ফরজ! শব্দটি শুনলেই আমাদের এমন কিছু বিধিবিধান মাথায় আসে, যা অবশ্যই পালন করতে হবে। অর্থাৎ অবশ্যপালনীয় বিধানসমূহ। আমরা আজকে এমন একটি বিপ্লব সম্পর্কে জানব, যার নামই ছিল ফরায়েজী আন্দোলন। ফরায়েজী আন্দোলন হলো একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে সূচিত হয়েছিল। ফরায়েজী আন্দোলনের মুখপাত্র ছিলেন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক হাজী শরীয়তউল্লাহ রহিমাহুল্লাহ। আজ আমরা জানব ফরায়েজী আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহ সম্পর্কে।

হাজী শরীয়তউল্লাহ রহিমাহুল্লাহর জন্ম ১৭৮১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুর জেলার চর শামাইল গ্রামের এক তালুকদার পরিবারে। ছেলেবেলায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। হজের উদ্দেশ্যে তাঁর গুরু মাওলানা বাশারত আলীর সাথে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় গমন করেন। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন। আরবি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন তিনি।

মক্কায় থাকাকালীন হাজী শরীয়তউল্লাহ সংকল্পবদ্ধ হন যে, দেশে ফিরে সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হবেন। তাই মক্কা থেকে ফিরেই সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠে, তা-ই ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে হাজী শরীয়তউল্লাহ যে ফরজের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা ছিল পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পাঁচটি অবশ্যপালনীয় (ফরজ) রুকন বা খুঁটি। এগুলো হচ্ছে: ঈমান বা আল্লাহর একত্ব ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর রিসালাতে বিশ্বাস, সালাত, সাওম, হজ ও যাকাত। ইসলামে অনুমোদিত নয় এমন সব বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান বর্জন করে দ্বীন ইসলামে যা কিছু অবশ্য করণীয়, তা পালন করার জন্য তিনি মুসলিম সমাজকে আহ্বান জানান।

হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পরেননি। তিনি বিধর্মী ইংরেজ শাসনকে ঘৃণা করতেন। তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব’ বলে ঘোষণা করেন। ‘দারুল হারব’ মানে হলো কুফরি শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্র। অর্থাৎ, যে ভূখণ্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থা নেই, তা-ই দারুল কুফর তথা দারুল হারব।

যাই হোক, সে সময় মুসলিমদের মাঝে অনেক হিন্দুয়ানি প্রথা ও আচার-আচরণের প্রচলন ঘটেছিল। পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই খালি চোখে হিন্দু ও মুসলিমদের মাঝে তেমন পার্থক্য করা যেত না। পাশাপাশি ইংরেজ শাসনের বলে মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে জমিদাররা বাধা প্রদান করতে থাকে। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের এলাকায় গরু কুরবানি এবং আযান দেওয়া নিষিদ্ধ হলো। মুসলিমদের ওপর নানা ধরনের কর আরোপ করা হলো। দাড়ি রাখলে কর দিতে হতো। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ উপলক্ষ্যেও মুসলিম প্রজাদের কর দিতে হতো হিন্দু জমিদারদের। এ ছাড়া ফসলের ওপরেও করের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো। পাশাপাশি নীলকরেরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল কৃষকদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করছিল।

দিন দিন শোষণের মাত্র বেড়েই যাচ্ছিল। যেটা হাজী শরীয়তউল্লাহ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি নির্যাতিত-বঞ্চিত সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলেন। অন্যায় কর প্রদান করতে নিষেধ করেন। হাজী শরীয়তউল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার শোষিত, নির্যাতিত, দরিদ্র রায়ত, কৃষক, তাঁতি, তেলি সম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে। শুধু মুসলিমরাই নয়, নিম্নশ্রেণির শোষিত হিন্দুরাও দলে দলে যোগ দিল ফরায়েজীদের সঙ্গে।

আল্লাহর ইচ্ছায় হাজী শরীয়তউল্লাহ রহিমাহুল্লাহর প্রচেষ্টায় মুসলিমরা সমাজে প্রচলিত শিরক-বিদআত ও হিন্দুয়ানি প্রথা দূর করে ইসলামের মূলে ফিরে আসে। শোষিত-বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত জনসাধারণ হাজী শরীয়তউল্লাহর আহ্বানে নতুন প্রাণসঞ্চারণ অনুভব করল। দলে দলে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে দশ হাজার মুসলিম তাঁর দলভুক্ত হলো। অত্যাচারী হিন্দু জমিদাররা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। এখন মুসলিমদের আর আগের মতো নির্যাতন করা যাবে না। যেসব নিম্নশ্রেণির দরিদ্র মুসলমানদেরকে তারা তাদের দাসে পরিণত করেছিল, তারাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব, তাদের উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে উঠারই কথা।

কুফরি শক্তি সবসময় ইসলামকে ভয় পাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাইরে থেকে মনে হতে পারে কুফর অনেক শক্তিশালী, কিন্তু এর পরাজয় সুনিশ্চিত। তাদের অন্তরে সব সময় পরাজয়ের আতংক লেগেই থাকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই একমাত্র সাহায্যকারী, যিনি কাফিরদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করেন আর মুমিনদের বিজয় দান করেন।

আল্লাহ বলেন,

‘যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন, তবে তোমাদের ওপর কেউই বিজয়ী হতে পারবে না; এবং যদি তিনি তোমাদের সাহায্য না করেন, সে অবস্থায় এমন কে আছে যে, তোমাদেরকে সাহায্য করবে? মুমিনদের উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করা।’[1]

ফরায়েজীরা ইংরেজদের সাথে অসহোযোগিতার নীতি অবলম্বন করেন। এর অংশ হিসেবে তাঁরা ইংরেজদের শোষণের হাতিয়ার আদালত বয়কট করেন। পরিবর্তে স্থানীয় আদালত ব্যবস্থা বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এই আদালতে স্থানীয়ভাবেই সকল বিচার-সালিস করা হতো। ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের মতে, পূর্ব বাংলার পঞ্চায়েতগুলো জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফরায়েজীদের নিয়ন্ত্রিত গ্রামগুলোতে সংঘটিত হিংসাত্মক বা মারামারির কোনো ঘটনা কদাচিৎ নিয়মিত আদালত পর্যন্ত গড়াত। ফরায়েজী-প্রধান ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তি করতেন, তাৎক্ষণিকভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করতেন। এমনকি যেকোনো হিন্দু বা খ্রিষ্টান তার পাওনা আদায়ের জন্য ফরায়েজী নেতাদের কাছে অভিযোগ পেশ করতে পারত। এর ফলে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, মানব সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্য বস্তুগত উন্নয়নের চেয়েও ইনসাফ তথা ন্যায়বিচার বেশি জরুরি। ফরায়েজীরা এ কাজটিই করতে পেরেছিলেন। আগেই বলেছি, জমিদারদের বিরুদ্ধে ফরায়েজীদের সহায়তা লাভের জন্য এ আন্দোলনে যোগ দেন বিপুলসংখ্যক হিন্দু ও দেশীয় খ্রিষ্টান। কেননা, শোষণ-নিপীড়ন কেউই সহ্য করতে পারে না। ভিন্নধর্মী হওয়া সত্ত্বেও তারা একাত্মতা প্রকাশ করেছিল ফরায়েজীদের সাথে।

এভাবেই যখন আন্দোলনের ব্যপ্তি বাড়তে থাকল, তখন ইংরেজ, নীলকর আর জমিদারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তাই ১৮৩৭ সালে তারা শরীয়তউল্লাহ রহিমাহুল্লাহকে তিতুমীরের মতো স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগের ‘অভিযোগে’ অভিযুক্ত করে। ফরায়েজীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় অসংখ্য মামলা। ইউরোপীয় নীলকররা তাদের সহায়তা করে। কিন্তু ফরায়েজীদের প্রচেষ্টাগুলো ছিল সুচিন্তিত। রাষ্ট্র ও প্রচলিত আইনকে সরাসরি লঙ্ঘন করছিল না তাদের প্রয়াস। দিনশেষে অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। তারপরও হাজী শরীয়তউল্লাহ রহিমাহুল্লাহকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয় কিছুদিনের জন্য। তাঁর মুক্তির জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিল শোষক শ্রেণির মানুষেরা।

১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহ মারা যান। কিন্তু থেমে যায়নি এই আন্দোলন। পরবর্তীতে তার ছেলে মুহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার হাত ধরে ফরায়েজী আন্দোলন পায় অন্য মাত্রা। আমাদের আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং সত্যিকার ইসলামি জীবনধারার উত্থানের প্রয়াসের পাশাপাশি স্বাধীকারচেতনার নতুন জমি তৈরি  হয় দুদু মিয়ার হাত ধরে, যার ওপর পা রেখেছে কৃষিপ্রধান বাঙালি মুসলমানের পরবর্তী অগ্রগতি!

পরবর্তী পর্বে আমরা জানব মুহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া সম্পর্কে এবং কীভাবে এগিয়ে গিয়েছিল সেই ফরায়েজী আন্দোলন! সেই পর্যন্ত উপলব্ধি করতে থাকো মহান এই মানুষটির কাজের গুরুত্ব ও সাধারণ শোষিত মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে।

[চলবে ইনশা আল্লাহ…]


[1] সূরা আ-লি ইমরান, ৩ : ১৬০

[চতুর্থ সংখ্যায় (জুন-আগস্ট ২০২৩) প্রকাশিত]