সোফার উপর সটান বসে আছি। সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছেন খালুজান। জরুরি তলব করে আনানো হয়েছে আমাকে। যেহেতু জরুরি তলব সেহেতু ঝামেলা কিছু একটা যে আছে সেটা খুব টের পাচ্ছি।

‘খালা, রাহাতকে দেখছি না যে..’

‘দেখবা। ওরে দেখানোর জন্যেই ডাকছি তোমাকে।’ গোমড়ামুখেই খালুজানের উত্তর। খালা নিশ্চুপ।

রাহাত হলো আমার একমাত্র খালাত ভাই। বাপ-মায়ের আদরের দুলাল। ছোট বড় কোনো আবদারই ওর অপূর্ণ রাখেন না খালা-খালুজান।

যে কেউ হয়তো ভেবে বসতে পারে- আদর পেয়ে বখে যাওয়া কোনো ছেলেই হবে বোধহয়!

কিন্তু না, আর দশটা ছেলের মতো নয় রাহাত। বেশ ব্রিলিয়ান্ট। জেএসসিতে ওদের স্কুলের হাইয়েস্ট মার্কস পেয়ে সরকারি স্কলারশিপও বাগিয়ে নিয়েছে।

ওকে নিয়ে তো কোনো ঝামেলা হবার কথা না। কাহিনিটা কী?

‘দরজা খোল, ব্যটা! আমি তোর মাসুদ ভাই..’

মিনিট খানেক পরে দরজা খুলে গেল। দরজা খুলে দিয়েই রাহাত খাটের ওপর গিয়ে বসেছে। মাথা নিচু।

‘কী রে! এতদিন পরে এলাম। কেমন আছি না আছি - কিছু তো বলবি না কি?!’

মাথা তোলার পর সবার আগে নজরে এল চোখজোড়া। কত রাত ঘুমায় না কে জানে!

পাশে বসতে বসতে পিঠে হাত রাখতেই বুঝলাম গায়ে হালকা জ্বর।

‘কীসব কাণ্ড করিস বল তো! বাপ মায়ের ওপর কেউ রাগ করে? উনারা তোকে কত ভালোবাসেন।

সামান্য ভিডিয়ো গেমস নিয়ে এত্ত রাগ!’

সমস্যার আদ্যোপান্ত খালা বলেছে আমাকে। জেএসসির পরে একটা ট্যাব কিনে দিতে বলেছিল রাহাত। ছেলের ভালো রেসাল্টের বিপরীতে এই আবদার ফেলার কোনো সুযোগই ছিল না। খালুজান একটু গাইগুই করলেও পরে আর ‘না’ করেননি। ছেলে খুশি তো তারাও খুশি!

কিন্তু সমস্যা দেখা দিল দিন কয়েক বাদে।

ডিভাইস পেয়ে ছেলে তো নাওয়া-খাওয়া ভুলবার জোগাড়। সারাদিন ওসব নিয়ে পড়ে থাকে নিজের রুমে। পাগলের মতো অবস্থা।

পড়াশুনাও শিকেয় উঠেছে। মিডটার্ম পরীক্ষায় নাকি অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ফিজিক্সে পেয়েছে ৪৪! আনবিলিভেবল!

গতরাতে খালুজান খেতে বসে ডাকাডাকি করেও ওকে যখন টেবিলে আনতে পারলেন না, তখন উঠে গিয়ে ট্যাব-টাই কেড়ে নিলেন। সাথে সাথে ওটা চলে গেল লকারে। বোনাস হিসেবে বাসার ওয়াই-ফাই লাইন বন্ধ!

তুমুল কাণ্ড।

রাহাতও কম যায় না। চিৎকার চেঁচামেচি করে শেষে না খেয়েই ঘরে খিল দিয়ে আছে কাল থেকে। বন্ধ দরজা খুলল আমি আসার পর।

‘চল, উঠ! বাইরে খেতে যাব। তোর সাথে অনেকদিন বাইরে খাই না।’

হাত ধরে টেনে তুলে ওয়াশরুমে পাঠালাম অভিমানী ভাইটাকে।

খাবারের অর্ডার দিয়ে রাহাতকে বললাম,

‘তোর বাগানের কী খবর বল তো.. সেই যে খুঁজে খুঁজে কোত্থেকে কী একটা ফুল এনেছিলি না? কী যেন নাম?’

‘হাসনাহেনা। মরে গেছে বোধহয়, ভাইয়া। জানি না আমি। ছাদে যাওয়া হয় না অনেকদিন। ওসব আর ভাল্লাগে না!’

‘বলিস কী! এত শখ করে করলি সব। এখন বলছিস ভাল্লাগে না!’

বার্গার চলে এসেছে, লাচ্ছি আসতে একটু দেরি হবে বলল। হোক, আমার হাতে অফুরন্ত সময়। তাছাড়া এরা লাচ্ছিটা বানায় একদম পার্ফেক্ট। সোজা বাংলায়- অসাধারণ!

‘’নে- শুরু কর। বিসমিল্লাহ..

আচ্ছা, আমাকে বল তো, দিনে এভারেজ কতক্ষণ গেম খেলে কাটাস তুই?’

‘উমম.. কতই বা আর হবে.. আধ ঘণ্টা, বড়জোর এক ঘণ্টা.. এর বেশি তো না!’

আমতা আমতা করে বলল রাহাত। অথচ খালা আমাকে বলেছে, ও নাকি দিনের ম্যাক্সিমাম টাইম-ই ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে। মাঝে তো স্কুলও কামাই দিয়েছে ক’দিন!

রাহাত যে এভাবে আমার কাছে মিথ্যে বলবে সেটা আমি আশা করিনি। কিছুটা রাগ হলেও আপাতত সামলে নিলাম।

‘তুই কি জানিস একটা নিরীহ অভ্যেস কিন্তু আসক্তি হয়ে উঠতে পারে? এবং সেটা তখন আর মোটেই নিরীহ থাকে না। বরং খুবই বাজে একটা ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়।

আমার ক্যাম্পাসের এক বড় ভাইয়ের গল্প শোন। দিনে দুই প্যাকেট সিগারেট ছাড়া তার চলেই না। একদম হিসেব করা। কোনোদিন যদি একটাও কম হয় সেদিন নাকি তার সকালের কাজটা ক্লিয়ার হয় না! চিন্তা কর অবস্থা!’

রাহাত ফিক করে হেসে ফেলল। এই ছেলের হাসিতে একটা আশ্চর্য মায়া আছে। আগে কখনো খেয়াল করিনি।

‘কী আজব! সিগারেটের সাথে টয়লেটের সম্পর্ক কী?’

‘এটাই তো কথা, এটা তার সাইকোলজিক্যাল সমস্যা। আসক্তি এতটাই ভয়ংকর। অথচ মজার ব্যপার হলো, তার শুরুটাও ছিল সপ্তাহে একটা সিগারেট দিয়ে, তাও আবার বন্ধুরটা শেয়ার করে।

গেমসের ব্যপারটাও তা-ই। ধরে নিলাম তুই খুব কম সময়ই খেলিস। আসক্তি না, শখ। কিন্তু এটা যদি আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়, সেটা কি খুব ভালো কিছু হবে? খারাপ হবে না?’

রাহাত মাথা নেড়ে শুধু বলল, ‘হু।’

‘আচ্ছা, তুই আমাকে বল তো, কী করে বুঝবি যে ব্যপারটা ‘আসক্তি’ পর্যায়ে চলে গেল কি না?’

‘কী করে?’ বার্গার মুখে দিতে দিতে পালটা প্রশ্ন রাহাতের।

‘বলছি শোন...

কিছু সিম্পটমস, মানে লক্ষণ দেখার মাধ্যমে খুব সহজেই বুঝতে পারবি ব্যপারটা। যেমন ধর-

অতিমাত্রায় খেলতে ইচ্ছে করবে। না খেলতে পারলে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি লাগবে। কিছুই ভালো লাগবে না।

রাত জেগে খেলার অভ্যেস তৈরি হবে। না ঘুমিয়েই রাত কেটে যাবে পুরো রাত। ফলে সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থেকেই যাবে। কাজে মন দিতে পারবে না।

দিন-রাত পার করে দিবে গেমস খেলে কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে- মাত্রই তো ফোনটা নিলাম, আধা ঘণ্টা খেলেছি খালি! গেমস নিয়ে মিথ্যে বলার হার বেড়ে যাবে। দৈনন্দিন কাজকর্মগুলোও সময়মতো করবে না। এমনকি অনেকের তো খাবার কথাও মাথায় থাকে না। খেলেও খাবে একাকী। সবার সাথে খাবে না। দেখা গেল এক হাতে খাচ্ছে, অন্য হাতে গেমস। একা থাকতেই বেশি পছন্দ করবে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে যাবে।

খেলার সময় কেউ কোনো দরকারি প্রয়োজনে ডাকলেও মেজাজ বিগড়ে যাবে।

পড়াশোনার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নিতে শুরু করবে। একসময় যে কাজগুলো সে ভালোবেসে করত, সেসব কাজও তখন পানসে মনে হবে। ক্রিয়েটিভিটি (সৃষ্টিশীলতা) কমতে থাকবে।

এগুলো একদম সাধারণ কিছু লক্ষণ। আরও অনেক আছে। সেসব না হয় থাক। তোর সাথে কিছু মিলে গেল কি না তা-ই বল!’

এর মধ্যে কখন যেন ওয়েটার এসে লাচ্ছি দিয়ে গেছে। আমি কথার ফাঁকে খেয়াল-ই করিনি।

বার্গার শেষ করে বরফ দেয়া লাচ্ছিতে চুমুক দিচ্ছে রাহাত। একটু থেমে বলল-

‘সব না, তবে কয়েকটা মিলেছে।’

‘আচ্ছা! আচ্ছা!’

হঠাৎ রেস্টুরেন্টের ডান পাশের এক রাস্তায় গোলমাল দেখা দিল।

‘ভাই, একটু…’

রাহাত উঠে গিয়ে জানালা থেকে ঘুরে আসল, মুখটা একটু থমথমে। ‘এক রিকশার সাথে সাইকেল বেঁধে গিয়েছে’, এসে আমাকে জানাল রাহাত।

কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা-

‘তোর বোধহয় চশমা নিতে হবে রে। চোখের তো বারোটা বাজিয়ে ফেলেছিস!

আমি তো এখানে বসেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, কী কাহিনি ঘটেছে। তোর উঠে গিয়ে দেখতে হলো!’

রাহাতের মুখটা যেন আরও মলিন হয়ে গেল।

কৃত্রিম রাগী সুরে বললাম-

‘রাত দুপুর সারাক্ষণ স্ক্রিনে ডুবে ডুবে গেমসে “অ্যাটাক” দিয়ে বেড়াস, আর এদিকে তোর শরীরেই অলরেডি অ্যাটাক শুরু হয়ে গেছে।

আজ চোখ গেছে, কাল মাথা যাবে!’

‘ধুর, ভাই! এখন আবার বইল না যে, গেইম খেলতে খেলতে পাগল হয়ে যাব..’

‘তো যাবিই তো। পাগল হয়তো হবি না, বাট মানসিক সমস্যায় তো পড়বিই যা ‘Gaming Disorder’ নামে পরিচিত।’

রাহাতের চোখে মুখে খানিকটা অবিশ্বাসের ছায়া। তবে আমার প্রতি ওর সুধারণা এতটাই প্রকট যে, ঠিক অবিশ্বাসও করতে পারছে না।

ভ্রান্তির ছায়া দূরে সরিয়ে দিতে ফোনটা বের করে তখনই গুগল করে ওকে দেখালাম-

‘নে! দেখ..’

বেশ কয়েকটা আর্টিকেল ঘুরে ঘুরে দেখা শেষে হতাশ ছেলেটাকে বললাম-

‘তাহলে কী বুঝলি বল তো? কতটা ক্ষতি আর কতটা লাভ?

আচ্ছা, আমি সামারাইজ করি, শোন..

শারীরিক ক্ষতি:

দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি, খাওয়ায় অরুচি।

মানসিক ক্ষতি:

মেজাজ তিরিক্ষি, অতিরিক্ত চাপ, সাথে পারিবারিক আর সামাজিক ক্ষতি তো আছেই।

সময় নষ্ট, টাকা নষ্ট, পড়াশুনা-ক্যারিয়ার নষ্ট!

আলিমগণ তো এসব গেইমকে নাজায়িয বলেছেন। গেমকে নাজায়িয বলে ফাতাওয়া দিয়েছেন। অতএব, ইসলামিক দিক বিবেচনা করলেও এসব গেমস হলো ‘লস প্রজেক্ট’।

জীবনটাকে নষ্ট করার সব উপাদান এখানে একসাথে। একের ভেতর সব। আর বিনিময়ে লাভের খাতায় কিছু হাস্যকর সুখানুভূতি ছাড়া কিছুই নেই। তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে এই নোংরা জলে ভেসে যাবে, এটাও আমাকে মানতে হবে?’

‘স্যার, আর কিছু লাগবে?’

‘না ভাইয়া, থ্যাংকস! বিলটা দিন।’

বিল পে করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রিকশা নিলাম। রাহাত কিছু বলছে না। হয়তো নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করছে। অথবা কে জানে কত মাস পরে হয়তো মুক্ত বাতাসে মন ভরে একটু শ্বাস নিচ্ছে। নিতে থাকুক।

রাহাত যখন কল দিয়েছিল আমি তখন ভার্সিটির ল্যাবে। তোফাজ্জল স্যারের ক্লাস। কল রিসিভ করার কোনো জো ছিল না।

ক্লাস শেষে কল ব্যাক করতে ফোন খুলে দেখি রাহাতের ছোট্ট মেসেজ-

‘মাসুদ ভাই!

হাসনাহেনা গাছে নতুন ফুল এসেছে। যা সুন্দর ঘ্রাণ ছড়ায়! আমি তো এখন ছাদেই টং এর মতো বসার জায়গা বানিয়ে নিয়েছি। ওখানেই পড়ি।তুমি যদি এবার বাসায় আসো, তাহলে তো আর যেতেই চাইবে না!

ওহ.. আর, ট্যাবটা বাবাকে বলে অনলাইনে বিক্রি করে দিয়েছি। আপাতত আমার ওসব লাগছে না। বিক্রির টাকা কী করেছি জানো?

বই কিনেছি! ঐ যে তুমি একবার একটা লিস্ট দিয়েছিলে যে.. লিস্ট ধরে ধরে পড়ছি। আচ্ছা ভাইয়া, নতুন বই আর হাসনাহেনা কোনটার ঘ্রাণ বেশি সুন্দর?

একদমে পুরো মেসেজটা পড়ে নিলাম। বুকের ভেতর থেকে কেমন একটা অদ্ভুত প্রাচীন বাতাস শিরশির বেরিয়ে এল। কেন যেন একটু শব্দ করেই বলে ফেললাম- আলহামদুলিল্লাহ!