ইমাম সাহেব এ নিয়ে তিন-চারবার নিষেধ করলেন বক্স বাজানো বন্ধ করতে। তবুও ওদের হুঁশ ফেরেনি। উল্টো ইমাম সাহেবকে ঝাড়ি দিয়ে মসজিদে যেতে বলল।

—‘খায়া দায়া কোনো কামকাইজ নাই। পাইসে একটা, আমরা কোনো মজা ফূর্তি করলেই শালার বকবকানি শুরু হয়া যায়। আবার আসুক, দাঁড়া, একদম সোজা কইরা দিমু।’

দাঁত কটমট করে কথাগুলো বলল সৌরভ। চোখেমুখে যেন প্রতিশোধের অগ্নি-লাভা দাউদাউ করছে। সমবয়সীদের মধ্যে ও একটু স্বাস্থ্যবান, সুঠামদেহী। চাপাবাজী আর পল্টিবাজীতে সবার ‘সেরা’।

ঈদকে কেন্দ্র করে এবার পিকনিকের আয়োজন করেছে ওরা। প্রধান ভূমিকায় আছে সৌরভ, রনি, কিবরিয়া আর সুমন। সারাদিন মহল্লার মাঠে ধুমধামে বক্স বাজাবে আর নাচবে। শেষে বিরিয়ানি খাওয়ার মধ্য দিয়ে পিকনিক শেষ করবে—এমনটিই ওদের প্ল্যান প্রোগ্রাম।

কিন্তু ঝামেলা বাধালেন ইমাম সাহেব। উনি একটু পরপর এসে বক্স বন্ধ করতে বলে যান। বলেন, মুসল্লিদের নামাজে নাকি ব্যঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, অসুস্থ রোগী, বয়স্ক ও শিশুদের কষ্ট হচ্ছে। সৌরভরা ইমাম সাহেবের এই নিষেধাজ্ঞা কানেই নেয়নি। উল্টো আগের তুলনায় আরও জোরে জোরে বক্স বাজাতে শুরু করল। তৃতীয়বার যখন ইমাম সাহেব নিষেধ করতে এলেন তখন তো ওরা রীতিমতো হুমকিধামকি দিয়ে দিল।

‘আবার আসলে কিন্তু সমস্যা হয়া যাইব কইলাম!’ সৌরভের কড়া হুশিয়ারী। কিন্তু ইমাম সাহেব দমে যাওয়ার পাত্র নন। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে তিনি প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন।

চতুর্থবার কয়েকজন মুসল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসলেন ইমাম সাহেব। এবার যেন একটু উত্তেজিতই হয়ে উঠলেন।

—‘কী ব্যপার! তোমাদেরকে এত করে বলছি তারপরেও তোমরা থামছ না! কী শুরু করে দিলে তোমরা? বলো তো!’

জবাবে প্রথমে মুখ খুলল কিবরিয়া।

—‘হুজুরের মনে হয় ভাল্লাগতাসে না, তাই না! ভালো কইরা বলতাসি, ডিস্টার্ব কইরেন না, অবস্থা কিন্তু বেশি ভালো হইব না, কয়া দিলাম।’

চৌদ্দ বছর বয়সী এই পুঁচকে ছেলের মুখে এ ধরনের হুমকি শোনে কার মেজাজ ভালো থাকবে! ঠাস করে মুসলিম উদ্দিন মিয়া চড় বসিয়ে দিলেন ওর গালে। ‘বেয়াদব কোথাকার! কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় আদবকায়দা কিছুই জানোস না!’

মুসলিম উদ্দিন মিয়ার এই একটি চড় যেন ওদের ক্ষোভে আগুন ধরিয়ে দিল। এতক্ষণ সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখছিল সৌরভ। এবার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। পাশে রাখা একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে শপাং শপাং করে পেটাতে শুরু করল মুসলিম উদ্দিন মিয়া, ইমাম সাহেব এবং আগত মুসল্লিদের। ওর দেখাদেখি যে যা হাতে পেল তা দিয়ে আঘাত করতে লাগল। সুমন নামের ছেলেটা ওদেরকে বাধা দিতে গিয়েছিল, উল্টো ওর পিঠেও পড়ল কঞ্চির আঘাত।

ছেলেপেলেগুলোর হঠাৎ এমন আচরণে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন ইমাম সাহেব। কোনোমতে নিজের জান বাঁচিয়ে মুসল্লিদের নিয়ে ফিরলেন মসজিদে। ইমাম সাহেবের ডান হাতের কোণে রক্ত জমে গেছে। মুসলিম উদ্দিন মিয়া কপালে শক্ত আঘাত পেয়েছেন। খুব সম্ভবত কেউ ভাঙা ইট ছুঁড়েছিল। তা ছাড়া বাকি দুইজন তেমন চোট পাননি। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। এলাকাবাসীর কানে পৌঁছতেও বেশি সময় লাগেনি।

তখন মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছিল। পুরো মসজিদ ভর্তি ছিল মুসল্লিদের দিয়ে। ইমাম সাহেবের সঙ্গে ঘটা এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা তাই খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে মুসল্লিদের ভেতর। চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের একটি দল তৎক্ষনাৎ ছুটে গেল পিকনিকের স্থানে। কিন্তু গিয়ে কোথাও পাওয়া গেল না ওদের। ওরা বুঝতে পেরেছে, আজ আর ওদের রক্ষা নেই। তাই আগেভাগেই পালিয়েছে।

পরেরদিন এলাকাবাসী মিটিংয়ে বসল, ঘটে যাওয়া এ ঘটনার সুরাহা করতে। সৌরভ-কিবরিয়া গ্যাংদের ধরে আনা হলো। মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো, প্রথমে ওদের প্রত্যেকের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হবে, তারপর একশো বার করে কান ধরে ওঠবস করবে। শেষে ইমাম সাহেব এবং মুসলিম উদ্দিন মিয়াসহ পুরো এলাকাবাসীর কাছে উক্ত ঘটনা ঘটাবার জন্য ক্ষমা চাইবে। কিন্তু এইখানেও ঝামেলা বাধালেন ইমাম সাহেব। বললেন এক আজব কথা।

‘আমার পক্ষ থেকে আজকের মতো ওদের ক্ষমা করে দেওয়া হলো। ওরা তো ছোট মানুষ। অবুঝ। আশা করি, ওরা ওদের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। তাই আমি বলব, সামনে থেকে যাতে আর কখনো এমন দূর্ঘটনা না ঘটায়।’

ইমাম সাহেবের এমন ফায়সালা মেনে নিতে এলাকাবাসী প্রথমে অসম্মতি জানালেও পরে ইমাম সাহেবের পীড়াপীড়ির কারণে মেনে নিলো। সৌরভ কিবরিয়ারাও নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। কেউ বলার আগেই ওরা দৌড়ে এসে ইমাম সাহেবের পায়ে পড়ল। করজোড়ে ক্ষমা চাইল। অটোমেটিক ওদের চোখ বেয়ে যেন অশ্রুর বান বইতে লাগল। এলাকাবাসী গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আশ্চর্য হয়ে দেখল ইমাম সাহেবের ক্ষমার মহত্ত্ব এবং ফল। তারপর থেকে মোহাম্মদবাগ এলাকায় কখনো পিকনিকের নামে এমন গানবাজনা হয়নি। ইমাম সাহেবের উদার ক্ষমার কারণে সৌরভ কিবরিয়ারাও হয়ে গেল তাঁর ভক্ত। ওরা এখন মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি।