বসন্তের তপ্ত দুপুর। ক্লাস পালানো দলছুট আমরা কয়েকজন স্টেডিয়ামে ঢুকলাম। হাতে ব্যাট আর বল। ক্লাস পালিয়েছি কিনা নিশ্চিত না। কারণ টিফিনের পর আমাদের স্কুলে খুব কম দিনই ক্লাস হয়। নিশ্চিত না হয়ে তাই নিজেদেরকে ‘ক্লাস পালানো’ ট্যাগটা দেওয়া উচিত নাও হতে পারে।

ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র ছিলাম। ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। এইটে পেতে পেতেও পাইনি। তবুও বেশ নামডাক ছিল ক্লাসে। মাঝেমধ্যেই তাক লাগিয়ে দিতাম ম্যাথ, হাইয়ার ম্যাথে হাইয়েস্ট মার্ক পেয়ে।

এতকিছুর পরও নানান কুকীর্তির রেকর্ডও ছিল। কিছু আবার আব্বুর নজরেও পড়ে গিয়েছিল। শাস্তিস্বরূপ এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। শহরের স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন। হোস্টেলে থেকে পড়বো। হোস্টেল সুপার নাকি খুব কড়া। ছাত্রদেরকে সবসময় টাইট দিয়ে রাখেন। নো রঙ-তামাশা। অনলি পড়া ইজ রিয়েল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ফায়দা তেমন হলো না। হোস্টেলের ছকে বাঁধা জীবনে শয়তানি কমেছে বটে, পড়াশোনার হাল হয়েছে নাজেহাল। রেজাল্টে যোগ হয়েছে ফেইলের মাইলফলক। আবারও নতুন সিদ্ধান্ত হলো। বাসা নেওয়া হবে। আম্মু আর ছোট ভাই চলে আসলো। পড়াশোনাও আবার ছন্দ ফিরে পেল।

টেনে ওঠার পর বাসা পাল্টালাম। প্রেম প্রেম পাগলামির গল্পটা সেখানেই রচিত হয়েছিল। প্রাণোচ্ছল কিশোরী ছিলে তুমি। দুষ্টু মিষ্টি হাসি আর স্বাধীনচেতা চালচলন একদম ঘায়েল করে ফেলল আমায়। ফ্রক পরা এক উঠতি বয়সী বালিকার প্রেমে পড়লাম আমি।

চার ক্লাস জুনিয়র ছিলে তুমি। ‘তুমি’ করে ডাকার জন্য তাই কোনো ‘পারমিশন’ নিতে হয়নি। একই ফ্লোরের বাসিন্দা হওয়ায় প্রতিদিনই দেখতে পেতাম তোমায়। কিন্তু কথা বলার সাহস পেতাম না। না বলা কথাগুলো জমা হতে হতে হিমালয়ের মত উঁচু হয়ে গেল।

পড়াশোনায় ভালো ছিলাম তা কোনোভাবে জানতে পেরেছিলে তুমি। আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন চলে এলে আমার রুমে। পাটিগণিতের অংক বুঝার জন্যে। ঘন্টায় ৫ কি.মি. গতিবেগের স্রোতের বিপরীতে চলা নৌকার গতিবেগ কত হলে ১০ মিনিটে ২ কি.মি. সামনে যেতে পারবে। নিজেকে সেদিন অংকের সেরা মাস্টার মনে হয়েছিল আমার।

তারপর একদিন কনকনে শীতের ঠনঠনে রাতে দুরুদুরু বুক নিয়ে এগিয়ে গেলাম তোমার রুমের দিকে। যে করেই হোক আজ বলতেই হবে। দরজা খুলে যখন বেরিয়ে এলে তখন সাহসের হাওয়া সব উবে গেল। শুধু এতটুকুই জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলাম, ‘তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?’

এতদিনের এত পরিশ্রম, এত রিহার্সেল সব কুন্ডলী পাকিয়ে ফেললাম। আসল কথাটা বলতেই পারলাম না। তবে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম তোমার ‘না’ উত্তরটি। আশার প্রদীপ আবারও জ্বলে ওঠলো। এক শান্তির ঘুম ঘুমালাম সে রাতে।

বিপত্তি বাঁধলো পরদিন বিকেলে। খেলাধুলা করে যখন বাসায় ফিরলাম তখন আবিষ্কার করলাম, তুমি আর তোমার আম্মু আমাদের বাসায়। আত্মাটা ধপ করে ওঠলো। নিশ্চয়ই বিচার সালিশ টাইপ কিছু একটা হবে। ভয়ে কাচুমাচু অবস্থা আমার। দুরুদুরু বুকে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ওযু করে বের হলাম। মাগরিবের নামায শেষ করে এসে বসলাম পড়ার টেবিলে। তোমার আম্মু চলে গেছে, কিন্তু তোমার যাবার নাম নেই। আমার ছোট ভাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে তুমিও চলে গেলে। ভয়ের কাঁটা দূর হলো এবার।

সময় তার আপন গতিতে বয়ে যেতে লাগলো। আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হলো। কী বাজে এক রুটিনে পরীক্ষা হচ্ছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা। তাতে কী! প্রেমিকের মন কি আর ডরে পরীক্ষারে! পড়ালেখা সব শিকেয় তুলে লেগে গেলাম লাভ কার্ড বানাতে। ঘন্টাখানেকের ঘাম ছুটানো পরিশ্রমের পর কার্ড বানানো শেষ হলো। এবার প্রহর গুনছি। ভালোবাসা দিবসের প্রথম প্রহরেই প্রথম বারের মতো কাউকে প্রপোজ করতে যাচ্ছি।

রাত তখন বারোটা। সে রাতেও তুমি তোমাদের বাহিরের রুমটাতে ছিলে। দরজার নিচ দিয়ে কার্ডটা চালান করেই রুমে ফিরে আসলাম আমি। মনের ভেতর তুফান শুরু হয়ে গেছে। বুকের ধুকপুকানি গুণোত্তর ধারায় বেড়ে চলেছে। সকালে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না।

সকালে ঝড়-টড় কিছু হলো না। হলো সন্ধার পর। পরীক্ষা দিয়ে এসে ঘন্টা দুই ঘুমালাম। সন্ধার পর পড়তে বসলাম। ঠিক তখনি মুডি ভাব নিয়ে আসলে তুমি। এবার ‘গরুর রচনা’ পড়ার জন্য রচনা সম্ভার বই নিতে এসেছো। আম্মু শেলফ থেকে বই আনতে গেল। এই সুযোগে পেছন ফিরে তাকালাম আমি, তোমার দিকে। তুমি মার্বেলের মতো বড় বড় চোখ করে তাকালে, আমার দিকে। আমি ঐ চোখজোড়ার সমস্ত পাঠ পড়ে নিলাম। যা বুঝার বুঝে গেলাম। আমি খুন হলাম!

সদ্য প্রেমে পড়া এই আমার বাকি পরীক্ষাগুলো যেন একটু দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। বিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে আসছে। প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা শেষ হলো যেদিন সেদিন খুব হৈ-হুল্লোড় করেছিলাম বন্ধুরা মিলে। বাসায় এসেই মুড সুইং করলো। বড্ড মন খারাপের দল চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো আমায়। পরদিন গ্রামে চলে যাবো। আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা জানা নেই।

সবকিছু গোছগাছ শেষ। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। খবর এলো, তুমি কান্নাকাটি করছো। আম্মুর সাথে তোমার ভালো বন্ডিং ছিল। আম্মু গিয়ে স্নেহের হাত বুলালো তোমার মাথায়। কান্না কমেনি তবু। তোমার আম্মু তখন আমার কাছে এলেন। বললেন, ‘বাবা, তুমি যাও ওর কাছে। তুমি গেলে ওর কান্না থামবে।’

কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। তবুও অবুঝের মত তোমার রুমে গেলাম, তোমায় সান্ত্বনা দেবার জন্য। আমাকে দেখেই কান্না থেমে গেল তোমার। হয়তোবা লজ্জায়। বা কে জানে!

তিলোত্তমা! সেদিন তোমার ছলছল করা হরিণী চোখের ভাষাগুলো আমি ঠিকই পড়ে নিয়েছিলাম। আবেগ আর আকুতির মিশেলে ওরা যেন বলছিল,
‘দুটি চোখের তারায় থাকো, দুটি চোখের মণি মাঝে
চোখের আড়াল হলে তুমি, আমি আর বাঁচবো না যে!’

কিছুই করার ছিল না আমার। আমি যে তখন সদ্য গোঁফের রেখা গজানো কিশোর। আবেগের মারামারিতে ক্ষত-বিক্ষত তো আমিও হচ্ছিলাম। বুঝতে দেইনি তোমায়। তুমিই বলো, ছেলেদের চোখে কি পানি শোভা পায়?

গাড়িতে পুরোটা সময় জুড়েই মন পড়ে ছিল তোমার কাছে। স্মৃতির পাতা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম কল্পনায়। এভাবেই কি সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে যাবে? ভাবতেই মাথা ঝিনঝিন করে ওঠছে।

তিনটা মাস ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ালাম। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেলাম, বন্ধুদের সাথে ট্যুর দিলাম। মাঝখানে একবার শুধু তোমার সাথে কথা হয়েছিল ফোনে। তোমার আম্মুর নাম্বারে।

এসএসসির রেজাল্ট দিল। ঢাকার এক কলেজে ভর্তি হলাম। দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল। তোমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ হলো না। দেখতে দেখতে কলেজ লাইফও শেষ হয়ে গেল। ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সবুজ ক্যাম্পাসে রঙিন জীবন শুরু হলো। চারিদিকে প্রেমের জয়জয়কার। হাতছানি দিয়ে ডাকে বারেবার।

হঠাৎ একদিন অচেনা নাম্বার থেকে একটা ফোনকল আসলো। রিসিভ করলাম। কণ্ঠ শুনে দেড় মিনিট কোনো কথা বলতে পারিনি। ভিকারুননিসায় ভর্তি হয়েছো তুমি। সাইন্সে। দেখা করতে চাইলে। আমি সাথেসাথেই রাজি হয়ে গেলাম।

বেইলী রোডের পিজ্জা হাটে দেখা হলো আমাদের। তিন বছর পর। কথার শুরুটা তুমিই করলে। আমি তন্ময় হয়ে শুনছি। মাঝেমধ্যে শুধু ‘হ্যা, হুম’ বলে উত্তর দিলাম। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুনে যেতেই ভালো লাগছিল আমার। ঘোরের মাঝে আছি তখনও। হঠাৎ তোমার একটি প্রশ্নে ঘোর কাটলো, ‘এই! তোমার ফেইসবুক একাউন্টের স্পেলিং কী?’

রাতে লম্বা সময় চ্যাটিং হলো আমাদের। পুরোনো প্রেম আবারও জমে ওঠলো মেসেঞ্জারের টুং আওয়াজের তালে তালে। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যায়, কথা ফুরোয় না। বালিকা, আমাকে তোমার ভালোবাসায় সেভাবে বেঁধে ফেললে যেভাবে উটের রাখাল বেঁধে রাখে উটকে। আমি প্রেমাতাল হয়ে গেলাম।

পরের বার আমরা গেলাম ধানমন্ডি লেক পার্কে। পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ তোমার হাতে হাত রেখে বললাম,
‘এই হাতটি হাতে রেখে পায়ে পায়ে পথ চলতে
ধরণীতে আসার কারণ তোমায় ভালোবাসি বলতে’

আমাকে অবাক করে দিয়ে তুমিও সাথে সাথে বলে ওঠলে,
‘শুধু ভালোবাসা দিয়ে তুমি জীবন ভরে দিও
পর হলে হবে মরণ এমন আপন করে নিও’

আমাদের ভালোবাসা তখন ফর্মের তুঙ্গে। যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। জীবনের মোড় পাল্টে দেওয়া খবরটা তখনই এলো। দাদু স্ট্রোক করেছে। ইমার্জেন্সি হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ। বাঁচার সম্ভাবনা নাকি খুবই কম। পারলে রাতের ট্রেনেই বাড়ি যেতে বলেছে।

ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশা করে সোজা কমলাপুর। রাত তখন সাড়ে দশটা। অনেক চেষ্টা করেও সিট পেলাম না। স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলাম। এগারোটা পঞ্চাশে ট্রেন। আরো এক ঘন্টা ২০ মিনিট বাকি। বসে বসে তোমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম মেসেঞ্জারে। ভালো লাগছে না। টেনশন হচ্ছে খুব।

ফজরের পর পর ট্রেন থেকে নামলাম। এখন মোটরসাইকেলে আরও এক ঘন্টার রাস্তা। বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন সাতটা বাজে। বাড়ি ভরতি মানুষ। কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠলো। কেউ একজন এসে কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে দিতে ভেতরে নিয়ে গেল।

দাদু মারা গেছেন। হসপিটাল থেকে রাতেই লাশ নিয়ে এসেছিল। আমাকে জানায়নি। ভেঙে পড়বো বলেই হয়তো। দাফন কাফন শেষ করে এসে আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেলাম। পাশের বাড়ি থেকে দিয়ে গেছে। খাবার পর কিছুক্ষণ মরার মতো ঘুমালাম।

বাড়িতে মানুষ গমগম করছে। তবুও মনে হচ্ছে, কোথাও কেউ নেই। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই বয়স পর্যন্ত কত স্মৃতি দাদুর সাথে। মাঝেমধ্যে হেঁচকি ওঠা কান্নার দলের সাথে বোঝাপড়া করে করেই তিন চার দিন পার হয়ে গেল। ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মধ্যে নামায-কালাম ধরেছি। পাঁচ ওয়াক্ত।

ঢাকায় ফিরলাম। তোমার সাথে দেখা করলাম। ভালোবাসা মাখা কণ্ঠে সান্ত্বনা দিলে তুমি।

একদিন বেশ রাতে তোমার সাথে চ্যাট করছি। পাশাপাশি ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ একটা ভিডিও ক্লিপ আসলো সামনে। একটা কথা কানে আটকে গেল। ভরাট কণ্ঠে এক শাইখ বলছেন, ‘যুবক! দুনিয়ার এই মেয়ের রূপসৌন্দর্য্য উপভোগ করে তুমি জান্নাতের মেয়েকে পেতে চাও?’

প্রথম থেকে আবার শুনলাম। পুরোটা। জান্নাতি রূপসীদের নিয়ে কথাগুলো শুনে ভাবালু হয়ে গেলাম। গমগমে কণ্ঠে শাইখ বললেন, ওরা নাকি এমন মেয়ে যাদেরকে কোনো জিন বা মানুষ স্পর্শ করেনি, যেন ঝিনুকে লুকিয়ে রাখা মুক্তো। আল্লাহ ওদেরকে বানিয়েছেন বানানোর মতো করেই। ওদের শরীরে থাকবে না কোনো গন্ধ। ওরা সর্বদা রবে পুতপবিত্র। আহা! দ্বিতীয় বারের মতো প্রেমে পড়লাম আমি। এ প্রেম পবিত্র, এ প্রেম জান্নাতি।

মাথার ভেতর প্রতিটি নিউরনে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। কালবোশেখী ঝড়। চিন্তার জগৎ বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে আমার। দুটোর একটা বেছে নিতে হবে। কী করবো আমি এখন?

দাদুর মৃত্যুর পর আমার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। নামায-কালাম ধরেছি। মাঝেমধ্যে টুকটাক কুরআন তিলাওয়াতও করি। সম্ভবত মরণের ভয় ঢুকেছে মনে। তোমার সাথে প্রেম করাতে পাপ হচ্ছে—এ বোধটা কখনো জাগেনি। জানলে তো জাগবে। আজ জানলাম। তবুও ইউটিউবে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করলাম। জায়েজ টায়েজের কোনো ফতোয়া পাওয়া যায় কিনা দেখলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, কোনো আলেম-ই এটাকে জায়েজ বলেননি। সবার একটাই মত, বিয়ে বহির্ভূত প্রেম হারাম।

আমি ভাঙছি। ভাঙছে আমার ভেতরটা। রিপ্লাই না পেয়ে একের পর এক মেসেজ দিয়ে যাচ্ছ তুমি। অনেকক্ষণ পর সীন করলাম। কোনো মেসেজ না পড়েই লিখলাম, ‘কাল বিকেল সাড়ে চারটায় ধানমন্ডি লেকের ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দেখা হচ্ছে আমাদের।’ লিখেই ফোন অফ করে ফেললাম।

পরদিন ঠিক চারটা বেজে তিরিশ মিনিটে হাজির হলাম ধানমন্ডি লেকের ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। তুমি আগেই এসে বসে আছো। আমি ভালো আছি কিনা জানতে চাইলে। তোমার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আমি বললাম,
‘বালিকা! এই রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া গাছটা তোমার আমার প্রেমের অনেকগুলো প্রহরের সাক্ষী। আজ আমি চাই, এই গাছটা খুব ভালো একটা প্রহরের সাক্ষী হয়ে থাকুক।’

আমার কথার টুন শুনে ঘাবড়ে গেলে তুমি। জিজ্ঞেস করলে, ‘সেই ভালো প্রহরটা কী?’

আমি বললাম, ‘আজ এই বিকেল থেকে তোমার সাথে আমি আর কোনো ধরণের যোগাযোগ রাখছি না।’

‘সবসময় দুষ্টুমি করো না তো!’ বলে হেসে উড়িয়ে দিলে আমার কথা।

‘আমি কোনো দুষ্টুমি করছি না। যা বলছি, দিব্যজ্ঞানে সিরিয়াসলি বলছি।’

‘কী বলছো এসব? পাগল হয়ে গেছ তুমি?’ ধরা গলায় বললে তুমি।

‘না, পাগল হইনি। তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করা সম্ভব না। কারণ এটা হারাম।’

‘কিন্তু কেন? আমরা তো খারাপ কিছু করছি না।’

‘যেটুকু করেছি এটুকুই খারাপ। এটাও যিনা। আর জেনেশুনে যিনার গুনাহ কন্টিনিউ করা আমার দ্বারা সম্ভব না। ভালো থেকো। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’

আমি জানি, তোমার গাল বেয়ে নামছে অশ্রুর ঢল। সেটা দেখলে আমি নির্ঘাত টলে যাবো। একটিবারের জন্যও তাই পিছু ফিরে দেখলাম না তোমায়।

মাগরিবের নামায পড়ে রুমে আসলাম। মন ভারী হয়ে আছে। চোখের কোণে হানা দিল বেহায়া পানির দল। বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে আকাশ দেখছি। জোছনা রাত। ঝিনুকে লুকিয়ে রাখা মুক্তোর কথা মনে পড়লো। তাঁরা একবার পৃথিবীতে উঁকি দিলে পুরো পৃথিবী এমনভাবে আলোকিত হতো যে চাঁদ সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে যেত। তাঁদের একটিবারের উঁকিতে সুগন্ধে ভরে যেত সমগ্র পৃথিবী।

হে আমার হুর আল আঈন! আল্লাহ তোমাকে বানিয়েছেন বানানোর মতো করেই। তোমাকে রেখেছেন ঝিনুকে লুকিয়ে রাখা মুক্তোর মতো সুরক্ষিত। তুমি তো জানো, তোমার প্রেমে মাতোয়ারা হবো বলেই দুনিয়ার এক নশ্বর মেয়ের অধ্যায় চিরতরে মুছে ফেললাম আজ। আর তো কোনো কারণ ছিল না। তোমার এবং আমার রব জানেন, হরিণী চোখের ঐ বালিকাকে আমি ঠিক কতোটা ভালোবাসতাম। কিন্তু তোমাকে আপন করে পেতে চাই বলেই তাকে করে দিয়েছি পর।

হে জান্নাতি সুন্দরী, তোমার কাজল কালো ডাগর চোখের যাদুমাখা আহবান আমি কী করে উপেক্ষা করি! তোমার কপোলের ঘামে নাকি মুক্তো ঝরে। তোমার মিষ্টি লালার ছোঁয়ায় সাগরের নোনা জলও বনে যায় মিষ্ট জলধারায়। সেই তোমাকে আমি কী করে ভুলে যেতে পারি। কী করে আমি ক্ষণস্থায়ী হারাম সুখের অযুহাতে তোমাকে হারাতে পারি!

হে হুর আল-আঈন! তুমিও কি এখন মিস করছ আমায় যেমনটি আমি মিস করছি তোমায়? আমি যে তোমার প্রেমে বিভোর হয়ে আছি।

হে আমার জান্নাতি স্ত্রী!
আমি জানি, তুমিও আমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছো। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছো আমাকে পেয়ে এই গান গাইবে বলে,
‘প্রিয়তম! আমি শুধুই তোমার আর তুমি শুধুই আমার!’

হে ডাগরডাগর চোখওয়ালী জান্নাতি সুন্দরী!
তোমাকে বলি শোনো,
তোমার ঐ টুকটুকে লাল কপোলে
ধরা পড়বে আমার প্রেম কয়েদী মুখখানা
মুগ্ধপ্রেমে ডুবুডুবু উদাস মন গাইবে গান,
‘এই প্রথম একটি মুখ দেখে লাগলো এমন চেনা
যেন পূর্বের কোনো জন্মে ছিল প্রেমের পাওনা দেনা’

ওহে স্বর্গীয় অপ্সরী!
ওগো আমার হুরপরী!
তোমার আমার দেখা হবে খুব শিগগিরী!
খুব শিগগিরী!