২০১৬ সালে যখন আমার দাদা মারা গেলেন তখন আমি বাড়িতেই ছিলাম। তবে মারা যাওয়ার সময় পাশে ছিলাম না। সেদিন আসরের সালাতের পর শয্যাশায়ী দাদার পাশে বসেই সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করেছিলাম। এরপর আমরা ছেলেরা সবাই ক্রিকেট খেলতে চলে যাই। আম্মা খেলতে যেতে বারবার মানা করছিল সেদিন। দাদার পাশেই থাকতে বলেছিল। মানিনি।

মাঠে গিয়ে বাটাবাটি করে মাত্রই প্রথম ইনিংস শুরু হলো, তখনই বাড়ি থেকে ফোন আসলো। সবাইকে বাড়ি যেতে বলেছে। আগপিছ না ভেবে ভোঁ দৌড় দিলাম সবাই। হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল। দৌড়ের কারণে না।

পুকুরপাড় পর্যন্ত গিয়েই ঘটনা বুঝা শেষ। বাড়ির ভেতরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। চাচাতো বোনটা তো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে পুকুরপাড়ে চলে এলো, আমাদেরকে খবরটা জানাতে। ‘ভাইয়া! দাদাভাই মইরা গেসেগা!’

আমার পরিচিতদের অনেকেই জানেন, আমার দ্বীনের পথে আসার প্রধান মোটিভ ছিল দাদার মৃত্যু। ফ্যামিলি থেকে প্রথম কেউ মারা গিয়েছিল। বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিলাম।

পরের বছর কুরবানির ঈদের আগে আগে দাদিও মারা গেলেন। তখন অবশ্য ময়মনসিংহে মেসে ছিলাম। তখনও কাছ থেকে দেখতে পারিনি।

গত মাসে নানা মারা গেলেন। ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শেষদিন অবস্থা নাজুক হওয়ায় আইসিইউ-তে শিফট করা হয়। রাত সাড়ে নয়টার দিকে আইসিইউ-তে নেওয়া হয়েছিল। রাত যত বাড়ছিল পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হচ্ছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, আজ রাতে এখানে মালাকুল মাউত আসবেন।

ভেন্টিলেটরে পালস রেইট এবং ব্লাড প্রেশারের আপ-ডাউন সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছিলাম আমি। পালস ৭০-৮০-৯০ এর মধ্যে আপ-ডাউন করছিল। রাত দুইটার দিকে হঠাৎ করেই পালস নেমে এলো তিরিশের ঘরে। সিকিউরিটি গার্ডের মত এলার্ট হয়ে গেলাম। ছোটমামা ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসলো। ডাক্তারের কথামত নার্সরা তড়িঘড়ি করে ইসিজি করলো। লাভ হলো না। সাদা কাগজ বের হলো। ডাক্তার দৌড়ে গিয়ে নার্ভ চেক করলো, চোখের পাতা উল্টে দেখলো। তারপর আমার কাছে এসে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলো—

‘ইনি কি হন আপনার?’

‘নানা।’

‘আপনার নানা মারা গেছে।’

কোন রা নেই আমার মুখে। নির্বাক দাড়িয়ে রইলাম। তবে ছোটমামার মত কিংকর্তব্যবিমুঢ়ও হয়ে যাইনি। আমি ভাবছি। ভাবছি, এইমাত্রই মালাকুল মাউত এসেছিলেন এখানে। একটি রুহ নিয়ে চলে গেলেন। এবার কাছ থেকে কাউকে নিয়ে যেতে দেখলাম।

মালাকুল মাউত তো চলে গেলেন। কিন্তু আমি জানি, তিনি আবার আসবেন। সেদিন আমি তাঁকে দেখতে পাবো। কারণ, তিনি তো আমাকেই নিতে আসবেন।

আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুসনাল খাতিমা।