যাচ্ছে না। মাসজিদ ভরিয়ে ফেলার মতো অবস্থা। মানসম্মান একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে টয়লেটে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

বৃষ্টিতে ভিজেই টয়লেটে যেতে হবে। মাসজিদ থেকে বের হয়ে দশ ধাপ ফেলেছি এমন সময় সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে গেল। কৌতূহলের চাপ সামলাতে না পেরে হাগু মহাশয় পেট থেকে পৃথিবীতে বের হয়ে আসলেন! এমন অবস্থায় মাসজিদে তো আর ফিরে যাওয়া যাবে না। খুব মন খারাপ হলো। আহারে! আমার আর মেজবান খাওয়া হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই একটা কথা মনে হতে ভয়ে আতঙ্কে পুরো শরীর কাঁপতে লাগল। রাত বাজে বারোটা। এই অন্ধকার ঝড়-বৃষ্টির রাতে আমি একা একা বাসায় যাব কীভাবে? সঙ্গে ফোনও নেই।

মৌরি, নুহা, রবিনদের যত ভূতের গল্প শুনিয়েছি সব একে একে মনে হতে থাকল। হাত-পা কাঁপাকাপির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। এখন উপায়? হাজার ভেবেও কোনো কূলকিনারা পেলাম না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম, যে করেই হোক যেতে হবে। এক হাতে স্যান্ডেল নিলাম, প্যান্ট গুটিয়ে নিলাম হাঁটু পর্যন্ত। হাগু মহাশয় প্যান্টের ভেতরে বিচরণ করার ফলে বেশ অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু কী আর করার!

বিসমিল্লাহ বলে যত দুআ-দরুদ সূরা জানি সব জোরে জোরে পড়তে পড়তে দৌড় দিলাম। তুমুল বৃষ্টি, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন, বাজ পড়ছে, গলাক্কাটি, মামদো, ডাকিনী, শাকচুন্নি সব ভূতের কথা মনে পড়ছে। বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি। এর মধ্য দিয়েই আমি দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির একেবারে কাছাকাছি চলে আসলাম। সুমনদের বাড়ি পার হলেই আমাদের বাড়ির সীমানা শুরু হবে। এমন সময় স্বশব্দে বাজ পড়ল। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় আমি যা দেখলাম তাতে ভয়ে মরে যাবার অবস্থা। সুমনদের বাড়ির বারান্দায় সারিবেধে ১০/১২ টা সাদাকাফন পরা ভূত দাঁড়িয়ে আছে।

আল্লাহ গো বাঁচাও আমাকে! ওরে আল্লাহ, ও আল্লাহ, মেরে ফেলবে এরা আমাকে… এমন চিৎকার দিতে দিতে আমি কখন যে বাড়িতে এসে পৌঁছালাম, কখন দরজায় পাগলের মতো ধাক্কাধাক্কির ফলে আব্বু দরজা খুলে দিল, কখন আমি উঠোনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম তার কিছুই মনে নেই!

তিন.

আমার হুশ ফিরল পরের দিন সকাল দশটায়। খাবার ঘরে সবাই উচ্চস্বরে হাসাহাসি করছে। ঘুরে ফিরে আমার নাম আসছে। আমাকে নিয়ে সবাই মজা করছে কেন? ব্যাপার কী?

তৎক্ষণাৎ আমার গতরাতের ঘটনা সব মনে পড়ে গেল। সবার ওপর খুব রাগ হলো। আমি ভূতের গ্যাংয়ের খপ্পর থেকে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছি। আর সবাই আমাকে নিয়ে এমন মজা করছে! প্রচণ্ড ক্রোধে বিছানা খামচে ধরে পড়ে রইলাম। কতক্ষণ পড়ে রইলাম জানি না। প্রান্ত চাচ্চুর কণ্ঠে সচকিত হলাম। হাসিহাসি মুখে বলল -কী ভাতিজা! ঘুম তাহলে ভাঙল তোমার!

প্রান্ত চাচ্চুর কথা শুনে মৌরি, নুহা, রবিন, শাহরিয়ার… সবাই দৌড় দিয়ে ঘরে আসলো।

ভাইয়া, তুমি নাকি অনেক সাহসী! তাহলে ভূত দেখে প্যান্ট ভরে হেগে দিয়েছিলে কেন?- রবিন নিষ্পাপ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করাতে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমি লাফ দিয়ে উঠে ওকে মারতে গেলাম। কিন্তু ও এরই মধ্যে ইমরান ভাইয়ের পিছনে গিয়ে লুকিয়েছে। সদা গম্ভীর ইমরান ভাই পর্যন্ত হাসছে।

আর সহ্য করতে পারলাম না। প্রচণ্ড ক্রোধে বিস্ফোরিত হয়ে আমি বললাম- তোমরা সবাই আমাকে নিয়ে মজা করছ! অথচ আমি কাল রাতে কী ভয়ংকর বিপদে পড়েছিলাম। সুমনদের উঠানের ১০/১২ টা ভূত আমার ঘাড় মটকে দিতে আসছিল!

‘কচু ভূত! ঐগুলো সব সারের বস্তা!’ মুখ ভেংচিয়ে বলল নুহা।

আমি ওর চুলের বেনী ধরে জোরে টান দিলাম – আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি, ওগুলো সারের বস্তা না ভূত!

ব্যাথা পেয়ে চিৎকার করে উঠল সে। মৌরি ওকে সমর্থন দিয়ে বলল- না ভাইয়া, ও ঠিকই বলেছে। ওগুলো আসলেই সারের বস্তা ছিল। ভূত না। ইমরান ভাই নিজের চোখে দেখে এসেছে!

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কী বলছে সবাই! সারের বস্তা!

সোহাগ ভাই এতক্ষণ হাসিমুখে আমাদের সবার কথা শুনছিল। এবার সে মুখ খুলল-

শোন, তুই গতরাতে ’সুমনদের উঠানের সাদা কাফন পড়া ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, ও আল্লাহ বাঁচাও আমাকে’ ইত্যাদি বলতে বলতে উঠানে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়িস। আমরা সবাই তো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। ইমরান ভাই তৎক্ষণাৎ ওমর আর গালিবকে নিয়ে বেরিয়ে যায় সুমনদের উঠানে। কারা তোকে মারতে চায় দেখার জন্য।

আম্মা, ফুপি, খালা সবাই কান্নাকাটি শুরু করেছে। তোর আব্বা মানে খালু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। আমরা পানির ঝাপটা দিয়ে বহুকষ্টে তোর জ্ঞান ফেরাই। জ্ঞান ফিরে তুই বারবার বলতে থাকিস সুমনদের উঠানের ভূতগুলো আমাকে মেরে ফেলবে, ওরা আমাকে তাড়া করেছে। আর তোর গায়ের সে কী কাঁপুনি।

তোর ভেজা জামাকাপড় খুলে শুকনো জামাকাপড় পরিয়ে ২/৩ টা কাথা চাপানোর কথা বললেন বড় খালু। আমরা প্যান্ট খুলে আবিষ্কার করলাম তুই ভয়ে টয়লেট করে ফেলেছিস।

দুহাত তুলে সোহাগ ভাইকে বাধা দিলাম আমি- আরে না ভাই, আমি ভূতের ভয়ে টয়লেট করিনি। বিশ্বাস করেন, ভাই। দুপুরের হাঁসের মাংস বেশি খাওয়ার কারণে আমার পেট খারাপ হয়ে যায়। মসজিদের টয়লেটে যাবার সময় চাপ আর ধরে রাখতে পারিনি। তখনই আমার প্যান্ট নষ্ট হয়ে যায়।

কেউই আমার কথা বিশ্বাস করল না। সবাই মুখে ব্যঙ্গের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সোহাগ ভাই আবার বলা শুরু করল- চাপাবাজি করিস না। তোর চাপাবাজির দিন শেষ। তোর গায়ে ২/৩ টা কাথা চাপানো শেষ হতেই হাসতে হাসতে হাজির হলো ইমরান ভাইয়েরা। কী হয়েছে জানতে চাইলেন খালু। ইমরান ভাইয়েরা তো হাসির চোটে কথাই বলতে পারেন না এমন অবস্থা। শেষমেষ বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে গালিব বলল- মামা, আর বইলেন না। সুমনদের বাড়ির বাইরের বারান্দায় ১০/১২ টা সাদা সারের বস্তা রাখা ছিল। ও তো এমনিই খুব ভীতু। এর ওপর ঝড়বৃষ্টির রাত। ওগুলোকেই ভূত মনে করে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে!

আমি সবাইকে বলতে গেলে প্রায় পা ধরে অনুরোধ করলাম গতরাতের ঘটনা যেন কারও সঙ্গে শেয়ার না করে। সবাই রাজি হলো। কিন্তু কয়দিন না যেতেই দেখি এলাকার প্রায় সবাই জেনে ফেলেছে। আমার আর মুখ দেখানোর উপায় রইল না। সবাই আমাকে পঁচাতে লাগল।

তবে সবচেয়ে আঘাত পেলাম প্রান্ত চাচ্চুর কথায়। প্রান্ত চাচ্চু গ্যারান্টি দিয়ে বলেছে- আমার নাকি কোনোদিন বিয়ে হবে না। এমন ভীতু ছেলের সাথে কেউ মেয়ে বিয়ে দেবে না!

তবে সেদিন ভূত দেখতে না পেলেও সত্যিকারের ভূত মানে জিন আসলেই দেখেছিলাম এরপর। বেশ কয়েকবার। সেই গল্প আজ আর নয়। অন্য আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। না, গুল মারছি না। সত্যিই দেখেছি কিন্তু!