আমাদের মাঝিবা, সালমান শাহ ও মৌসুমী[1]

১৯৯৪ সালে ১০ই জুন মুক্তি পায় জনপ্রিয় রোমান্টিক এক বাংলা ছবি। এ ছবির কিছু দৃশ্যের শুটিং করা হয়েছিল সেন্টমার্টিনে। অভিনয় করেছিলেন সেকালের সুপারস্টার ও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহ ও সেরা অভিনেত্রী মৌসুমী। শিবলি সাদিক পরিচালিত আশা প্রোডাকশনের এ ছায়াছবিতে সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপের কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়। ছেঁড়া দ্বীপের ঘাটের নাম ‘সালমান শাহ ঘাট’। কারণ এ ঘাটে সালমান শাহ-ই প্রথম কোনো নায়ক বা পর্যটক, যে এখানে নেমেছিল! আর ছেঁড়া দ্বীপে যে বড় পাথরটি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐটার নাম ‘মৌসুমী পাথর’। কারণ এখানে নায়িকা মৌসুমী শুয়েছিল! এটি সেন্টমার্টিনের প্রথম শুটিং। যদিও পরিচালক শুটিং শেষ করতে পারেননি। ট্রলার রিজার্ভ করে প্রশাসনের সহযোগিতায় পালাতে হয়েছিল পুরো টিমকে!

আজকে সে স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করব!

শীতের এক দুপুর। নায়ক, নায়িকা ও স্টাফ মালামাল নিয়ে একটা ট্রলার ঘাটে ভিড়ে।

কুলির কাঁধে চড়ে আর ঠেলাগাড়ি করে সব নিয়ে যাওয়া হলো বিডিআর[2] ক্যাম্পে। সেন্টমার্টিনে কোনো হোটেল-রিসোর্ট না থাকায় তারা আগে থেকেই বিডিআর ক্যাম্পে থাকার অনুমতি নিয়ে এসেছিল।

সন্ধ্যা হতে হতে জানাজানি হয়ে যায়। বিডিআর ক্যাম্পে যারা আসছে সবাই শুটিং পার্টি! কৌতূহলী লোকজন তাদের দেখতে এক প্রকার ভিড় করছিল। নায়ক-নায়িকারা আসলে দেখতে কেমন? তারা সাধারণ মানুষের মতো না কি অন্যরকম? এরকম নানান প্রশ্নের তাড়নায় আমিও দেখতে গিয়েছিলাম। কাছে যেতে পারিনি। ঝাউগাছ পর্যন্ত যেতেই পুলিশ আটকে দেয়। সাধারণ মানুষের সেখানে যাওয়া নিষেধ।

পরদিন সকাল। পাড়ার মুরব্বিরা বৈঠকে বসছে। দ্বীপে শুটিং করতে দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো দ্বীপের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে এখানে অবৈধ ও বেহায়া কাজ করতে দেওয়া হবে না।

সকালে শুটিং পার্টি বোট রিজার্ভ করে ছেঁড়া দ্বীপ যায়। বেশ কিছু ফুটেজ নিয়েছে, নিচ্ছে—এমন একটা সময় চলছে। এদিকে মাঝিবার নেতৃত্বে দ্বীপের আলিম সমাজ ও ময়মুরুব্বি সবাই লাঠিসোঁটা ও কংকর নিয়ে হাঁটাপথে রওনা হয়েছেন! দ্বীপবাসীর কথা—যেভাবেই হোক দ্বীপে শুটিং করতে দেবে না তারা। বেহায়াপনা সাধারণ দ্বীপবাসীর মনে খারাপ ধারণা দেবে।

বিকেলের দিকে দ্বীপের তৌহীদি জনতার মিছিল হঁলবনিয়া পর্যন্ত পৌঁছায়। আর শুটিং পার্টিও ছেঁড়া দ্বীপের শ্যুট শেষে মূল দ্বীপের হঁলবনিয়াতে কাজ করছে।

জনতাকে লাঠিসোঁটা নিয়ে আসতে দেখে পুলিশ দ্রুত নায়ক সালমান শাহ ও নায়িকা মৌসুমীকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়। পুলিশ অফিসার ও সিনেমার পরিচালক মাঝিবাকে তথা দ্বীপবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মাঝিবা দ্বীপে শ্যুটিং করতে দিতে রাজি ছিলেন না। উনার সাফ কথা—‘আমি বেঁচে থাকতে দ্বীপে অশ্লীল ও বেহায়াপনা কিচ্ছু হতে দেবো না।’

নায়ক-নায়িকা দ্বীপ ছাড়তে দেরি করলে তাদের মেরে মাছকে খাওয়াবে বলে হুমকি দিল জনতা! মিছিল ও বিক্ষোভ বেসামাল দেখে পুলিশ দ্রুত বোটের মাঝিকে ডেকে পাঠাল।

ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার জন্য যে বোট রিজার্ভ করা হয়েছিল, সেটাতে করে সালমান শাহ, মৌসুমী ও অন্যদের সরাসরি শাহাপরীর দ্বীপ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিনেমার বাকি শ্যুটিং ওখানে করা হয়।

একটা গানের শুটিং এর কিছু অংশ সেন্টমার্টিনে করা হয়। তবে গানের সব দৃশ্য সেন্টমার্টিন নিতে পারেনি পরিচালক। দ্বীপবাসীর বাঁধার মুখে বাকি দৃশ্যগুলো নেওয়া হয় ইনানী পাথুরে সৈকতে। যেন সাধারণ দর্শক বুঝতে না পারে।

অবশ্যই দ্বীপে সালমান শাহ ও মৌসুমীর অনেক ভক্তও ছিল। যারা সম্মান ও লজ্জার কারণে মাঝিবার সামনে প্রতিবাদ করতে পারেনি।

মাঝিবা ছিলেন অকুতোভয় ও দুঃসাহসী। অসাধারণ নেতৃত্বগুণের অধিকারী। পুলিশ বা প্রশাসন তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করত। তাঁর কথা শুনত।

কিন্তু এখন সব পালটে গেছে! সেন্টমার্টিনে এখন ঘরে ঘরে নায়িক-নায়িকা। টিকটক ও ফেসবুক রিল স্ক্রল করলে দেখা যায়। আমাদের সমাজ আজ কোথায় এসে দাড়িয়েছে!

বাবা-মা তাদের সন্তানদের টিকটক নায়ক বা নায়িকা হওয়া নিয়ে গর্ব করে! বিয়ের প্রস্তাব আসলে বলে বেড়ায়—‘আমার অমুকের এত এত ফলোয়ার! ব্যপক জনপ্রিয় আমার অমুক!’

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


[1] প্রথম পর্ব পড়ে নাও এখান থেকে

[2] বর্তমান নাম বিজিবি