ছোটবেলা থেকেই বিদেশী মুভি দেখা বা বই পড়ার কারণে বিদেশ (স্পেশালি নর্থ আমেরিকা, ইউরোপ) এবং বিদেশের জীবন নিয়ে একটা ফ্যাসিনেশন থাকে সবার। ওয়েল, সবার থাকে কিনা বলতে পারি না, অন্তত আমার ছিল। ওখানকার মানুষদের প্রতি মৃদু ইর্ষাও হতো যে, তারা ছোটবেলা থেকেই কী চমৎকার পরিবেশে, সুন্দর জায়গায় বড় হচ্ছে, থাকছে। মনে হতো কোনোমতে ওরকম একটা দেশে যেতে পারলেই কেল্লাফতে। যতই সময় যাচ্ছে, আমি আল্লাহর প্রতি ততই কৃতজ্ঞ হচ্ছি যে, উনি আমাকে চমৎকার একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়ার সৌভাগ্য দিয়েছেন। দিয়েছেন পরিবারের প্রতি সম্পূর্ণ নিবেদিত একজন মা এবং স্ত্রী-সন্তানদের সযত্নে আগলে রাখা একজন বাবা।

কানাডায় আমার প্রবাসের প্রায় এক বছর পার হতে চলল।[1] এই এক বছরে এখানকার মানুষদের প্রতি আমার সেই ফ্যাসিনেশনটি করুণায় পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা আর অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজরের মানসিক যাঁতাকল নিয়ে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের কষ্টের কথা দেশের অনেকেই মোটামুটি শুনেন/জানেন বলে সেটা নিয়ে এখানে কথা বলব না। তারচেয়ে বরং চেষ্টা করব একটু ব্যাখ্যা করার, কেন এখানের মানুষগুলো আমার চোখে ফ্যাসিনেশন থেকে করুণার পাত্রে পরিণত হলো। তবে প্রথমেই বলে নিই যে, এদের একদম সবকিছুই খারাপ না, কিছু কিছু জিনিস আমার ভালো লাগে। ওগুলোও বলব।

যেহেতু এটা “উন্নত বিশ্ব”, তাই এখানে ট্রান্সজেন্ডার[2], সমকামী এবং হাজারো সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের মানুষের সংখ্যা অসামান্য। রাস্তাঘাটে অহরহ এরকম কাপল ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বছরে একবার ঘটা করে সমকামী প্রাইডের র‍্যালি হয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে দেখা যায় এসব সমকামীদের র‍্যালিতে গিয়ে নাচানাচি করতে।[3]

কানাডা হলো বিশ্বের চতুর্থতম দেশ, যারা সমাজ ও সভ্যতাবিদ্ধংসী, হারাম, বিকৃত সমকামী বিয়েকে বৈধ্যতা দিয়েছে। আমেরিকারও অনেক আগে। সমকামী বিয়ের বৈধতা দানকারী প্রথম তিনটি দেশ হলো যথাক্রমে নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং স্পেন।[4][5]

এখানের মানুষ খুবই আত্মকেন্দ্রিক এবং ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক। ছেলেমেয়ে আঠারো-বিশ বছর বয়স হলেই বাবা-মা আশা করে, ছেলেমেয়েরা আলাদা হয়ে যাবে তাদের থেকে। সারাজীবন আত্মকেন্দ্রিক থাকার কারণে বুড়ো বয়সে গিয়ে দেখা যায় এরা একদম একা হয়ে গিয়েছে। হয় বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দিন কাটাতে হয়, অথবা নিজের বাড়িতেই প্রায় নিঃসঙ্গভাবে শেষ দিনগুলো পার করতে হয়। নিঃসন্তান এক বৃদ্ধাকে চিনি, যার বাবা-মা, স্বামী কেউ বেঁচে নেই, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। তার দিন কাটে একলা অ্যাপার্টমেন্টে। তার নিঃসঙ্গতার কথা চিন্তা করলে দম আটকে আসে আমার।

মুভিতে দেখা যায় ওদের তরুণ-তরুণীরা কত সুখে আছে। গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কত মজা করছে। বাবা-মায়ের কোনো শাসন নেই। কোনো কিছু নেই। কিন্তু…

প্রতি তিনজন কানাডিয়ানদের একজন ভয়াবহ মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা ভয়াবহ। ছোট্ট বয়সটাতেই হতাশা, অবসাদ, ক্লেদ জাঁকিয়ে বসেছে এমন কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। প্রতি পাঁচজনের একজন মনোযাতনায় ভুগছে। এদের সামনে লম্বা একটা সময় পড়ে আছে, জীবন তো শুরুই হয়নি; কিন্তু এরই মধ্যে তাদের পৃথিবী এতটাই সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে যে, অনেকে আত্মহত্যা করে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। এই বয়সের কানাডিয়ানদের মৃত্যুবরণের দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ হলো আত্মহত্যা।

ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ Dr. Jean Clinton সতর্কসঙ্কেত জানিয়ে বলেছেন, ‘তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মানসিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। অবশ্যই বলতে হবে, আমাদের সমাজ এক মহাসঙ্কটের ভেতর পড়েছে।’[6][7][8]

যেহেতু ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই, তাই এদের কাছে প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞাও ভিন্ন। সম্ভাব্য পার্টনারের সাথে প্রথমেই শারীরিক সম্পর্ক করে, তারপর চিন্তা করে দেখে ভালোবাসা যাবে কিনা, সম্পর্ক চালালে ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে কিনা। ক্যারিয়ার এবং স্বার্থ প্রাধান্য পায় বলে সম্পর্কগুলোও হয় ঠুনকো, ভাংতে সময় লাগে না।

রিসার্চের কাজে আমাকে কয়েক জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। এক জায়গার অভিজ্ঞতা বলি। ওখানে আমার সাথে আরও ৩-৪ জন ছেলে কাজ করত। আমি ওখানে নতুন, আর ঐ ছেলেগুলোকে বেশ ফ্রেন্ডলি মনে হতো বলে ভাবতাম, এদের সাথে ভাব জমাতে পারলে ভালোই হবে। কাজের ফাঁকে ওরা গল্প করত নিজেরা নিজেরা। একদিন শুনি যে, একজন আরেকজনকে এক মেয়ের ব্যাপারে বলছে। মেয়েটার নাম মনে নাই, ধরে নিই লুসি। তো শুনলাম ছেলেটা বলছে, “আরে আমি লুসিকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারছি না যে ও আমার গার্লফ্রেন্ড না। ও মনে করছে আমরা কাপল। অথচ আমরা কাপল না! মাত্র দুইবার একসাথে রাত কাটিয়েছি আমরা! আর ও কিনা মনে করছে আমি ওর বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেছি।”

বলা বাহুল্য, ছেলেটার ভাষা এতটা ভদ্র ছিল না। এই আলাপ শোনার পর ঐ ছেলেগুলোর সাথে আমার খাতির জমানোর শখ ঐ মুহূর্তেই উবে গেছে।

মানুষ সব সময় একটা গোল বা লক্ষ্য মাথায় রেখে আগাতে থাকে। তুমি যখন স্কুলে পড়ছ, তখন তোমার লক্ষ্য থাকে যে সামনের পরীক্ষাতে ভালো করা, এবং সামনের পরীক্ষাগুলোতে ভালো করলে ভালো একটা কলেজে চান্স পাবে। একইভাবে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, চাকরি, প্রমোশন, বিয়ে, সন্তান, আরও প্রমোশন। কিন্তু তারপর? আল্টিমেট গোল বা চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? 

আস্তিক আর নাস্তিকের মধ্যে তফাৎটা এখানেই। আস্তিকের পরকালে বিশ্বাস আছে বলে তার অন্য সব লক্ষ্য অর্জন হলেও পরকালের লক্ষ্যটি মাথায় থাকে ঠিকই। কিন্তু নাস্তিক হওয়ার সাইড-ইফেক্টগুলোর একটি হলো, কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্য না থাকা। চাকরি, প্রমোশন ইত্যাদি চলতে চলতে জীবনকে এক পর্যায়ে স্থির মনে হতে থাকে। লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ে মানুষ তখন ভালো থাকতে পারে না। যেহেতু “আধুনিক” মানুষ মাত্রই নাস্তিক বা সেকুল্যার, তাই এদিকের মানুষের হতাশা, মানসিক সমস্যা অত্যন্ত বেশি। আর এই ডিপ্রেশন চরমে পৌঁছে গেলে আত্মহত্যাও করে ফেলে।

আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে এরা খুবই বিচ্ছিন্ন থাকে একে অপরের থেকে। এর খারাপ দিক আছে, ভালো দিকও আছে। খারাপ দিক হলো, এর ফলে ওরা কেমন জানি যান্ত্রিক হয়ে পড়ে এবং নানাবিধ মানসিক সমস্যায় বেশি ভুগে। ভালো দিক হলো, কেউ কারও বিষয়ে নাক গলায় না। মানুষে কে কী ভাবল, তা নিয়েও বেশি চিন্তা করে না।

এখানের মানুষদের আরও কিছু ভালো দিক হলো, তারা সাধারণত বেশ হেল্পফুল। সাহায্য চাইলে যথাসাধ্য সাহায্য করবে, আচার-ব্যবহারে খুবই অমায়িক (বেশির ভাগ সময়েই)। রেসিজম যে একেবারে নাই, তা না; সামান্য পরিমাণে হলেও আছে। কথাবার্তা বললে সোজা-সাপ্টা কথাই বলে। আমি এখানে আসার পর একজন কানাডিয়ানের সাথে কথা বলতে গেলে যতটা সতর্ক থাকি, তারচেয়ে হাজারগুণে বেশি সতর্ক থাকি কোনো বাংলাদেশীর সাথে কথা বলতে গেলে। ব্যাপারটা দুঃখজনক হলেও সত্যি।

এখানের ট্রান্সজেন্ডার, সমকামীদের অভয়ারণ্য, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিমবিদ্বেষ দেখে গা জ্বালা করে। লক্ষ্যহীন আত্মকেন্দ্রিক নিঃসঙ্গ মানুষগুলোকে দেখে করুণা হয়। বাংলাদেশ অন্য সব দিক দিয়ে একদম পঁচে গেলেও পারিবারিক বন্ধন আর মানসিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে এসব “উন্নত বিশ্বের” চেয়ে ঢের এগিয়ে।

এখানে অনেক কিছু দেখে-শুনে আরও একটা উপলব্ধি হয়েছে। মুসলিম ঘরে জন্মে, মুসলিম হয়ে থাকতে পারাও আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নিয়ামত। 

“অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের আর কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?” [সূরা আর রহমান, আয়াত নং- ১৩]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

[ষোলো ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত]


[1] লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় লস্ট মডেস্টি ব্লগে। ২০১৮ সালে। লেখক এখানে সে সময়ের কথা বলছেন।

[2] Transgender এবং হিজড়া কিন্তু এক জিনিস নয়। হিজড়া মানে তো বুঝতেই পারছ। ট্রান্সজেন্ডাররা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু একজন পুরুষ নিজেকে নারী দাবি করে এবং নারী নিজেকে পুরুষ দাবি করে। এবং তার চায় সমাজ, রাষ্ট্র তাদের এই হাস্যকর দাবি মেনে নিক।

[3] https://www.theguardian.com/world/video/2016/jul/04/canadas-pm-justin-trudeau-dances-at-gay-pride-in-toronto-video

[4] Same-Sex Marriage in Canada - https://tinyurl.com/y9nr336q

[5] TIMELINE | Same-sex rights in Canada - https://tinyurl.com/yaxq5rwt

[6] Young Minds: Stress, anxiety plaguing Canadian youth - https://tinyurl.com/ycps7wur

[7] Why more Canadian millennials than ever are at ‘high risk’ of mental health issues - https://is.gd/CQSnLq

[8] One-third of Canadians at ‘high risk’ for mental health concerns: poll - https://is.gd/5GchVD