গ্রামের রাস্তা। একটি গ্রীষ্মের দুপুর।
ক্লাস ফোর পড়ুয়া সাইফ স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছে। প্রচণ্ড রোদে ঘামছে সে। কপাল দুটো কুঁচকে আছে তার। গরমে, বিরক্তিতে।
কতকিছুই মনে আসছে তার। এই গরমে রাস্তায় প্রচণ্ড রোদ, অনেকদূর হেঁটে বাড়ি যেতে হবে, গাড়ি করে যাবার পয়সা নেই; কখনোই থাকে না। বাড়িতে গিয়েও আরাম নেই। অজপাড়াগাঁয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। পৌঁছালেও ওদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আনার সামর্থ্য ওর পরিবারের নেই। তালপাখার হাওয়া খেয়ে শরীর ঠান্ডা করতে হয়। এখন গিয়ে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে পারলে তবেই একটুখানি শান্তি।
এই রোদে এদ্দূর হেঁটে বাড়ি যেতে হবে, একটা ছাতা থাকলেও তো হতো। ভাবতে গিয়ে নিজেরই কেমন হাসি পায় সাইফের। ছাতা কেনার চিন্তাটা বিলাসিতা ওদের কাছে। বাবার আদ্দিকালের ছাতাটা ফুটো হয়ে গেছে, ওটা দিয়ে কোনোরকমে বরষা যায়। ঝুম বৃষ্টি না হলে সেটা নামানো হয় না। টুপটাপ বৃষ্টিতে কচুপাতা মাথায় দিয়েই সাইফরা চার ভাইবোনের কাজ হয়ে যায়। মুষলধারে বৃষ্টিতে বাড়ি থেকে বের হতেই দেওয়া হয় না। বাড়িতে বসে থাকো, নয় ছেঁড়া কাঁথা গায়ে ঘুমাও। বাড়ির টিনের চালের ফুটোগুলো তালি দেওয়া হয় কোনোমতে। তারপরও ঘরের ভেতর ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে প্রায়ই।
হঠাৎই পেছন থেকে ভরাট গলায় নিজের নামটা শুনতে পেল সাইফ। পেছনে তাকিয়ে বাবাকে দেখতে পেল সে। কাঁচাপাকা চুল-দাড়ির মধ্যবয়সী মানুষটা, সংসারের জন্য গাধার খাটুনি খাটেন। ওদের দু’ভাইবোনের পড়াশোনা, ছোট কোলের ভাইটির নানান রকম প্রয়োজন, সংসারের অন্যান্য খরচ। বড় বোনের বিয়েতে প্রচুর খরচ হয়েছে, মেজো আপুর বিয়েতেও আরও খরচ হবে। এসব কারণে বাবার সাথে খুব কমই দেখা হয় ওর। মানুষটাকে তাই অদ্ভুত রকমের ভয় পায় সাইফ।
‘ক্লাস কেমন হলো?’
‘ভালো।’
‘কপাল কুঁচকে রেখেছ কেন?’
‘রোদ লাগছে।’
কেমন কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিল সাইফ।
মধ্যবয়সী মানুষটা একটু কাষ্ঠ হাসলেন। তার হাসির মধ্যে লুকিয়ে রইল হাজারটা দুঃখ।
‘তুমি আমার ডানপাশে সরে এসে হাঁটো। হ্যাঁ, এইবার হয়েছে। এখন রোদ লাগছে?’
এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল সাইফ। তার ছোট্ট ছায়া আরেকটা দীর্ঘকায় ছায়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। বাবার শরীর তাকে আড়াল করে রেখেছে তীব্র রোদ থেকে। একপাশে বাবা এবং আরেকপাশে বাবার ছায়া। সাইফের মনে হলো তার দু’পাশেই বাবা আছে, তাকে ঘিরে রেখেছে, আড়াল করে রেখেছে। কী অদ্ভুত!
***
১০ বছর পর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আরেকটি গ্রীষ্মের দুপুর।
একটি ফোনকল পেয়ে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে সাইফ। মায়ের ফোন। সংবাদ- পিতার মৃত্যু। যে বাবার ছায়া আজীবন তার মাথার ওপর ছাতার মতো ছড়িয়ে ছিল, রক্ষা করছিল সব দুঃখ-কষ্ট থেকে; সেই বাবা আজ চলে গেলেন। সাইফ বাড়ি যেতে পারবে না। সেমিস্টার ফাইনাল এখন। কেন যেন মনে হচ্ছে, যে বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমে সে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, সে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আজ বাবার জানাযায় উপস্থিত হতে দেবে না।
অনেকটা উদ্দেশ্যহীন হাঁটা শুরু করল সাইফ৷ তার কল্পনায় নিজের একপাশে আরেকটা বড় ছায়া এসে ঢেকে দিল তাকে রোদ থেকে। একপাশে বাবা এবং আরেকপাশে বাবার ছায়া। তীব্র রোদের মধ্যে এই মিথ্যা কল্পনা করে নিজের অজান্তেই কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠল সে।
***
আরও ১০ বছর পর।
গ্রামের রাস্তা। আরেকটি গ্রীষ্মের দুপুর।
নুসায়ের উদ্দেশ্যহীনভাবে রোদের মধ্যে হাঁটছে। সে শহরের স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।
এসেই বিরক্তি বোধ শুরু করেছে সে। গ্রামে টিভি নেই যে, দেখে সময় কাটাবে। গরমে অতিষ্ঠ অবস্থা। বাসায় এসি রুমেও ওর গরম লাগে, আর গ্রামের সিলিং ফ্যানের কথা বলে লাভ নেই, কচ্ছপের গতি। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। শহরে সে বাসা থেকে কমই বের হয়। আজ গ্রামে এসে রাস্তায় নেমে আবার মেজাজ গরম হয়ে গেল। এত রোদে মানুষ থাকে কীভাবে! বোকামি করে ফেলেছে, ঘরের দাওয়ায় লটকানো ছাতাটা হাতে নিয়ে বেরুনো উচিত ছিল। যাকগে!
গ্রামের রাস্তা ঠিকঠাক চেনে না, তারপরও হেঁটে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চলে আসলো নুসায়ের। মসজিদ পেরিয়ে একটু দূরে পথের একপাশে দেয়ালঘেরা একটা খোলা জায়গা চোখে পড়ল ওর। গেটের ওপর লেখা—কবরস্থান।
খোলা গেট দিয়ে ভেতরে তাকালো নুসায়ের। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কবরস্থান, এখানে তাহলে মানুষ মারা গেলে কবর দেওয়া হয়। এই গ্রামের যত মানুষ মারা যায় সবার কবর তাহলে এখানে, ভাবল সে। তার দাদা-দাদীর কবরও কি এখানে?
ভাবতে ভাবতে কবরগুলোর দিকে তাকালো সে। সব একরকম, আলাদা করে চেনার উপায় নেই। বাবা প্রতিদিন কবর জিয়ারত করে, দাদা-দাদীর কবর নিশ্চয়ই চেনে। ওরা নুসায়েরের জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন, সে কখনো দেখেনি ওদেরকে। এখন কেন যেন ওদের শেষ আবাসস্থল দেখতে ইচ্ছা হলো নুসায়েরের।
প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চারপাশে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ মাথাব্যথা শুরু হলো নুসায়েরের। মনে হলো, চোখে অন্ধকার দেখছে। দু’হাতে চোখ ঢেকে রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে হলো তার পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।
চোখ খুলে আর মাথায় ব্যথা অনুভব করল না ও। পাশে দাঁড়ানো মানুষটার ছায়া তাকে ঢেকে দিয়েছে। আড়াল করে দিয়েছে সূর্য থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকালো সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই গম্ভীর মানুষটিকে সে ভীষণ ভয় পায়।
‘দাদা-দাদীর কবর দেখতে এসেছ?’
‘হ্যাঁ, তুমি চেনো কোনগুলো?’
ইশারা করে পাশাপাশি দু’টো কবর দেখালেন প্রফেসর সাইফ।
‘ওদের দাফনের সময় তুমি ছিলে?’
‘তোমার দাদীমার কবরে নিজহাতে মাটি দিয়েছি। কিন্তু তোমার দাদাভাই যখন মারা গেলেন, আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরীক্ষার জন্য গ্রামে আসতে পারিনি। এখনো কষ্ট হয়, যে মানুষটা এত কষ্ট করে বড় করলেন আমাকে, তার চলে যাবার দিন আমি উপস্থিত থাকতে পারলাম না।’
সদাগম্ভীর মানুষটির চোখে পানি দেখে আশ্চর্য হলো নুসায়ের।
‘তুমি বাড়ি থেকে একা একা বের হয়ে গেলে কেন?’
হঠাৎই প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন নুসায়েরের বাবা।
‘গরম লাগছিল…।’
কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিল নুসায়ের।
‘ঘরে গরম লাগছিল! রাস্তায় বুঝি রোদ নেই?’
‘ছিল.. মানে আছে। কিন্তু এখন লাগছে না। তুমি যে পাশে এসে দাঁড়ালে…।’
ছেলের দিকে আনমনে তাকিয়ে নিজের অতীতে চলে গেলেন প্রফেসর। তখন তিনি ছোট্ট, নুসায়েরের মতো ক্লাস ফোরে পড়েন। স্কুল থেকে ফেরার পথে একপাশে বাবা, আরেকপাশে বাবার ছায়া নিয়ে হাঁটছেন।
‘তোমার দাদাভাই’, আর্দ্র কণ্ঠে ছেলেকে বলতে লাগলেন সাইফ। ‘আমি যখন তোমার মতো ছোট্ট ছিলাম, তখন এভাবে নিজের শরীর দিয়ে আমাকে আড়াল করে রাখতেন রোদ থেকে।’
‘শুধু রোদ না, জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন আমাকে, তোমার চাচা-ফুপিদেরকে। আমাদের তখন ছাতা ছিল না, তোমার দাদাভাই-ই ছিলেন আমাদের ছাতা। আমরা যখন তালপাখার হাওয়া খেয়ে আরাম করতাম, উনি তখন রোদের মধ্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করেছেন আমাদের আরামের জন্য। তোমার দাদাভাই বাবা হিসেবে যা করেছেন আমাদের জন্য, তোমাদের জন্য তার হাজার ভাগের এক ভাগও করতে পারিনি আমি, নুসায়ের।’
বাবার বাষ্পরূদ্ধ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নুসায়েরের মনে হলো, মানুষটাকে সে ভীষণ ভয় পায় না, বরং অনেক ভালবাসে।
বাবারা এমনই, ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকেন মাথার ওপর। সন্তানদেরকে আড়াল করে রাখেন রোদ-ঝড় থেকে। দেন না কোনো দুঃখ-কষ্ট সন্তানদের স্পর্শ করতে।
وَ اخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَۃِ وَ قُل رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا
‘আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা বিছিয়ে দাও এবং বলো, “হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।”’ (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত- ২৪)
[ষোলো ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত]