নদীর পাড় ধরে হাঁটছি৷ উদ্দেশ্যহীন হাঁটা৷ সন্ধ্যা বেলার এই মনোরম সময়টা নিজেকে দেওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত৷ দিনের প্রখর রোদের ঝলকানি শেষে এ সময়টা ভালো লাগার মতো৷ আমার জীবন একটি আদর্শ বিরক্তিকর এবং কষ্টের জীবনের উদাহরণ। কষ্টের কারণটা বলতে পারব। কিন্তু এখন না, যথাসময়েই বলব। বিরক্তির নির্দিষ্ট কারণ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, বলতে পারব না৷ তবে, আমি শুধু জানি, আমি আমার জীবনের প্রতি বিরক্ত৷ মাঝে মাঝে একঘেয়েমিপূর্ণ এক রুটিনে বাঁধা জীবন থেকে পালাতে ইচ্ছা করে৷ কিন্তু পালিয়ে কোথায় যাব?

এখন রাত আটটা। আমি দাড়িয়ে আছি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ছয় নং প্ল্যাটফর্মে৷ স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চিত্রা এক্সপ্রেস খুলনার উদ্দেশ্যে ছাড়বে৷ উঠে বসলে হয়৷ রাতের ট্রেন ভ্রমণ ভালো লাগার কথা৷ অন্তত বিকেলের ঘটনাটা কিছুক্ষণ ভুলে থাকা যাবে।

২.

‘শুভ, তোর ভাইয়া এসেছে?’

‘আসেনাই, আম্মু৷’

দিলরুবা বেগমের টেনশন বেড়েই চলেছে৷ তাঁর বড় ছেলে অভ্রনীল বের হয়েছে বিকাল চারটায়৷ এখন রাত ন’টা৷ কোনো কাজে তো যায়নি৷ বলে গিয়েছিল, শুধু হাঁটতে যাচ্ছে৷ পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী তার হন্টন প্রক্রিয়া চলছে? এ কেমন হাঁটা? ইদানীং অভ্রনীল কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে৷ মায়ের কাছে প্রায়ই ওর বিষণ্ণ সময়গুলোর কথা বলে৷ হঠাৎ এমন অদ্ভুত বিষণ্ণতা ওকে আক্রমণের কারণ খুঁজে পান না দিলরুবা বেগম।

৩.

‘বস, কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠেছে।’

‘কোন ট্রেন?’

‘চিত্রা এক্সপ্রেস’

‘এ ট্রেন তো খুলনা যায়।’

‘জি, বস।’

‘উঠে বোস৷ প্রতি মুহূর্তের খবর পাই টু পাই চাই।’

৪.

আজ বৃহস্পতিবার৷ ট্রেনে জায়গা পাওয়া মুশকিল৷ বিশাল ট্রেন৷ তবে, জয়দেবপুর আসার পর অনেক জায়গা খালি হয়ে গিয়েছে৷ বসলাম আয়েশ করে৷ হঠাৎ কামরার লাইট অফ৷ ব্যাপার কী? সে যাই হোক, গুরুতর কিছু নয়৷ আমার জন্য বরং ভালোই। আলো আঁধারির পরিবেশ প্রিয় আমার৷ ‘আয়েশ করে’ চিন্তা করার জন্য এ পরিবেশ খুবই উপাদেয়৷ একটু ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে৷ রাতে তো ভালো ঘুম হয় না৷ কোথায় যাচ্ছি জানা নেই৷ অবশ্য বিষয়টা এমন না৷ এটা খুলনা যাবে তা তো জানিই৷ একদম শেষ স্টেশনে নেমে পড়ব৷ নেমে কী করব? তা দেখা যাবে।

৫.

দিলরুবা বেগম এসে বসলেন স্বামীর কাছে। রাতের খাবারে বসার কথা, কিন্তু অভ্রনীলের আব্বু দেরি করছেন৷ তিনি মনযোগ দিয়ে একটি বই পড়ছেন৷ নাম, ‘সাঁতার শেখার একশত এক উপায়’৷ জয়নাল সাহেব সাঁতার জানেন না৷ এটি তার খুবই চিন্তার কারণ। চেষ্টা যে করেননি তা অবশ্য না। কিন্তু কোনোভাবেই সাঁতার আয়ত্ত করতে পারছেন না। জীবনে একটিই চাওয়া, মরার আগে তিনি আধঘণ্টা হলেও পানিতে মাঁছের মতো সাতার কাটতে চান।

‘এই, তুমি কী করছ?’

‘আহহা, দিলে তো মনযোগটা নষ্ট করে৷ আচ্ছা শোনো দিলরুবা, মনে হচ্ছে এবার সাতার শেখা হয়েই যাবে।'

‘রাখো তো৷ সাতার শিখতে পানিতে চুপনি খেতে হয়৷ বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে সাতার শেখা যায় না।’

‘আমি শিখে দেখাব৷ চ্যালেঞ্জ!’

‘অভ্রনীল এখনো আসেনি।’

‘ভালো কথা৷ তাতে কী সমস্যা?’

‘কোনো সমস্যা নয়?’

‘সমস্যা নাকি? আমি তো কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না।’

‘জনাব, কোথায়, কবে, কোন কাজে সমস্যা নামক বস্তুটি আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলতে পারেন?’

‘না, পারি না৷ এখন যাও, আমার গবেষণায় ডিস্টার্ব করবে না।’

‘ভাত খাবে না?’

‘খাব, অবশ্যই খাব, আলবৎ খাব। তবে এখন না। Go, take dinner and then sleep.’

৬.

ঝাঁকি দিয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল৷ ব্যাপার কী?

‘কী হইছে ভাই?’

‘ভাই, ক্রসিং৷’

আধো ঘুমে থাকার কারণে হালকা ঝাঁকিকেই বেশি ঝাঁকি মনে হলো৷ ঘুমাবার কথা না তো আমার! যেতে যেতে ‘চিন্তা’ করব দেখে ট্রেনে উঠা। অথচ ঘুমাচ্ছি৷ ট্রেন থেমেছে দিগন্তবিস্তৃত মাঠের মধ্যখানে৷ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অবাক হলাম৷ জ্যোৎস্না রাত আজ। সাহিত্যের ভাষায় ‘চান্নিপসর রাইত’৷ চাঁদ রাতগুলো এত সুন্দর! আল্লাহ এ চাঁদটাকে কত সুন্দর করেই না সৃষ্টি করেছেন! অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে৷ ভালো লাগা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে জোনাকি পোকার ঝাঁক৷ দিগন্তবিস্তৃত মাঠের স্থলে এবং অন্তরীক্ষে জ্যোৎস্না এবং জোনাকির খেলা দেখছি৷ সুন্দর৷ অতি সুন্দর৷ এ সৌন্দর্য না দেখলে কাউকে বোঝানো দুরূহ কাজ৷ বিকেলের ঘটনার রেশটুকু আর মনে রইল না।

৭.

‘কী খবর?’

‘বস, ক্রসিং এ আছি৷ টাঙ্গাইলের আগে।’

‘ওদিকে সবাইকে রেডি থাকতে বলা হয়েছে?’

‘বলিনাই৷ এখনই বলতেছি৷’

‘হ্যাঁ, খুবই সাবধানে দ্রুততার সাথে কাজ করতে হবে৷ কোনোভাবেই যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়৷ তা হলে সব শেষ।’

‘জি, বস৷ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আমরা৷’

৮.

দিলরুবা ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ অভ্রনীল ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, সে খুলনায় তার এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছে৷ টেনশনমুক্ত হলেন অনেকটা৷ রাত গভীর হচ্ছে৷ জয়নাল সাহেবও তাঁর সাতার শীর্ষক গবেষণা-কর্মের গভীরে প্রবেশ করছেন৷ ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে চা, কফি নিয়ে আয়েশ করে বসেছেন৷ তিনি সাতার শিখতে বদ্ধপরিকর।

‘বাবা, 12:45 বাজে, ঘুমাবে না?’ অভ্রনীলের ছোট ভাই শুভ জিজ্ঞাসা করল।

‘Hey, who gave you permission to enter my library?

‘আচ্ছা আচ্ছা, দুঃখিত!’

‘হুম, কথা বোলো না৷ যাও।’

‘বাবা, একটা ক…’

‘আমি বলেছি যাও।’

৯.

রাত আড়াইটা৷ খুলনায় নেমেছি৷ বৈচিত্রের সন্ধানে এসেছিলাম৷ কিন্তু এ কেমন ‘বৈচিত্রের’ মধ্যে ঢুকে গেলাম বুঝতে পারছি না৷ হায় খোদা! আমার দু’চোখ বন্ধ৷ একটি মাইক্রোতে আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ উদ্দেশ্যহীনভাবে ট্রেনে উঠলেও জানা ছিল খুলনায় নামব৷ কিন্তু এখন যে কোথায় যাচ্ছি তা একেবারেই বুঝতে পারছি না৷ এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? মেরে ফেলবে না কি? কোনো এক খোলা প্রান্তরে নিয়ে ঠা..স করে গুলি চালিয়ে পালাবে?

এটা অবশ্য হওয়ার কথা নয়৷ এরকমভাবে মেরে ফেলার মতো কিছু তো করিনি৷ কোনো উদ্দেশ্য আছে৷ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই কিডন্যাপ করেছে৷ কী আর করবে, কালকে বাসায় ফোন দিয়ে মোটা এমাউন্টের টাকা চাইবে৷ সে যাই হোক, আমি ঘুমাব এখন৷ চোখে রাজ্যের ঘুম৷ একটু নাক টানতে পারলে মন্দ হয় না৷ দুইপাশে যারা বসে আছে ওদের চমকে দেওয়া যাবে৷ আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে অথচ আমি ঘুমাচ্ছি নাক ডেকে!

(চলবে ইনশাআল্লাহ …)