.

আমি ‘এম’। বাসায় মোটামুটি ধর্মীয় পরিবেশ থাকায় ছোটবেলা থেকেই নৈতিকতার বাউন্ডারির ভেতরেই বড় হয়েছি। লাগামছাড়া উদ্দাম লাইফস্টাইল থেকে গা বাঁচিয়ে গোছানো একটা জীবন যাপন করতাম। ছাত্রজীবনের বেশিরভাগ সময় সহশিক্ষার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকায় প্রেম-টেম করার খুব বেশি সুযোগ কখনো তৈরি হয়নি। সুযোগ আসলেও এসব থেকে সযত্নে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।

রাস্তার কোণায় অন্ধকার চিপায় দাঁড়িয়ে ফোনে ফিসফাস, কথা বলতে বলতে নির্ঘুম রাত কাটানো, টিউশনির সব টাকা রিচার্জ, গিফট আর ডেটিং এর পেছনে উড়ানো... একদম ব্যক্তিত্বহীন আচরণ মনে হতো। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই হারাম সম্পর্কে জড়িত থাকায় ওদের দেখে অনুভব করতে পারতাম, হারাম সম্পর্ক কীভাবে মানুষকে নৈতিকভাবে দেউলিয়া বানিয়ে দেয়।

কারও সাথে দুই মিনিট কথা বলার পর আমার স্টকে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার মতো আর কোনো টপিক থাকে না। অথচ এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকবকিয়ে যায় অনর্গল! এত্তো এত্তো টপিক কই পায় এরা! ভাবনায় কুলোয়নি কখনোই।

রুটিনমাফিক গোছানো জীবনযাপন, সব ঠিকঠাকই ছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা খণ্ডকালীন চাকরিতে প্রবেশ করার পর থেকেই যত বিপত্তির শুরু। অবাধ মেলামেশার জোয়ারে ভেসে গিয়ে খেই হারাতে সময় লাগেনি বেশিদিন। খুব বেশি প্র্যাকটিসিং তখন ছিলাম না। শুধু সালাতটা নিয়মিত আদায় করতাম। এতটুকুই।

এক মেয়ে কলিগের সাথে জড়িয়ে যাই অল্প কিছুদিনেই। যেঁচে এসে নানান ঢঙে কথা বলা, এটা ওটা চেয়ে নেয়া, বিভিন্ন রকমের ইঙ্গিত, ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, ঠুনকো কারণে ইনবক্সে নক দেয়া, ‘দুষ্টুমি’ করে ফোন দেয়া...

আমার দীর্ঘদিনের গড়ে তোলা নৈতিকতার দেয়াল ভেঙ্গে হারাম সম্পর্কের কাঠামো তৈরি করার জন্য একদম বুলডোজারের মতো কাজ করেছে এগুলো। সরাসরি খুব বেশি কথাবার্তা-মেলামেশা না হলেও ইনবক্সে আলাপের মৃদু হাওয়া ‘হাই-হ্যালো’র সাগর পেরিয়ে ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় নিয়ে চ্যাটিং এর দিকে গিয়ে গভীর নিম্নচাপের রুপ নিয়ে আরেকটু শক্তি সঞ্চয় করে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হয়ে আঘাত হেনে সবকিছু ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। তারপর একদিন চ্যাটে প্ল্যান করে রেস্টুরেন্টে বসা, আইসক্রিম খাওয়া। গাঢ় অন্ধকারের দিকে যাত্রা শুরু এভাবেই।

অপর পাশ থেকে প্রলুব্ধ করার নানান রঙের চেষ্টার মধ্যেও এই আকর্ষণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা কম করিনি। আল্লাহর অবাধ্য হয়ে শয়তানের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে আর কতক্ষণই বা সংগ্রাম করা যায়? শুভ্র পোশাকে কাদায় নাচতে নেমে আপনি কতক্ষনই বা কাপড়ের শুভ্রতা রক্ষা করতে পারবেন?

“এম’, তুমি তো এমন না! এগুলো তোমার জন্য না, তোমার সাথে যায় না এসব!”, “দেখো, তুমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, ঐ ধনীর দুলালি তোমার জন্য না। পরে কষ্ট পাবা অনেক”, “আল্লাহকে ভয় করো, তুমি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত একটা ছেলে। তোমার মূল্যবোধের সাথে, তোমার ব্যক্তিত্বের সাথে এটা কোনোভাবেই যায় না, তোমার উচিত হবে না এই ফাঁদে পা দেয়া।” নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে নিজেকে উপদেশ দিচ্ছিলাম অনবরত। কেন আমার এই হারাম সম্পর্কে জড়ানো উচিত না, এই টপিকে নোট লিখতাম ফোনে। সালাতের পর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম। হারাম সম্পর্কে না জড়ানোর পক্ষে শতটা কারণ প্রস্তুত ছিল। বিবেককে ঠিকঠাক ভাবে কাজে লাগানোর সব চেষ্টাই করেছি। অন্ধ আবেগ আমার সব চেষ্টাই গ্রাস করে নিয়েছে। কিছুতেই শেষ রক্ষা হয়নি।

হবে কীভাবে? সারারাত নিজের সাথে সংগ্রাম করে, নিজেকে শাসন করে দিনের বেলা তো সেই ফাঁদের মায়াজালেই নিজেকে সঁপে দিচ্ছি। আল্লাহর অবাধ্য হয়ে ফ্রি-মিক্সিংওয়ালা পরিবেশে চাকরি করছি, দৃষ্টি হিফাযতের বালাই নেই, ফ্রেন্ডলিস্টে জায়গা দিচ্ছি, মেসেঞ্জারে চ্যাট করছি, একই সাথে হারাম সম্পর্ক থেকেও বাঁচতে চাইছি। কীভাবে সম্ভব?

হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, তবে এটা ছিল প্রতিনিয়ত নিজের সাথে একটা যুদ্ধ। ঘুম ভাঙলেই বুক কেঁপে উঠত। প্রচন্ড খারাপলাগা ঘিরে ধরত। দিন গড়াতে গড়াতে অবশ্য সব ঠিকঠাক।

‘কাছে আসা’র সেই চিরাচরিত নিয়মে চলছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট, বয়ে যেত ইমোজির বন্যা-স্টিকারের নহর! গভীর রাত পর্যন্ত ফোনে ফিসফাস, ডেটিং এ যাওয়া। বদলে গিয়েছিলাম খুব। যেই আমি রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতাম, সেই আমি রাত তিনটায়ও সজাগ। সন্ধ্যার পর টিউশনি সেরে রাস্তার চিপায় দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে ফোনে কথা বলাটা, পথচারিদের কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টির দিকে গা না করে চালিয়ে যাচ্ছিলাম রুটিনমাফিক। টিউশনিতে ফোন ব্যবহার রীতিমতো অপরাধ গণ্য করতাম। সেই আমিই টিউশনে বসে চ্যাট করে যাচ্ছি অবলীলায়! সারাক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকা, ঘন ঘন বাইরে যাওয়া, ফোনের বিভিন্ন এপে লক দেয়া, জীবন-যাপনে নানান অনিয়ম।

যে আচরণগুলো চরমভাবে ঘৃণা করতাম, ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় মনে করতাম, সেই আচরণগুলোকেই আপন করে নিয়েছিলাম খুব করে। যেন এক অন্য আমি। ব্যক্তিত্ব হারানো, ঈমান হারানো, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য এক আদর্শ কুপ্রবৃত্তির গোলাম।

মান-অভিমান, খুনশুটি, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন, এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। অবিরাম এই যিনাকে শয়তান পরবর্তী রুপ দেয়ায় সচেষ্ট হলো এবার।

মাঝে মাঝে নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হতাম, এই আমিই কি সেই আমি? আয়নায় তাকালে নিজেকে চোর চোর মনে হতো। খারাপ কিছু করে ফেললে পরে প্রচন্ড অনুতাপ কাজ করত। নফল সালাত পড়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করতাম অনুতপ্ত হৃদয়ে। আল্লাহ রক্ষা না করলে একদম খারাপ পর্যায়ের যিনায় লিপ্ত হয়ে যেতাম নিশ্চিত। প্রতিটা হারাম সম্পর্কই একসময় চূড়ান্ত পর্যায়ের যিনার দিকে এগিয়ে যায়। অবাক হয়ে অনুধাবণ করেছিলাম, আল্লাহর অবাধ্যদের শয়তান কীভাবে কুপ্রবৃত্তির দাস বানিয়ে দেয়। আপনি আল্লাহর অবাধ্য হয়ে একটু ছাড় দিলেই হবে, বাকিটা শয়তান নিজ দায়িত্বে আপনাকে দিয়ে করিয়ে নেবে।

২.

শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যায়ে তখন। এই বয়সী মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ ছেলেদের স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল। সমবয়সী ধনীর কন্যাকে বিয়ে করার যোগ্যতা অর্জনের এক বিশাল চাপ ভারী পাথর হয়ে বুকে চেপে বসেছিল। বাস্তবতার নিরিখে যাচাই করলে বিভিন্ন কারণেই এটা ছিল স্রেফ একটা আকাশ-কুসুম পরিকল্পনা। মেয়ের পরিবার থেকেও বিয়ের তোড়জোড়। একা একা এই চাপ নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না কোনোভাবেই। হারানোর ভয়ে একদম চুপসে যেতাম। ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিলাম। রাতের ঘুম নাই হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুবান্ধব কারও সাথেই শেয়ার করিনি ব্যাপারটা। হারাম সম্পর্কের পুরো ব্যাপারটাই একদম গোপন রেখেছিলাম সবার কাছ থেকে।

বিয়ের পাত্র হিসেবে যোগ্যতর হওয়ার আশায় আগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে অমানুষিক খাটুনি আর মানসিক চাপওয়ালা আরও ভালো বেতনের এক চাকরিতে ঢুকলাম। নতুন এক সংগ্রাম। ভোরে বেরিয়ে রাতে বাসায় ফিরতাম। দাঁতে দাঁত চেপে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে মেয়ের হঠাৎ হঠাৎ রহস্যজনক আচরণে ভেতরটা একদম ভেঙেচুরে যেত। দুই দিকের সংগ্রামে একদম চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিলাম। গলায় ফাঁস হয়ে আটকে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে।

যাদের কোনো হারাম সম্পর্ক নেই তাদের দেখেই ঈর্ষা লাগত, আহা! কত স্বাধীন ওরা! আগের ‘আমি’ কে মিস করতাম খুউব।

আল্লাহর কাছে সিজদায় পড়ে কান্না করতাম আর দুআ করতাম সবকিছু সহজ করে দেয়ার জন্য। তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতাম, শেষরাতে কান্না করতাম আল্লাহর কাছে। ক্রমাগত আল্লাহর কাছে অসহায় চিত্তে সিজদাবনত হতে হতে নিজের মধ্যে বিশাল একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আল্লাহর চরম অবাধ্যতায় লিপ্ত রয়েছি এই সম্পর্কে জড়িয়ে। সর্বক্ষণ একটা অস্বস্তি কাজ করত। আল্লাহর অবাধ্য হতেও বাঁধছিল, আবার ঐ মেয়ের কথা ভাবলেও বুক চিনচিন করে উঠত।

বাসার দিক থেকে নানান রকম প্রেশার সামলাতে হচ্ছিল ওকে। ওদের প্রত্যাশার সাথে আমার স্ট্যাটাসের দূরত্ব তখন আলোকবর্ষ সময়। এই অবস্থায় হালালভাবে ওদের বিয়ের প্রস্তাব দেবার চিন্তা করাটাও চরম দুঃসাহসিকতা। শুধু আবেগই ছিল সম্বল, আর কিছুই ছিল না। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ফোনে কথা বলতে গেলেই বুঝতে পারতাম আল্লাহর অবাধ্য হচ্ছি। নিজের সাথে অনবরত যুদ্ধে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে তাকদীরের মালিক আল্লাহর কাছেই হাত পাতলাম সাহায্যের আশায়।

ইসতিখারার আমল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইশার পর বিনয় সহকারে দু’রাকাত সালাত আদায় করে হাত তুললাম। দুআর অর্থটা একদম হৃদয়ের ভেতর থেকে অনুভব করে করে মহান আল্লাহর কাছে ভিক্ষা করলাম সেই অনিন্দ্য সুন্দর দুআটি পড়ে–

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার জ্ঞানের সাহায্যে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের সাহায্যে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি এবং আপনার মহান অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। কেননা আপনিই শক্তিধর, আমি শক্তিহীন। আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন এবং আপনি অদৃশ্য সম্পর্কে মহাজ্ঞানী।

হে আল্লাহ! এই কাজটি (উদ্দিষ্ট বিষয়টি মনে মনে উল্লেখ করে) যদি আপনার জ্ঞান অনুযায়ী আমার দ্বীন, আমার জীবন, আমার ইহকাল এবং পরকালের জন্য কল্যাণকর হয়, তবে তা আমার জন্য নির্ধারণ করুন এবং আমার জন্য তা সহজ করে দিন। অতঃপর এতে আমার জন্য বরকত দান করুন।

আর এই কাজটি (উদ্দিষ্ট বিষয়টি মনে মনে উল্লেখ করে) যদি আপনার জ্ঞান অনুযায়ী আমার দ্বীন, আমার জীবন, আমার ইহকাল এবং পরকালের জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং যেখানেই কল্যাণ থাকুক আমার জন্য সেই কল্যাণ নির্ধারিত করে দিন। অতঃপর তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট রাখুন’।

(বুখারি, ৭৩৯০)

কী সুন্দর আর প্রশান্তিদায়ক! আল্লাহু আকবার! অর্থ বুঝে মুখস্ত করলে অন্যরকম প্রশান্তিদায়ক এক দুআ। অন্যরকম একটা হালকাভাব অনুভব করতাম এই আমলটা করার পর থেকে। উথাল-পাথাল আবেগের জঞ্জাল ছাড়িয়ে বিবেককে কাজে লাগাতে পারছিলাম আগের চেয়ে অনেক সুচারুভাবে। আল্লাহর সাথে অন্যরকম একটা নৈকট্য অনুভব করছিলাম। যেকোনো দুআ করলেই চোখ ফেঁটে পানি গড়িয়ে পড়ত টপটপ। এরকম পরিবর্তন নিয়ে আবার আল্লাহর অবাধ্যতায় ফিরে যাওয়া আসলেই সম্ভব ছিল না।

আল্লাহ আমার দুআ কবুল করেছিলেন। আমার জন্য উত্তম পন্থাটাই নির্ধারণ করেছিলেন আমার রব।

৩.

আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। ফোনে কথা বা মেসেঞ্জারে যথাসম্ভব আবেগের ছোঁয়া না রেখে কথা বলতাম। ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ তে নেমে এসেছিলাম। খুব কষ্ট পেতো এই ব্যবহারে।

এভাবে আস্তে আস্তে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। মেয়ে হয়তোবা ভেবেছিল অভিমান করে আছি। কিছুদিন পরেই ছিল আমার জন্মদিন। উইশ করার জন্য ফোন আসলো, রিসিভ করিনি। মেসেঞ্জারে উইশ আসলো, কোনো রিপ্লাই দিইনি। এসএমএস আসলো, রেসপন্স করিনি। পুরো একটা দিন শত চেষ্টা করেও কোনোরকম সাড়া না পেয়ে একদম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর অনেক কল, অনেক মেসেজ, ইনবক্সে অনেক লেখালেখি। আরও অনেক কিছু। কোনো সাড়াই দিইনি। সাড়া দিলে নির্ঘাত আলুথালু আবেগের ঝড়ের কাছে মার খেয়ে যেতাম। যেই আমি মেয়েটাকে হারানোর ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতাম সেই আমিই আজ কত নিষ্ঠুর!

মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে, নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে, কান্না করছে এসব চিন্তা মাথায় ঢুকতেই দিইনি। নিষ্ঠুরতার ক্ষেত্রে চরম পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম। আমার নিষ্ঠুরতা শয়তানের সাথে, শয়তানের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে কন্ট্রোল করছিলাম আর মাথায় একটা জিনিসই বারবার আনছিলাম,

‘আমি আল্লাহর জন্য সরে আসছি, সরে আসাতেই দুজনের কল্যাণ। আল্লাহ আমার জন্য এরচেয়েও উত্তম প্রতিদান দেবেন।’

যুদ্ধটা একা একাই করেছি, একদম কাউকেই জানাইনি। আল্লাহ যাতে উভয়কেই বুঝার তাওফিক দেন, কষ্ট সহ্য করার শক্তি দেন, হিদায়াত দান করেন, অনবরত এই দুআ করছিলাম সিজদায় পড়ে।

ফেসবুকের সব ছবি, সব ফানি পোস্ট ডিলিট করে দিয়ে প্রোফাইলটাকে একদম সাদামাটা বানিয়ে ফেলেছিলাম একদিনেই। যোগাযোগের কোনো প্রচেষ্টাতেই রেসপন্স করিনি। মেসেঞ্জারে মেসেজ বা এসএমএস আসলে সাথে সাথে ডিলিট করে দিয়েছি। আমার দিক থেকে নূন্যতম সাড়া আর না পেয়ে, আমি আর সেই আমি নেই বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন পরই আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল। আর কোনোদিন আসেনি। আলহামদুলিল্লাহ।

প্রাথমিক ঝড় সামলানোর পর আরও কিছু কাজ বাকি ছিল। ফোন নাম্বার, এসএমএস, পুরো ফেসবুক কনভার্সেশন ডিলিট করে দিয়েছিলাম। সব গিফট দান করে দিয়েছিলাম। চিঠিগুলো ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ড্রেনে ফেলে দিয়েছিলাম। ফোনে কোনো ছবি রাখতাম না, তাই গ্যালারি ক্লিন করার প্রয়োজন পড়েনি। ওকে এবং ওর সাথে রিলেটেডদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে মুছে ফেলেছিলাম তাৎক্ষণিকভাবে। ব্লক করার প্রয়োজন বোধ করিনি। নিজের ওপর সচেতনভাবেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলাম।

তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমার সেই ‘অমানুষিক খাটুনি আর মানসিক চাপওয়ালা’ চাকরি নিয়ে। ফিরে গিয়েছি সেই আগের জীবনে। প্রচন্ড চাপ আর ব্যস্ততার মাঝে দুঃখবিলাস করার কোনো সুযোগই হয়ে উঠেনি। চাকরির প্রচন্ড চাপ আর ব্যস্ততা একদম মোক্ষম ওষুধ হিসেবে কাছ করেছে জীবনের এই সন্ধিক্ষণে।

তারপর জীবনে অনেক পরিবর্তন। রবের দিকে ফেরার রোমাঞ্চকর এক জার্নি। সেই গল্প আরেকদিন ইনশাআল্লাহ।

সেই যুদ্ধের দুই বছর পর, অনেক অনেক ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর কাছে প্রতি মোনাজাতে দুআ করি একজন চক্ষুশীতলকারিণীর জন্য, ক্ষমা চাই অতীতের অবাধ্যতার জন্য।

বিঃদ্রঃ অনেকেই হয়তো ভেতরে ভেতরে উসখুস করছেন মেয়েটার কী হলো পরে জানার জন্য! হুম, বছরখানেক আগে মেয়েটার বিয়ে হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। সাবেক সহকর্মীদের সাথে আড্ডায় কথা প্রসঙ্গে তথ্যটা জেনেছিলাম।

ফাঁদে আটকা পড়া ভাইবোনদের জন্য কিছু পরামর্শ:

আমরা যারা হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে আছি, একেকজনের রিলেশনের অবস্থা পারিপার্শ্বিকতা অনুসারে একেকরকম। তবে এখানে একটা জিনিস কমন; সেটা হচ্ছে, আমরা ফিরে আসতে চাই। এবং আন্তরিক নিয়ত থাকলে, দৃঢ় সংকল্প থাকলে আমরা ফিরে আসতে পারব ইনশাআল্লাহ। শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মনে জোর রাখতে হবে। নিচের পয়েন্টগুলো মাথায় রেখে কাজ করলে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে আশা করি ইনশাআল্লাহ।

১. ‘আমি আল্লাহর জন্য ফিরে আসছি। আল্লাহর অবাধ্য হয়ে স্থায়ী শান্তি অর্জন কখনো সম্ভব না। আল্লাহ তারচেয়েও উত্তম প্রতিদান আমার জন্য রেখেছেন।’ এই চিন্তাটা অন্তরে একদম গেঁথে ফেলতে হবে। ওপরের কথাগুলো নিঃসন্দেহে চরম সত্য। আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে যে সম্পর্কগুলো গঠিত হয় এগুলোতে চোখের শীতলতা থাকে না, শান্তি থাকে না। ভুরিভুরি প্রমাণ আমাদের আশেপাশেই আছে। হারাম সম্পর্ক থেকে সরে এসে আমার পুরো জীবনটাই বদলে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। হিদায়াতের এই জীবনে অন্যরকম প্রশান্তি। এখন শুধু ভয়ে ভয়ে একটা দুআই করি–‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে দ্বীনের ওপরেই স্থির রেখো।’

২. Time will heal everything. সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। ক্লোজ বন্ধুদের যারাই ব্রেকআপ খেয়ে আমার হেল্প চাইতে এসেছে সবাইকে আমি এই কথাটাই সবার আগে বলেছি, এবং সেটাই সত্যি হয়েছে পরে। ঝড়-ঝঞ্ঝা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে শিখেছে সবাই। কারও জীবন কারও জন্য থেমে থাকেনি। সময় সব ক্ষত সারিয়ে দিয়েছে। যার যার পথে সে এগিয়ে গেছে। একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষের জন্য এটাই আদর্শ পদ্ধতি। সুইসাইড করা বা বিড়িখোর-গাঞ্জাখোর হয়ে যাওয়া, স্মৃতি আকঁড়ে পরে থেকে দুঃখবিলাস করা, এগুলো দুর্বল ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। ‘ওকে ছাড়া ক্যামনে বাচঁব’ বা ‘ও আমাকে ছাড়া ক্যামনে বাঁচবে’ এইসব আবেগী চিন্তাধারা বাদ দিয়ে নিজের পথ ধরুন একদম স্বার্থপরের মতো। এই মানসিকতা ধারণ করতে পারলেই সাময়িক আবেগের ভাঙ্গা ঘাট পেরিয়ে স্থায়ী সুখের বন্দরে নোঙর করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।

৩.‘মন ভাঙ্গা মাসজিদ ভাঙ্গার সমান’, ‘বদদুআ পড়বে’, ‘কোনোদিন সুখী হবে না’ ব্লা ব্লা ব্লা এসব বানোয়াট টোটকা নিয়ে হাজির হবে অনেকেই। একদম চোখ-কান বন্ধ করে উপেক্ষা করে যান এসব। হারাম থেকে বেরিয়ে আসুন। বাকিটা আল্লাহর হাতে।

হারাম সম্পর্ক থেকে সরে আসবেন এই নিয়ত করার পর সেটা নিয়ে কারও কাছেই পরামর্শের জন্য যাওয়ার দরকার নেই। কুবুদ্ধি দিয়ে আপনাকে হারামেই ফিরিয়ে আনবে আবার। এটাই হয় বেশিরভাগ। একা একাই লড়াই চালান। আল্লাহ আছেন সাথে।

৪.কোনো গুনাহ করে ফেললে সেটার জন্য আন্তরিকভাবে তাওবা করতে কখনো বিলম্ব করা যাবে না। জীবনের সবক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। গুনাহ করে তাওবা করলে আল্লাহ সেই গুনাহ থেকে বেরিয়ে আসার পথ সহজ করে দেন। আমরা যারা হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে আছি, আসুন আগে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা করি, ক্ষমা চাই, ফিরে আসার জন্য আন্তরিকভাবে সংকল্প করি।

৫. ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিদায়ী সাক্ষাত, বিদায়ী মেসেজ, বিদায়ী আলাপ এসব না করাটা সবচেয়ে উত্তম। একদম বিনা নোটিশে সরে আসুন সম্ভব হলে। অনেক ভাই শেষবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। সিদ্ধান্ত জানিয়ে মেসেজ দিলেন ঠিক আছে, ফিরতি মেসেজে যে আবেগের ঝাপটা আসবে সেটা সামলে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি আছে তো? না কি আবেগের ঠ্যালায় আবার ভেসে যাবেন?

৬. ফিরে আসার পর খুব জোরেশোরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে। একদম চিরুনি অভিযান যাকে বলে। অপর পক্ষের সাথে নিয়মিত দেখা হয়, কথা হয় এরকম মানুষগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারলেই সবচেয়ে ভালো। ছবি, মেসেজ, ইনবক্স, ফোন নাম্বার সব ডিলিট করে ফেলতে হবে। ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ছাঁটাই করতে হবে। সব গিফট কাউকে দান করে দিতে হবে, নাহয় ডাস্টবিনে ফেলতে হবে সোজা। একদম ভাবলেশহীন চিত্তে কাজগুলো সারতে হবে। কোনো অজুহাতে পিছপা হওয়া চলবে না। সামান্যতম চিহ্নও রাখা যাবে না। স্মৃতি মনে পড়ে যাবে এরকম সব ব্যাপার থেকে সতর্ক থাকতে হবে। পরবর্তীতে কোনো মেসেজ, কল আসলে সাবধানতার সাথে এড়িয়ে যেতে হবে। স্মৃতি মনে পড়ে গেলেই ইসতিগফার পড়তে হবে সাথে সাথে। স্মৃতিগুলোকে পশ্রয় দেয়া যাবে না।

৭.গান শোনা, মুভি-নাটক-মিউজিক ভিডিয়ো টোটালি বাদ। এগুলোও আল্লাহর অবাধ্যতা। অন্তরকে কঠিন করে ফেলবে। আপনাকে সেই হারাম সম্পর্কেই টেনে নিয়ে যাবে। দৃষ্টি হিফাযত করতে হবে, গুনাহ থেকে বাঁচতে হবে। তবেই এই দৃষ্টির শীতলতার ব্যবস্থা করে দেবেন আল্লাহ। হারাম সম্পর্ক বাদ দেয়ার নিয়ত যে করতে পারে, তার জন্য এসব ছেড়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না ইনশাআল্লাহ। ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে সব নন-মাহরাম ছাঁটাই হবে একদম নির্দয়ের মতো। ফেসবুকে ‘ভালোবাসার ফুল’, ‘প্রেমের যন্ত্রনা’ টাইপের যত পেইজ-গ্রুপ আছে সব আনফলো করে দিতে হবে। প্রেমের গল্প-উপন্যাস পড়া বাদ দিতে হবে। ওপরের সব বিষয়ের খুব ভালো বিকল্প আমাদের আছে। জাস্ট একটু খুঁজে নিতে হবে। এতটুকুই।

৮. নিজেকে প্রচন্ড ব্যস্ত রাখতে হবে। ব্যস্ততা অনেক বড় ওষুধ। নিজেকে ব্যস্ত রাখলে শূন্যতা, একাকিত্ব, বিরহ, স্মৃতিকাতরতা গ্রাস করার সুযোগই পাবে না। অবসর, একাকিত্ব এগুলো আপনাকে তিলে তিলে শেষ করে দেবে। এমন ব্যস্ত থাকতে হবে যাতে রাতে শোয়া মাত্রই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারেন।প্রচন্ড খাটুনিওয়ালা চাকরিতে ব্যস্ত না থাকলে আমি ফিরে আসতে পারতাম কি না সেটা নিয়ে আমি খুবই সন্দিহান। সিরিয়াসলি।

৯. পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এই জার্নির জন্য মানসিক প্রস্তুতির জন্য মুহাম্মাদ ﷺ-এর জীবনী, সাহাবিদের জীবনী এবং অন্তর নরম হয় এমন বই পড়তে হবে।

১০. সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মূল্যবান পরামর্শ -

‘নিশ্চয়ই ইবাদাতের জন্য রাতে উঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণে অনুকুল।’

(সূরা মুযযাম্মিল, ৭৩ : ৬)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই’। অতএব কুপ্রবৃত্তি দমনে তাহাজ্জুদের ভূমিকা আশা করি আর খুলে বলতে হবে না।তারপরও নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, আপাত দৃষ্টিতে যে অভ্যাসটা ছাড়া আপনার জন্য রীতিমতো অসম্ভব মনে হচ্ছে, জাস্ট তাহাজ্জুদে দাড়ানোর অভ্যাসটা রপ্ত করুন। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে দেখবেন ইনশাআল্লাহ।

ধূমপান, মাদকাসক্তি, হারাম সম্পর্কসহ যেকোনো ধরনের আসক্তি দূরীকরণে তাহাজ্জুদ অনেক কার্যকরী একটা ইবাদাত।

তাহাজ্জুদে দাড়ানোর অনুপ্রেরণার জন্য একটা বই সাজেস্ট করছি, আমার খুবই প্রিয় একটা বই। শাইখ আহমাদ মূসা জিবরীল-এর ‘কিয়ামুল লাইল’। ৩০ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা বই, কিন্তু তাহাজ্জুদের ব্যাপারে অনুপ্রেরণামূলক আলোচনায় একদম ঠাসা!হারাম সম্পর্ক নিয়ে যখন সংগ্রাম করছিলাম তখনই হাতে আসে বইটি। পড়ার পর খুবই অনুপ্রাণিত হই মাশাআল্লাহ! বইটি পড়ার দিন থেকে তাহাজ্জুদে দাড়ানোকে অভ্যাসে পরিণত করতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। তাহাজ্জুদে দাঁড়ানোর অভ্যাস করার পর থেকে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

শীতকাল হোক আর গ্রীষ্মকাল হোক, খাওয়াদাওয়া, ঘুম আর শারীরিক সক্রিয়তা নিয়ে একটু সচেতন হলে, লাইফস্টাইলে একটু ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে আর ইস্পাত কঠিন সংকল্প থাকলে তাহাজ্জুদের অভ্যাস গড়ে তোলাটা মোটেই কঠিন কিছু না। আর তাহাজ্জুদের অভ্যাস যার আছে তার ফজরও মিস হবে না ইনশাআল্লাহ।

তাহাজ্জুদ এবং ফজর আদায় করে শয়তানের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে জয়ী হয়ে দিন শুরু করা গেলে দিনের বাকি সময়টাতেও শয়তান বারে বারে পরাজিত হবে ইনশাআল্লাহ।

শেষকথা:

ফিরে আসাটা একদিনের কাজ না। এটা একটা প্রসেস, একটা জার্নি। এই জার্নি শেষ করতে গিয়ে আগের ‘আমি’ আর বর্তমান ‘আমি’ কে অনেক বেশি বদলে ফেলতে হবে। পুরো লাইফস্টাইল চেঞ্জ করে ফেলতে হবে। হারাম সম্পর্ক পরবর্তী মুক্ত-স্বাধীন জীবনটা অনেক শান্তিময় আলহামদুলিল্লাহ।

হারাম সম্পর্কের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসি চলুন। যে চক্ষুশীতলকারিণী আল্লাহ আমাদের জন্য ঠিক করে রেখেছেন তার যোগ্য হওয়ার জন্য পুরোদমে কাজে লেগে পড়ি চলুন। চরিত্র সংশোধনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিই চলুন। আল্লাহ আমাদের পথচলা সহজ করে দিন। আমীন।