মফস্বলের ভাঙাচোরা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মিরাজ ও তার ছেলে রাজন। আজ স্কুল ছুটি থাকায় রাজন বাবার সাথে আসার সুযোগ পেয়েছে। যদিও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, তবুও তার খুব ভালো লাগছে বাবার সাথে সারাদিন থাকতে পারবে এটা ভেবেই। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আর না পেরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। অগত্যা মিরাজও থেমে গেল।

কী রে বাজান, থামলি ক্যান?

করুণ চেহারায় সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ’আর হাঁটতে পারছি না আব্বা, পা ব্যাথা করছে।’

তাড়াতাড়ি করে জিনিসপত্র সব বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে রাজনকে কোলে তুলে নিলো মিরাজ। ছোট মানুষ এতক্ষণ ধরে হাঁটছে, সে কি সইতে পারে এত ধকল! নিজের ওপরই রাগ হলো মিরাজের।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা হোটেলের কাছে পৌঁছে গেল তারা। ছোট্ট রাজন খাবার জিনিস দেখে আর খিদে সইতে না পেরে বাবার কাছে আবদার করেই বসল। শুকরিয়া আল্লাহর, পকেট হাতড়ে যতটা টাকা পেল তাতে হয়তো ছেলেটার জন্য সামান্য কিছু খাবার পাওয়া যাবে।

বাপ-ছেলেতে হোটেলের দোরগোড়ায় পৌঁছুতেই তড়িঘড়ি করে ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে তাদের পথ আটকে দিল!

এই এই! তোরা কোথায় যাচ্ছিস?

আমার পোলাডার খুব খিদা লাগছে ভাইজান, অয় পরোটা খাইতে চায়। এই জন্য…

মিরাজের কথা শেষ হবার আগেই নাক-মুখ কুঁচকে লোকটা চিৎকার করে উঠল।

বের হ! বের হ এখান থেকে! তোরা হোটেলে ঢুকলে আমার সব কাস্টমার হোটেলে থেকে বেরিয়ে যাবে। তোরা এখানে ঢুকতে পারবি না। যা, দূর হ!

ভাইজান এমন কইরেন না, আমার পোলাডার দিকে দেহেন, ছোট মানুষ। কতক্ষণ না খাইয়া আছে! একটু দয়া করেন।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে লোকটা রাজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে রাস্তার পাশের বেঞ্চের দিকে ইশারা করে বলল, ‘ঐখানে বেঞ্চ পাতা আছে, ওখানে গিয়ে বোস। আমি কাউকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খাবার খেয়ে বিদেয় হয়ে যাবি। এখানে যেন না দেখি আর। যত্তসব নোংরা লোক!’

বিড়বিড়িয়ে আরও পাঁচ-দশটা বাজে কথা বলতে বলতে ভেতরে চলে গেল লোকটা। রাজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। মিরাজ লজ্জায় অপমানিত হয়ে মুখ নিচু করে ছিল এতক্ষণ, এখন ছেলের দিকে তাকিয়ে বড্ড খারাপ লাগছে তার।

রাস্তার ধারের গাছের নিচে বালতিটা রেখে টিউবওয়েলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিলো মিরাজ। রাজনেরও হাতমুখ ধুইয়ে নিজের ঘাড়ের গামছাটা দিয়ে যত্ন করে মুখ মুছিয়ে দিল সে। কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে এসে বেঞ্চের ওপর প্লাস্টিকের থালায় দুটো পরোটা আর একটা প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি দিয়ে চলে যায়। মিরাজ বুঝতে পারছে তাকে কেউই ভালো চোখে দেখছে না। একবুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলেকে খাইয়ে দিতে লাগল সে।

বাবা সবটুকু তাকেই খাইয়ে দিচ্ছে দেখে রাজন বলল, ‘আব্বা, তুমি খাইবা না?’

মিরাজ হেসে বলল, ‘আমার খিদে নাই বাজান, তুই খা।’

কিন্ত তার ছেলে তো নাছোড়বান্দা। বাবার কথা সে শুনতে নারাজ। তাই নিজেই এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে বাবার মুখে দিয়ে দিল। বাবার কাছে এরচেয়ে শান্তির আর কিছুই নেই হয়তো। বুকটা তার ঠান্ডা হয়ে গেল শান্তিতে।

খাওয়া শেষে প্লেটের নিচে বিশ টাকা রেখে উঠে যায় মিরাজ-রাজন। গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে বসে পড়ে তারা।

হঠাৎ একটা আহত কাক ছিটকে পড়ে গেল ঠিক ওদের কাছেই। রাজন দ্রুত কাকটাকে তুলে মিরাজের কাছে নিয়ে আসলো।

আব্বা, কাকটা কি মইরা গেল?

না রে বাজান, মরে নাই। একটু পানি দিই থাম, আজ এত্ত গরম!

মিরাজ দ্রুত কাকটার মাথায় একটু পানি দিল, রাজন আঁজলা করে পানি খাওয়াতে চেষ্টা করল তাকে। কাকটা একটু ভালো বোধ করতেই আবার উড়ে চলে গেল সেখান থেকে।

কাকটার দিকে তাকিয়ে থাকল রাজন, যতক্ষণ না সে দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল। বাবার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করল, ‘আব্বা?’

কী রে বাজান?

মাইনসে তো ঘরে পাখি পুষে, কত যত্ন করে। কিন্তু কাকরে দেখলেই মারে কেন? কাকও তো একটা পাখি।

মিরাজ একটু নড়েচড়ে বসল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করল, ‘ছোটবেলায় যহন ইশকুলে যাইতাম, আমাদের রামু মাস্টার আমাদের পড়াইত। উনি কইতেন, কাক হইল ঝাড়ুদার পাখি।’

কথার মাঝে ফোড়ন কেটে রাজন জিজ্ঞেস করল- কাকরে ঝাড়ুদার পাখি কেন বললা, আব্বা? কাক কি ঝাড়ু দিয়া বেড়ায়?

সেইটাই বলতাছি, শোন! কাকরে ঝাড়ুদার পাখি বলে, কারণ সে পরিবেশের আবর্জনা খাইয়া পরিষ্কার কইরা ফেলে।

কাক উপকার করে, তাও মানুষ ওগো ঘেন্না করে কেন, আব্বা?

মানুষ সুন্দরের পূজারী রে, বাজান। কাক সুন্দর হইলে তারেও মানুষে মাথায় নিয়া নাচত। কিন্তু মাইনসে কাকের উপকার বুঝে না। সব কাক মইরা গেলে যে ওগো ঘরবাড়ি ময়লার ভাগাড় হইত সেইটা বুঝে না মানুষে! মালিকে সবকিছুই সৃষ্টি করছে কোনো-না-কোনো কামের জন্য।

এতক্ষণ ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনছিল ছোট্ট রাজন। হঠাৎ সে বাবাকে বলে উঠল, ‘আব্বা, তুমিও তাইলে কাক।’

কেন রে বাজান, আমারে কাক কস কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সে।

কারণ, তুমিও সব ময়লা পরিষ্কার কইরা পরিবেশ পরিষ্কার রাখো। মানুষের ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখো। তুমি কাজ না করলে তো মানুষের বাড়িঘর ভাগাড় হইয়া যাইব!

ছেলের কথা শুনে হেসে ফেলল মিরাজ। বাবার কোলে মাথা রেখে রাজন বলল- আব্বা, আমি বড় হইয়া তোমার মতো হব।

মলিন চেহারায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল- না বাজান, তুই আমার মতো হইস না। কেউ তোরে সম্মান করব না। তুই পড়াশোনা করবি, অন্নেক বড় হইবি, মানুষের মতো মানুষ হইবি। আর সব মানুষকে সম্মান করবি, কাউরে তার কামের জন্য ছোট করবি না, ঠিক আছে? রাজন সুবোধ বালকের মতো মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। মিরাজ বালতি বাঁ হাতে তুলে নিয়ে ডান হাত দিয়ে রাজনের হাত ধরে আবারও হাঁটতে শুরু করল।