না, মক্কায় আর থাকা সম্ভব না। ইকরিমা ইবনু আবী জাহল পালিয়ে যাচ্ছেন। ঘর-দুয়ার, স্ত্রী ছেড়ে। লজ্জিত অবস্থায় মাথা নিচু করে পালাচ্ছেন। মুসলিমরা মক্কা বিজয় করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ আগেই তিনি মুসলিমদের মক্কা বিজয় রুখতে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শেষ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছোট্ট সেনাবাহিনীর আক্রমণে সেই প্রতিরোধ ভেস্তে গেছে। ইকরিমার বাহিনীর অনেকেই মারা পড়েছে। কোনোমতে জান নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন ইকরিমা ইবনু আবী জাহল।
যদিও মক্কার কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আগেই কথা দিয়েছিল যে, তারা মক্কা বিজয়ে কোনো প্রতিরোধ গড়বে না, কিন্তু ইকরিমা ইবনু আবী জাহল কুরাইশদের কথার দাম রাখেননি। তিনি একটা শেষ সুযোগ নিয়েছেন মুসলিমদের আটকে দেওয়ার। কুরাইশদের হয়ে শেষ প্রতিরোধ গড়েছে্ন তিনি। কারণ তার গায়ে যার রক্ত বইছে, সেই মানুষটিকে বদরের যুদ্ধে হত্যা করে কুয়ায় ফেলে দিয়েছিল মুসলমান বাহিনী। হ্যাঁ, ইকরিমার গায়ে যার রক্ত বইছে সে হলো কুরাইশ নেতা আমর ইবনু হিশাম। যাকে কুরাইশরা এক সময় আবুল হাকাম (জ্ঞানীর পিতা) বলে ডাকত। এখন ডাকে আবু জাহল (মূর্খের পিতা) বলে। মুসলিমদের সব থেকে বড় শত্রু ছিল ইকরিমার বাবা আবু জাহল। নিজের বাবার নেতৃত্বেই ইকরিমা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে শত্রুতায় আত্মনিয়োগ করেছিল তখন। মুসলিমদের ব্যপারে ইকরিমা তার বাবার মতোই ছিলেন ভীষণ কঠোর। তার অত্যাচারে তৎকালীন মুসলিমদের জীবন হয়ে গিয়েছিল দুর্বিষহ। মুসলিমদের প্রতি ইকরিমার এই নিষ্ঠুরতা তার পিতা আবু জাহলকে বেশ আত্মতৃপ্তি দিত।
বদরের যুদ্ধেও ইকরিমা তার বাবা আবু জাহলের সাথে মুসলিমদের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আবু জাহলের ডান হাত। তাদের বাহিনী বদরের প্রান্তরে তিন দিন অবস্থান করেছিল। মদপান করেছে, উট জবাই করে খাওয়াদাওয়া, গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে নাচে মত্ত হয়ে কেটেছিল কুরাইশদের সময়। কুরাইশদের বাহিনী ভেবেছিল, অল্প কিছু মুসলিমকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে তারা। আবু জাহল তো তাদের দেবতা লাত ও উযযার নামে শপথ করেছিল যে, মুসলিমদের শেষ না করে সে মক্কায় ফিরবে না। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। সেই বদরের ময়দানেই লাঞ্ছিত পরাজয় বরণ করতে হয় কাফির কুরাইশদের। মুসলিম বাহিনীর দুই যুবক আবু জাহলকে হত্যা করে। আবু জাহল মুখ থুবড়ে পড়ে। ইকরিমা সেই দিন নিজের চোখেই দেখেছিলেন তার পিতাকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে।
সেই দিন ইকরিমা বাবার লাশটাকেও মক্কায় নিয়ে আসতে পারেননি। পালিয়ে আসতে হয়েছিল যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে। কাফির কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয় ইকরিমাকে তার বাবার লাশটাও দাফন করার সুযোগ দেয়নি। মুসলিমরা তার বাবার লাশ অন্যান্য কাফিরের লাশের সাথে কালীব নামক কূপে ফেলে মাটি চাপা দিয়েছে। আর সেই দিন থেকেই প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে শুরু করেছে ইকরিমার মনে। এবং তিনি হয়ে গেছেন মুসলিমদের অন্যতম শত্রু।
উহুদের যুদ্ধে ইকরিমা ছিলেন কুরাইশদের পক্ষ থেকে অগ্রগামী। ইকরিমার স্ত্রীও উহুদের যুদ্ধে তার সঙ্গী হয়েছিল। বদরের যুদ্ধে যে নারীরা ভাই হারিয়েছে, সন্তান কিংবা স্বামী হারিয়েছে, সেই সব নারীদেরকে সাথে নিয়ে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হানিও চলে এসেছিলে উহুদের ময়দানে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাদ্য বাজিয়ে কুরাইশ সৈন্যদের উৎসাহ দেওয়া।
উহুদের সেই দিন কুরাইশরা তাদের অশ্বারোহী সৈনিকদের ডান দিকে খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং বাম দিকে ইকরিমা ইবনু আবী জাহলকে নিয়োগ করেছিল। সেই দিন কাফিরদের এই দুই সাহসী যোদ্ধা মুসলিমদের কাছ থেকে উহুদের বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসে কুরাইশদের জন্যে। আবু সুফিয়ান সেই দিন গর্ব করে বলেছিল, 'এটা বদরের দিনের প্রতিশোধ।'
ইকরিমা তার জীবনে ইসলামকে কখনো ছাড় দিতে চাননি। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কীভাবে ধ্বংস করা যায়, সেই চেষ্টা তার মধ্যে ছিল সবসময়। খন্দকের যুদ্ধের সময় কুরাইশ বাহিনী মদীনা আক্রমণ করে। কিন্তু কাফিররা খন্দকের কারণে মদীনায় প্রবেশ করতে পারেনি। তারা বেশ কিছুদিন মদীনাকে অবুরুদ্ধ রাখল। তখন এক সময় ইকরিমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি খন্দক পার হয়ে মদীনার ভেতর প্রবেশ করার পথ খুঁজতে লাগলেন। একসময় দেখতে পেলেন খন্দকের এক স্থানে সংকীর্ণ একটা পথ। ইকরিমা সাহস করে সেই পথ দিয়ে তার ঘোড়া নিয়ে খন্দক পার হয়ে গেলেন। তার সাথে তাকে অনুসরণ করে খন্দক পার হলো আরও কিছু কাফির সৈনিক। কিন্তু তারা খুব বেশি সুবিধা করতে পারল না। তাদের আক্রমণ করে বসল মুসলিম সৈনিকেরা। তারা কোনোভাবে মুসলিম সৈনিকদের আক্রমণ থেকে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে পালাল। সেই সময় ইকরিমার একজন সঙ্গী আমর ইবনু আব্দি উদ্দ আল আমিরী প্রাণ হারাল মুসলিম সৈনিকদের হাতে। এভাবে নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরও ইকরিমা সবসময় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিরোধিতা করে গেছেন। এমনকি মুসলিমদের মক্কা বিজয়ের আগ মুহূর্তেও তিনিই শেষ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছেন।
এখন তিনি ব্যর্থ। সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন মক্কা ছেড়ে। মুসলিমরা মক্কা বিজয় করে নিয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পক্ষ থেকে মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে ইকরিমা ইবনু আবী জাহল এই সাধারণ ক্ষমার অন্তুর্ভুক্ত নয়। মোট ছয়জনকে এই সাধারণ ক্ষমার অন্তুর্ভুক্ত করা হয়নি। এরা হলো ইকরিমা ইবনু আবী জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী সারাহ, মাকিস ইবনু সুবাবা, আব্দুল্লাহ ইবনু খাতান এবং দুইজন দাসী। এদের অন্যায় হলো, এরা মুসলিমদের বিপক্ষে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করার পাশাপাশি প্রকাশ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে গালমন্দ করত। মুসলিমদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ছয়জন ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হবে না। এরা যদি কাবার গিলাফ ধরেও নিরাপত্তা চায়, তবুও এদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে না। বরং যেখানেই পাওয়া যাবে হত্যা করা হবে।
সুতরাং যেচে পড়ে নিজেকে মুসলিমদের হাতে সঁপে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ইকরিমা ইবনু আনী জাহল তাই জাহাজে করে লোহিত সাগরের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। গন্তব্য আবিসিনিয়া। জাহাজে ওঠার পর সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। এখন আর কিছুই ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে না। ভয়াবহ ঝড় শুরু হয়েছে। ঢেউয়ের বাড়িতে ভয়াবহভাবে দুলছে জাহাজ। যেকোনো সময় ডুবে যাওয়ার উপক্রম। জাহাজের সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে আরোহীদেরকে লাত, উযযা কিংবা অন্য কোনো উপাস্যকে বাদ দিয়ে কেবল আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি আরোহীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
“হে মানুষেরা, প্রার্থনা করো। তোমাদের রব আল্লাহর কাছে মন থেকে অকপটে প্রার্থনা করো। কারণ এই পরিস্থিতি থেকে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তোমাদের বাঁচাতে পারবে না।”
জাহাজের ক্যাপ্টেন তার আরোহীদেরকে যা বলেছেন সেটা হলো- আল্লাহই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সবাইকে রক্ষা করতে পারে। অন্য কোনো মূর্তি কিংবা দেবতা তাদেরকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে পারবে না। সুতরাং সবাই যেন অন্যান্য দেবতাদের উপাসনা বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।
ইকরিমা ইবনু আবী জাহল যখন জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে এই কথা শুনলেন, তিনি বললেন, “ওয়াল্লাহি! যদি আমার দেবদেবী মূর্তি আমাকে সমুদ্রে এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে জমিনেও আমাকে সাহায্য করার সামর্থ এদের নেই।”
এরপর ইকরিমা আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! আমি শপথ করছি, যদি আমি এই পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফিরতে পারি, তাহলে আমি ফিরে যাব এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত দেবো। আমি তাঁকে বিনয়ী এবং ক্ষমাশীল হিসেবেই পাব।”
ইকরিমা ইবনু আবী জাহল দুআ করলেন একমাত্র আল্লাহর কাছে। ইখলাসের সাথে দুআ করলেন। দুআ কবুলের ইখতিয়ার আল্লাহর। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ইখলাস মিশ্রিত দুআ কখনো ফিরিয়ে দেন না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ…)