ভালোবাসা। হৃদয়ের সবচেয়ে পবিত্র অনুভুতির নাম, সবচেয়ে নিষ্কলুষ। বর্ষার বৃষ্টিভেজা কদমফুল যেমন, ভালোবাসা তেমন। বলতে পারেন বসন্তের আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া অথবা শরতের নরম মোলায়েম দুধসাদা কাশফুল।

“পৃথিবী কীভাবে চলে?” এর উত্তরে তাত্ত্বিকেরা নানান তত্ত্ব হাজির করতে পারেন। তবে এই মৌলিক তত্ত্বে কেউ দ্বিমত করবেন না যে, “পৃথিবী চলে ভালোবাসার উপর।” সম্পর্কগুলোর ভালোবাসার উপর।

ভালোবাসা পৃথিবী চালায়, সেই প্রয়োজনে তাকে নানান রুপ নিতে হয়। মা-বাবার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা।

জীবনটা অসহনীয় লাগছে। একটু স্বস্তির খোঁজে মায়ের কোলে মাথাটা এলিয়ে দিলেন, মা সাহস দিলেন। এটাকে কি ভালোবাসা বলা যায় না?

কোনো এক বিদায়ক্ষণে ছোট বোনটার বাড়ির দরজার জলপাই গাছের আড়ালে গিয়ে চোখের পানি ফেলা, এটাকে কী বলা যায়?

দু’জন নারী-পুরুষের দু’টা স্বাক্ষর আর কিছু শব্দের মাধ্যমে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা- এটাকে কি নিছক আইনী সম্পর্ক বলে ইতি টানা যায়?

শেষ বয়স, শারিরীক কোনো আকর্ষণ নেই, তারপরও কী এক টান, দরদ—এটাকে কোন আইন দিয়ে বিচার করবেন?

আচ্ছা, এই তো হচ্ছে চোখে দেখা দুনিয়াবি সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে। সময় এবং পরিস্থিতির উত্থান-পতনে যে ভালোবাসাগুলোয় বেশি কম হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

এবার কিছুক্ষণের জন্য চোখজোড়া বন্ধ করুন। ফিরে যান ১৪০০ বছর আগে। যে সময়টাতে আপনার কোনো অস্তিত্বই ছিল না, সে সময়টাতেও একজন মানুষ আপনাকে ভালোবেসেছেন, তাঁর মজলিসে আপনাকে নিয়ে কথা বলেছেন, আপনাকে মনে করে চোখের পানি ফেলেছেন। আবার এমন এক সময়েও তিনি আপনাকে নিয়ে পেরেশান হবেন, যখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেদিনও তিনি আপনার জন্য কাঁদবেন, রবের সামনে আপনার ক্ষমার জন্য উপুড় হয়ে পড়ে থাকবেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

সুবহানাল্লাহ, আল্লহু আকবার। যে আল্লাহ এই ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাহলে কতটা ভালোবাসাময়। যিনি নিজের নাম দিয়েছেন আর-রহমান, আর-রহীম। যার রহমত, যার ভালোবাসা তাঁর বাধ্য-অবাধ্য সবার উপরে পরিব্যাপ্ত। আল্লহু আকবার। তিনি ভালোবেসে আদমকে আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন, ভালোবেসে তাকে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন।

ভালোবাসার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয় গেছে আজ। কর্পোরেটোক্রেসি এই সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে। ভালোবাসার স্রষ্টার বিধান উপেক্ষা করে আজ ভালোবাসার সংজ্ঞায়ন করছে ওরা। যান্ত্রিকতার যাঁতায় নিখাঁদ ভালোবাসাগুলোতেও আজ পরিবর্তন আসছে। শহরের নামি-দামি হোটেলগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকায় ভালোবাসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

বর্ষার কদম যতক্ষণ গাছে থাকে, ততক্ষণই সেটা পবিত্র। কাদায় পড়লে সে তার পবিত্রতা হারায়, সৌন্দর্য বিকিয়ে যায়। ভালোবাসা আজ কাদায় গড়াগড়ি করছে।

পৃথিবী চলে ভালোবাসার চাকায় ভর করে।

এখন আর কৃষ্ণচূড়া ফুটতে দেখি না। শিমুল পলাশও চোখে পড়ে না অনেকদিন। বন্ধুকে বলছিলাম—“শীত পড়ে, কিন্তু এখন তরকারিতে আর আগের মতো স্বর পড়ে না। আগের মতো সকালের টাটকা রোদে উঠোনে বসে স্বরপড়া তরকারি দিয়ে কড়াভাতের স্বাদটা নিতে পারি না।”

বন্ধুর এক শব্দবন্ধে প্রতিউত্তর ছিল—“ক্লাইমেট চেইঞ্জ।”

আপাতদৃষ্টিতে হয়তো সবারই উত্তর হবে এটাই—ক্লাইমেট চেইঞ্জ। আমি বলব—ভালোবাসার অভাব, ভালোবাসা নেই। পৃথিবীর একশ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোভ, পুঁজির এককেন্দ্রীকরণ, মানুষের প্রতি ভালোবাসাহীনতা এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের লালসা দিন দিন পৃথিবীর স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে।

আচ্ছা, আপনার কি সিরিয়ার তিন বছরের সেই বাচ্চাটাকে মনে আছে? যে নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি অভিমান নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে একরাশ অভিমান নিয়ে বলেছিল—“আমি আল্লাহকে সব বলে দেবো।”

মনে আছে আরেক সিরিয়ান শিশু আয়লান কুর্দির কথা? যে ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে তুরষ্কের বদরুম সৈকতের কিনারে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা তিন বছরের আয়লানের মরদেহ যেন আমাদেরকে চিৎকার করে বলছিল—“তোমাদের বুকে একটুও ভালোবাসা নেই, তোমরা ভালোবাসতে জানো না।”

ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা প্রদানকারীদের ‘ভালোবাসায়’ এখনো জ্বলছে সিরিয়া, ইরাক, কাশ্মীর, ফালাস্তিন। উইঘুরের বাচ্চারাও আজকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে চিৎকার করছে ভালোবাসার জন্য।

বলেছিলাম পৃথিবী চলে ভালোবাসার উপর। আল্লাহ ভালোবেসে পৃথিবী বানিয়েছেন, সেখানে মানুষ পাঠিয়েছেন। আবার সেই ভালোবাসার অভাবেই পৃথিবী ধ্বংস করে দেবেন। যেদিন আল্লাহর নাম নেওয়ার মতো একজন মানুষও পাওয়া যাবে না, আল্লাহকে ভালোবাসার মতো কেউ থাকবে না।

ভালোবাসার পূনঃসংজ্ঞায়ন জরুরি। কদমকে তার ডালেই রাখুন, বৃষ্টিতে ভিজে আবার পবিত্র হোক। কৃষ্ণচূড়ার লালে আবার ছেঁয়ে যাক আমাদের আঙ্গিনা। আবার শিমুল-পলাশ ফুটুক। শরতের মৃদু বাতাসে কাশবনে কাশফুলেরা আবারও দোল খাক। পৃথিবী আবার তার স্বাভাবিকতা ফিরে পাক।