গুনে গুনে পঞ্চাশটি রাত পার হয়ে গেল। প্রিয় মানুষটা এখনো তাঁর সাথে কথা বলছেন না। তিনি যখন সালাতে দাঁড়ান, উনি তখন তাঁর দিকে একটু তাকান। তিনি সালাম ফেরালে, উনি চোখ ঘুরিয়ে নেন। চুপিসারে, আস্তে আস্তে, ছোট্ট শিশুর মতো নীরব চাহনি দিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকতেন এই আশায়—এই বুঝি উনি তাকালেন আমার দিকে। উনার মজলিসগুলোতে আগে-আগে সালাম দিতেন, আর একবুক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন উনার ঐ পবিত্র ঠোঁটজোড়ার দিকে। একটু যদি নড়ে... আমার সালামের উত্তরটা যদি পাই...

শুধু প্রিয় মানুষটাই না, একে একে সব সঙ্গী-সাথি উপেক্ষা করতে শুরু করলেন তাঁকে। হৃদয়-সাগরে উপচে পড়া ব্যাথার ঢেউ নিয়ে তিনি গেলেন চাচাতো ভাইয়ের কাছে। সালাম দিলেন, কিন্তু উত্তর পেলেন না। তবুও বুকে ক্ষীণ আশা নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি বিশ্বাস করো যে, আমি উনাকে খুব ভালোবাসি? তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি।’ চাচাতো ভাই আশানুরূপ উত্তর দিলেন না। পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে ফিরে এলেন সেখান থেকে।

রাতের পর রাত কেঁদেই গেছেন তিনি। প্রতিটা রাতজাগায়, কান্নার প্রতিটা ফোঁটায়, প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসে স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন এক ভোরের। যেই ভোরে কোনো কষ্ট থাকবে না। প্রশান্ত হৃদয়ে উনি আবার আমায় বুকে জড়িয়ে নেবেন। উনাকে আবার আমি কবিতা শোনাব। উনি মুগ্ধের মতো আমার কবিতা শুনবেন। দুআ করবেন আমার জন্য।

পঞ্চাশতম ভোরে তিনি ফজর সালাত আদায় করলেন। মনে হলো, পুরো পৃথিবী কেমন যেন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এই পৃথিবী উনার কাছে চিরঅচেনা। বিশাল একটি পাহাড়ের ওপর থেকে ভেসে এলো এমন কিছু শব্দ, যেগুলো ছাপিয়ে গিয়েছিল শব্দের বৈশিষ্ট্য। একে কী স্রেফ শব্দ বলা চলে? পঞ্চাশ রাতের হুহু করা কষ্ট, কান্না, শূন্যতাকে এক নিমিষেই উড়িয়ে দিল এই শব্দেরা :

“হে কা'ব ইবনু মালিক, সুসংবাদ নাও!

হে কা’ব ইবনু মালিক, সুসংবাদ নাও!”

বলছিলাম রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আনসার এবং কবি সাহাবি কা’ব ইবনু মালিক রদিয়াল্লাহু আনহুর কথা। নিজের সামান্য ভুলের কারণে তাবুক যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি (তাঁর সাথে আরও দু’জন সাহাবি ছিলেন, যাঁদেরও একই ভুল ছিল)। যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন ফিরলেন এবং তাঁদের ওজর শুনলেন, এরপর পঞ্চাশ রাত পর্যন্ত কথা বলেননি তাঁদের সাথে।

পরবর্তীতে পঞ্চাশতম দিনের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী আসে যে, কা’বকে এবং তাঁর মতো অন্য দুই সাহাবিকেও ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। এই সংবাদ শোনার পর তিনি দৌঁড়ে ছুটে গেলেন প্রিয় নবিজির কাছে। খুশিতে পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠেছিল নবিজির চেহারা। এরপর বললেন—“সুসংবাদ নাও জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনের, হে কা’ব।”[1]

কী এমন জিনিস আছে, যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনের আয়াত নাযিল করার মাধ্যমে তাঁদের ক্ষমা নিশ্চিত করেছেন? চিন্তা করো, যুদ্ধে না যাওয়ার মতো ভয়াবহ অপরাধের পরেও আল্লাহ সুবনাহু ওয়া তাআলা আজ তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট! কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের তিলাওয়াতে ভেসে উঠবে উনাদের কথা! কী এমন কারণে হয়েছে, বলো তো!

তাওবা। মুমিনের এমন একটি হাতিয়ার, যা দিয়ে সে শয়তানের কোমর ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে। ঠুনকো এই দুনিয়ার আমরা কেউ-ই পারফেক্ট নই। দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা ভুল করেই ফেলি। ভুল হওয়াটাই আমাদের ফিতরাত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে। আর পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম, যারা তাওবা করে।”[2]

অর্থাৎ, গুনাহ কমবেশি সবার দ্বারাই হয়; কিন্তু গুনাহগারদের মধ্যে তাওবাকারীরাই সবচেয়ে উত্তম। গুনাহকে যে আঁকড়ে ধরে, জীবন তার জন্য হয়ে উঠবে সংকীর্ণ।[3] একের-পর-এক নিয়ামত ছিনিয়ে নেওয়া হবে তার কাছে থেকে। সবশেষে অন্তর হয়ে উঠবে কঠিন। আর যারা গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নেয় তাওবার পবিত্র ঝরনায়, আল্লাহ তো তাঁদের আরও কাছে টেনে নেন। ভালোবেসে তাঁদের শামিল করে দেন নিজের প্রিয় বান্দাদের মধ্যে।

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর কাছে তাওবা করে, এবং তিনি তাদেরকে ভালোবাসেন যারা নিজেদেরকে পবিত্র করে।”[4]

গুনাহে জর্জরিত অন্তর জানতেও পারে না আল্লাহ তাঁকে কতটা ভালোবাসেন। আল্লাহ নিজের অশেষ অনুগ্রহে তাঁকে দান করেন কলবুন সালীম। যেই কলবে ব্যাথা জমে না, যেই কলবে কান্না ঝরে মুক্তো হয়ে।

ভাই আমার, বোন আমার, গুনাহ হয়ে গেলে তাই বিলম্ব কোরো না। সাথে সাথেই তাওবা করো। তাওবার বৃষ্টিতে ধুয়ে ফেলো হৃদয়ের সমস্ত পঙ্কিলতা। প্রস্তুত করো এক কলবুন সালীম, যার পুরস্কার সুবিশাল জান্নাত! আসমান এবং জমিনের চেয়েও বিশাল জান্নাত!


[1]  সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন, খণ্ড ২

[2] তিরমিযি, আস-সুনান, হাদীস নং : ২৪৯৯

[3] সূরা ত্ব-হা, ২০ : ১২৪

[4] সূরা বাকারা, ২ : ২২২