আমি ওমর (ছদ্মনাম)।[1] মিশরের নামি এক হোটেলে কাজ করতাম আমি। এখন মদীনার এক হোটেলের ম্যানেজার। আমার হোটেলটা মসজিদে নববির একেবারেই কাছে। আমাদের সবার প্রাণের চেয়ে প্রিয় রাসূলুল্লাহ ﷺ শুয়ে আছেন যেখানে। ইচ্ছে হলেই আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মসজিদে সালাত আদায় করতে পারি। ছুটে গিয়ে বলতে পারি—আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ। মিশর থেকে মদীনায় এসে এমন সৌভাগ্যের পেছনে আমার একটা গল্প আছে। সেই গল্পটাই আজ আমি তোমাদের শোনাব।

মিশরের হোটেলে কাজ করার সময় আল্লাহর রহমতে ভালোই আয় ছিল আমার। আমার কাজে হোটেলের মালিকও খুব খুশি ছিলেন। তবে এই হোটেলে কাজ শুরু করার পর থেকেই আমার ভেতরে একটা দ্বিধা কাজ করছিল। এই হোটেলে নিয়মিত মদ্যপানের আসর বসত। আমার দায়িত্ব ছিল খদ্দেরের কাছে মদ পৌঁছে দেওয়া। বুঝতে পারছিলাম আমি পাপের সাগরে ডুবে যাচ্ছি। কিন্তু পরিবারের জন্য আমি বেশ কিছুদিন কাজটা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিবেক আমাকে দংশন করে যাচ্ছিল। আর পারছিলাম না। শেষমেষ এক প্রকারের দিশেহারা হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম একজন বড় আলিমের কাছে যাবার।

আমি তাঁর কাছে গিয়ে সব খুলে বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও।’ তাঁর কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, ‘শাইখ, আমি যদি আমার এই চাকরি ছেড়ে দিই, তাহলে আমি বেকার হয়ে যাব। বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারব না। আমার স্ত্রী-সন্তান খাবে কী, পরবে কী?’ তিনি বললেন, ‘তাহলে কি তুমি চাও আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কাজ আমি তোমাকে করতে বলি?’ আমি মাথা নিচু করে রইলাম। তিনি বললেন, ‘স্মরণ করো কুরআনের সেই আয়াত,

“যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য মুক্তির পথ তৈরি করে দেন এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক দেবেন, ‎যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (সূরা তালাক, আয়াত : ২-৩)‎

তুমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। চাকরিটা ছেড়ে দাও।’

হোটেলে ফিরে আসলাম। সারারাত অনেক ভাবলাম। অনেক ভেবে মন শক্ত করলাম। আল্লাহ গায়ে শক্তি দিয়েছেন, যোগ্যতা দিয়েছেন, ইনশাআল্লাহ কোনো-না-কোনো কাজ করে সংসার চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু এই মদের বারে আর কাজ করব না।

পরদিন সকালে অনেক সাহস করে পদত্যাগপত্র লেখা শুরু করলাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। বস ফোন করেছেন। উনি যা বললেন তা আমি নিজের কানেই শুনলাম। কিন্তু তারপরেও আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি।

‘ওমর সুখবর আছে। তোমাকে প্রমোশন দিয়ে সৌদি আরবে বদলি করা হয়েছে। মদীনার এক হোটেলে তুমি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করবে। মদীনা যাবার জন্য জলদি রেডি হয়ে নাও। আর হ্যাঁ, সেই হোটেলে কিন্তু মদ বিক্রি করা হয় না।’

আমার দুচোখে আনন্দের অশ্রু চলে আসলো। আল্লাহ এত দ্রুত আমার দুআ কবুল করবেন ভাবতেও পারিনি।

***

মুসনাদু আহমাদে হুমাইদ বিন হিলাল সূত্রে এক বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি নবিজি ﷺ -এর কাছে এলাম আর তিনি আমাকে একটি ঘর দেখিয়ে বললেন, “এই বাড়িতে এক নারী বাস করত, যে এক মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীর সাথে অভিযানে যায়। সে তার মালিকানাধীন বারোটি ছাগল ও কাপড় বোনার কাঁটা ঘরে রেখে যায়। এর মধ্যে একটি ছাগল ও কাঁটা হারিয়ে যায়। সে দুআ করে, হে আল্লাহ, যে আপনার রাস্তায় বের হয়, আপনি তার হিফাজতের ওয়াদা করেছেন। আমি একটি ছাগল ও কাপড় বোনার কাঁটা হারিয়ে ফেলেছি। আমি আপনার কাছে মিনতি করছি তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।”

রাসূল ﷺ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার উদ্দেশে ওই নারীর করা দুআর গভীরতা নিয়ে মন্তব্য করলেন। তিনি বললেন, “সকালে জেগে উঠে সে হারানো ছাগল ও কাটা ফিরে পেল এবং সেই সাথে অনুরূপ আরও পেল। যদি চাও, তাহলে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।” আমি বললাম, “আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি।”’

***

আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করে পাপ কাজ ত্যাগ করলে আল্লাহ এর চাইতেও উত্তম বস্তু আমাদের দান করেন। অথচ আমরা তাঁর ওপর ভরসা করতে পারি না। পরীক্ষায় নকল বা দেখাদেখি করে না লেখলে কয়টা নম্বরই না হয় কম পাব, কিন্তু হারাম কাজ করা থেকে তো বেঁচে থাকব। আমি যদি আল্লাহর জন্য হারাম কাজ ত্যাগ করি, আল্লাহ কি আমাকে উত্তম জীবিকার ব্যবস্থা করে দেবেন না? কোনো মেয়ে/ছেলের সাথে আমার প্রেম করতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে মোবাইলে অশ্লীল কিছু দেখতে। কিন্তু আল্লাহর ভয়ে, আল্লাহর ওপর ভরসা করে যদি হারামে না জড়াই, ব্রেকআপ করে ফেলি, তাহলে আল্লাহ কি আমাকে এদের চাইতেও উত্তম মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে দেবেন না? যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে হারাম কাজ ত্যাগ করে আল্লাহ কি তাদের পানিতে ফেলে দেন? আল্লাহর ওপর এই বিশ্বাসটুকুও কি আমাদের নেই?

[1] সত্য ঘটনা অবলম্বনে। উৎস- A TRUE STORY. THE POWER OF TAWAKKUL, quranclass.net- https://tinyurl.com/tawaqqul