ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলাম। এরপর কী যে হলো, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। একের-পর-এক রেজাল্ট খারাপ হতে থাকল। ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষায় তিনটা সাবজেক্টে ফেইলই করে বসলাম। বাবা বলল আমাকে অটো কিনে দেবে... আর পড়াশোনা করাবে না। মা আমার পিঠে ঝাড়ু ভাঙ্গার আর পাশের বাড়ির মেহেদীর পা ধোয়া পানি খাওয়ানোর ইচ্ছা পোষণ করল। এ সময় আমার জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে হাজির হলো ফুপাতো ভাই হাসান। আমাকে বেশ কিছু টিপস দিল সে। সেই টিপস ফলো করে এর পরের পরীক্ষাগুলোতে একের-পর-এক ছক্কা হাঁকাতে থাকলাম আমি। সেই টিপসগুলোই তোমাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে শেয়ার করছি আমি। গত পর্ব না পড়ে থাকলে পড়ে নাও এখান থেকে। 

স্মার্ট স্টুডেন্টের মতো পড়ার সময় বাড়াবে যেভাবে—

দেখো, আমরা যেটা ভাবি যে, আগামীকাল থেকে একদম কুত্তা পড়া পড়ব। ৮ ঘণ্টা/১০ ঘণ্টা... একদম ফাটিয়ে ফেলব। কিন্তু যেটা হয় ২/৩ ঘণ্টাও পড়তে পারি না। ফলে মনের মধ্যে একটা খারাপ লাগা কাজ করে। হতাশা কাজ করে। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় মনে হয় আমি একটা পরাজিত মানুষ, আমি একটা অপরাধী, আমার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ধুর, আমাকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না। বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারব না। বাদ দিই... এরচেয়ে কিছুক্ষণ গেইম খেলি বা টিকটক দেখি...

এই যে এমন পরাজিত মানসিকতা, এটা তোমাদের ব্যর্থ হবার অন্যতম প্রধান কারণ। আর এই ব্যর্থতাটার সূচনা হবার কারণ তুমি পড়াশোনার এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছ যা আসলে করতে পারবা না। তুমি যদি আজকে এক ঘণ্টাও মনোযোগ দিয়ে পড়তে না পারো, তাহলে কীভাবে আগামীকাল ৮/১০ ঘণ্টা পড়তে পারবা? একটা শিশু কি একদিনে হাঁটা শেখে? তুমি একদিনে সাইকেল চালানো শিখেছ? একদিনে কথা বলা শিখেছ? না। ধীরে ধীরে শিখেছ। সময় নিয়ে। কাজেই এমন ৮/১০ ঘণ্টা পড়ার অবাস্তব লক্ষ্য ঠিক কোরো না। এমন লক্ষ্য ঠিক করো, যা তুমি পূরণ করতে পারবে।

যেমন- তুমি যদি এখন দিনে ১ ঘণ্টা পড়ো, তাহলে ঠিক করো যে, আগামীকাল ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পড়বে।

২ ঘণ্টা পড়লে ভাবো, আগামীকাল থেকে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পড়বে।

এভাবে এক দুই সপ্তাহ পড়ো। এটাতে অভ্যস্থ হয়ে গেলে আবার সময় বাড়াও। দৈনিক ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পড়লে এখন থেকে ৩ ঘণ্টা পড়বে। এভাবে কিছুদিন পড়ো। এরপর আবার সময় বাড়াও। বুঝেছ পদ্ধতিটা?

এভাবে অল্প অল্প করে সময় বাড়ালে তোমার উপর চাপ পড়বে না। তুমি যে লক্ষ্য নির্ধারণ করছ, সেটা পূরণ করতে পারছ। ফলে তোমার মধ্যে ভালোলাগা কাজ করবে। আত্মবিশ্বাস কাজ করবে। গায়ে একটা হিট আসবে। দেখবা, পড়তে সেই ভালো লাগছে।

স্মার্ট স্টুডেন্টের মতো সময় নষ্ট করা বন্ধ করবে যেভাবে—

আমার একটা কমন সমস্যা ছিল, সময় যে কীভাবে চলে যেত, দিন যে কীভাবে পার হতো তাই বুঝতাম না। চোখের পলকে দিন পার হয়ে যেত। মনে হতো ২ ঘণ্টায় একদিন। আর দুই দিনে এক সপ্তাহ। পড়ার সময় আর কীভাবে পাব বলো। তো এই সমস্যার সমাধানও দিয়ে দিয়েছিল হাসান ভাই। ওর ভাষাতেই বলছি-

সময় যে কীভাবে যায় তা তুমি বুঝতে পারো না। সময় অপচয় করো, কারণ তুমি সময় সম্পর্কে সচেতন থাকো না। সময়ের হিসাব করো না। তাই তোমার প্রথমে যা করতে হবে, তা হলো সময়ের হিসাব রাখা।

একটা ডায়েরি বা খাতা নাও। কোনো রুটিন করতে হবে না। একটা টেবিল বানাতে হবে নিচের মতো করে। তুমি যতক্ষণ জেগে থাকো। ১ ঘণ্টার ১ টা করে স্লট থাকবে প্রথম কলামে। দ্বিতীয় কলামে থাকবে এই ১ ঘণ্টায় তুমি কী কী করেছ। আমি পড়াশোনায় সিরিয়াস হব, সময় নষ্ট করব না এমন চিন্তা রাখবে না। মানে নরমালি তুমি যেভাবে দিন পার করো সেভাবেই দিন পার করবা।

সকাল ৫ টা থেকে ৬ টাকী যে করলাম খেয়াল নাই।
সকাল ৬ টা থেকে ৭ টাআম্মার সাথে ঝগড়া করেছি ডিম ভাজি করে না দিয়ে কেন সিদ্ধ করে দিল।
সকাল ৭ টা থেকে ৮ টাপড়তে বসেছি, কিন্তু মন বসাতে পারিনি। ফোন চেপেছি।
সকাল ৮ টা থেকে ৯ টা ৫ মিনিট পরপর ফোন হাতে নিয়েছি আর একটু একটু করে পড়েছি।
......... 
রাত ৯ টা থেকে ১০ টা 

এভাবে ৭ দিন পড়াশোনায় সিরিয়াস হতে হবে এমন কোনো চিন্তা ছাড়াই চলো। যেভাবে আগে চলতা সেভাবেই চলো। এরপর এই ৭ দিনের টেবিল নিয়ে বসো। ঠান্ডা মাথায় মনোযোগ দিয়ে দেখো। বুঝতে পারবা কোন কোন কাজে তোমার সময় চলে যাচ্ছে। কীভাবে কীভাবে তোমার মনের অজান্তেই সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন তুমি বুঝতে পারবা কেন তোমার ২ ঘণ্টায় ১ দিন মনে হয়। কেন তুমি পড়ার সময় বের করতে পারো না। ঠিক আছে না? ৭ দিন করে দেখো, যদি ফাঁদগুলা বুঝতে না পারো তাহলে টেবিলের ছবি তুলে ষোলোর পেইজে ইনবক্স করো বা মেইল পাঠাও।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত, তোমাদের অধিকাংশের সময় সবচেয়ে বেশি যেখানে যায় তা হলো মোবাইল ফোন। আর নয়তো প্রাইভেট-কোচিংয়ের পেছনে। প্রাইভেট-কোচিং নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করব। এখন আলোচনা করা যাক ফোনে সময় নষ্ট করা নিয়ে। 

স্মার্ট স্টুডেন্টের মতো ফোনে সময় নষ্ট করা বন্ধ করবে যেভাবে—

ধরো, তুমি পড়তে বসেছ। ১০ মিনিট পড়ার পর ইচ্ছা হলো একটু ফোনটা হাতে নিই। একটু ৫ মিনিট ভিডিও দেখি। ৫ মিনিটের জন্য ফোন হাতে নিয়ে কখন যে ১/২ ঘণ্টা পার করে দাও, তার আর কোনো ঠিকঠাকানা থাকে না। অনেকক্ষণ পরে হয়তো খেয়াল হয়... আরে ধুর! আমি তো ৫ মিনিটের জন্য ফোন হাতে নিয়েছিলাম... আমার তো পড়ার কথা ছিল... কিন্তু আমি কী করলাম এতক্ষণ... ধুর, আমি একটা ফেলটুস। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।

ব্যাস! এই যে রুটিন ওলটপালট করে ফেলেছ, তোমার মন খারাপ হলো, তোমার হতাশা আসলো, এই যে তুমি এতক্ষণ ফোন চাপাচাপি করে ব্রেইনের বারোটা বাজিয়ে ফেললা, তোমার আর পড়তে ইচ্ছা করবে না।  পুরা দিন নষ্ট হবে। তাই এই ৫ মিনিট ফোন হাতে নেবার ফাঁদ থেকে নিজেকে তোমার বাঁচাতে হবে। আর ফোনের এই ফাঁদ থেকে বাচার জন্য তুমি উলটো এই ফোনকেই ব্যবহার করতে পারো।

একটা নতুন খাতা নাও। টেবিল আঁকো। টেবিলে দুইটা কলাম থাকবে। প্রথম কলামে তুমি দিনের যে সময় জেগে থাকো (খাওয়া, গোসল, ক্লাস, সালাত, মাঠে গিয়ে খেলাধুলা এসব সময় বাদে) তা ৩০ মিনিট স্লট করে ভাগ করে লেখো। আর ডানপাশের কলামে লেখো এই ৩০ মিনিট সময় তুমি কী কী করেছ। তোমার টেবিল কেমন হবে তা এই টেবিলটা দেখলে বুঝতে পারবে-

সকাল ৭ টা থেকে ৭ টা ৩০১০ মিনিট টানা পড়েছি, এরপর ২০ মিনিট ফোন চেপেছি।
সকাল ৭ টা ৩০ থেকে ৮ টাটানা পড়েছি। কোনো ফোন চাপিনি।
সকাল ৮ টা থেকে ৮ টা ৩০পড়তেই পারিনি। ফোন চেপেছি।
সকাল ৮ টা ৩০ থেকে ৯ টা ০০ ৫ মিনিট পরপর ফোন হাতে নিয়েছি।
  
  

তো, এভাবে ৩০ মিনিট স্লট আকারে সময় ভাগ করার পাশাপাশি আরেকটা কাজ করতে হবে। ফোনে ৩০ মিনিট পরপর এলার্ম দিবা। ৭ টা ৩০ এ একটা, ৮ টায় একটা। এর ফলে যা হবে, তুমি মনের ভুলে ফোন হাতে নিয়ে চাপাচাপি করছ। কিন্তু বেশি সময় মনের ভুলে ফোন চাপতে পারবা না। কারণ, ৩০ মিনিট পরেই তো এলার্ম বাজবে। আর তোমার মনে পড়ে যাবে, তোমার কী কাজ ছিল আর তুমি কী করছ। এমন পদ্ধতি এক সপ্তাহ অনুসরণ করে দেখো! ফোনে তোমার সময় অপচয় ব্যাপক আকারে কমে আসবে ইনশাআল্লাহ। যদি না হয়, তাহলে ষোলোর এই সংখ্যা কিনতে তোমার যে টাকা লেগেছে তা ফেরত দেবো! চ্যালেঞ্জ নিবা?

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

[ষোলো ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত]