ছোটবেলায় একটা সায়েন্স ফিকশন বই পড়েছিলাম। বইয়ের মূল চরিত্র একটা ওষুধ খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আমারও ইচ্ছা করত, যদি অদৃশ্য হতে পারতাম তার মতো। অদৃশ্য হতে পারলে কত মজার মজার কাজ করা যেত, তাই না? ছোটবেলার সেই শখ পূরণ হয়েছে বড়বেলায় এসে। এখন চাইলেই আমি অদৃশ্য হতে পারি। মিথ্যা বলছি না, সত্যি! তুমিও অদৃশ্য হতে চাও আমার মতো? তাহলে তোমার জন্যেই এই লেখা।

শুরুতে বলে নিই, কেন আমি মাঝে মাঝে অদৃশ্য হই।

ক্লাস নাইন-টেনে পড়তাম তখন। এনালগ ফোনের যুগ শেষ হয়ে বাজারে সবে মাল্টিমিডিয়া ফোন আসা শুরু করেছে। আমার এক বড়লোক বন্ধু মোহসীন বাবার কাছ জেদ ধরে থেকে মাল্টিমিডিয়া ফোন কিনল। স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ছিল। সে লুকিয়ে ফোন নিয়ে আসত। লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করত। এভাবে কয়েকদিন চলল। শীত আসি আসি করছে। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। স্কুল শেষে স্কুলেই কোচিং করায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।

একদিন স্কুল শেষে মোহসীন আর আমাদের আরেকজন বন্ধু হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিল। মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। মেইন রোডের পাশের একটা চিপামতো গলির কাছে আসামাত্র তাকে একটা যুবক ছেলে ডাক দিল। হাতে এক টুকরা কাগজ- বড় ভাই, শোনেন একটু! এই ঠিকানাটা কোথায় বলতে পারেন!

মোহসীন মেইনরোড থেকে চিপা গলিতে যাওয়া মাত্র অন্ধকার থেকে আরও কয়েকটা ছেলে বের হয়ে আসলো। একজন ওর গলায় ক্ষুর ধরে বলল- সঙ্গে  যা আছে দিয়ে দাও চাঁদু, না হলে গলা দুফাক করে দেবো। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল মোহসীন। সঙ্গে সঙ্গে মাল্টিমিডিয়া ফোন, টাকা যা ছিল দিয়ে দিল। এই ঘটনার পর মোহসীন খুবই ভেঙে পড়েছিল। সেই এলাকায় আমার আরও দুয়েকজন বড়ভাই, ছোটভাই ছিনতাইকারীর হাতে পড়েছিল।

ভার্সিটিতে পড়ার সময় এরচেয়েও একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন তানযিলের সঙ্গে। সেমিস্টার ব্রেকের ছুটি শেষে সে হলে ফিরছিল। রাতের বাস ছিল। টাঙ্গাইলের কাছে এসে তার বাসে ডাকাত পড়ে। বাসের সবাইকে বেঁধে সমানে মারধর করে ওরা। এরপর সবার সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। তানযিল চোখে তেমন দেখতে পেত না চশমা ছাড়া। ওর চশমাটা পর্যন্ত কেড়ে নেয়। এরপর সবাইকে চলন্ত বাস থেকে এক এক করে ফেলে দেয়। তানযিলকে ফেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের এক নির্জন স্থানে। রাত ৪ টার সময়। কী ভয়াবহ অবস্থা, চিন্তা করো।

বাস ডাকাতি, ছিনতাই, নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন এসব ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই আঁতকে উঠতে হয়। আমাদের সমাজব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে, মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে গেছে। হানাহানি-মারামারি-শত্রুতা-খুন-রাহাজানি-সন্ত্রাস-জুলুম অনেক বেড়ে গিয়েছে। এজন্যেই আসলে এসব অমানুষদের কাছ থেকে, শত্রুদের কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাই আমি। তোমারও অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দরকার, তাই না?

অদৃশ্য হবার পদ্ধতি সংক্রান্ত নিচের এই লেখাটি নেওয়া হয়েছে Ruqyah Support BD এর ওয়েবসাইট[1] থেকে-

কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মুশরিকদের দৃষ্টি থেকে আত্মগোপন করতে চাইতেন, তখন কুরআনের তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এর প্রভাবে শত্রুরা তাঁকে ﷺ দেখতে পেত না। আয়াত তিনটি হলো-

সূরা কাহফের (৫৭ নাম্বার) আয়াত-

إِنَّا جَعَلْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَن يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا ۖ

অর্থ- নিশ্চয়ই আমি তাদের অন্তরসমূহের ওপর পর্দা দিয়ে দিয়েছি, যাতে তারা তা (কুরআন) বুঝতে না পারে। আর তাদের কর্ণসমূহে রয়েছে বধিরতা।

সূরা নাহলের (১০৮ নাম্বার) আয়াত-

أُولَٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ ۖ

অর্থ- এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহ, শ্রবণসমূহ ও দৃষ্টিসমূহের ওপর আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন।

সূরা জাসিয়া’র (২৩ নাম্বার) আয়াত-

فَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِ غِشَاوَةً

অর্থ- তুমি কি লক্ষ্য করেছ তার প্রতি যে তার খেয়াল-খুশিকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনেশুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আর তার কানে ও দিলে মোহর মেরে দিয়েছেন আর তার চোখের ওপর টেনে দিয়েছেন পর্দা।

কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ এর এই ব্যাপারটি আমি সিরিয়ার এক ব্যক্তির কাছে বর্ণনা করি। তিনি কোনো প্রয়োজনে রোমে গমন করেন। বেশ কিছুদিন সেখানে অবস্থান করার পর তিনি রোমের কাফিরদের নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়লে প্রাণভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। শত্রুরা তার পিছু নেয়। এমন সংকটময় মুহূর্তে হঠাৎ হাদীসটি তার মনে পড়ে। তিনি দেরি না করে আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করতেই শত্রুদের দৃষ্টির সামনে পর্দা পড়ে যায়। তিনি যে রাস্তায় চলছিলেন, শত্রুরাও সেই রাস্তাতেই চলাফেরা করছিল, কিন্তু তারা তাঁকে দেখতে পাচ্ছিল না।

ইমাম সা’লাবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি আমি ‘রাই’ অঞ্চলের এক ব্যক্তির কাছে বর্ণনা করেছিলাম। ঘটনাক্রমে সায়লামের কাফিররা তাকে গ্রেপ্তার করে। তিনি কিছুদিন কয়েদে থাকার পর সুযোগ পেয়ে পালিয়ে যান। শত্রুরা তাকে পেছনে ধাওয়া করে। তিনি আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করলে আল্লাহ তাদের চোখের ওপর পর্দা ফেলে দেন। ফলে তাদের দৃষ্টি থেকে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। অথচ তারা পাশাপাশি চলছিল আর তাদের কাপড় তার কাপড় স্পর্শ করছিল।

ইমাম কুরতুবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘এই আয়াত তিনটির সাথে সূরা ইয়াসিনের সেই আয়াতগুলোও মিলানো উচিত, যেগুলো রাসূলুল্লাহ ﷺ হিজরতের সময় তিলাওয়াত করেছিলেন। তখন মক্কার মুশরিকেরা তাঁর ﷺ বাসা ঘেরাও করে রেখেছিল। তিনি ﷺ আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে তাদের মাঝখান দিয়ে শুধু চলে যাননি, বরং তাঁদের মাথায় ধুলো নিক্ষেপ করতে করতে যান। কিন্তু তাদের কেউ টেরও পায়নি। সূরা ইয়াসিনের আয়াতগুলো (১-৯ নং আয়াত) হলো-

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

يس 

وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ

إِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ

عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ 

تَنزِيلَ الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ

لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أُنذِرَ آبَاؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُونَ

لَقَدْ حَقَّ الْقَوْلُ عَلَىٰ أَكْثَرِهِمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

نَّا جَعَلْنَا فِي أَعْنَاقِهِمْ أَغْلَالًا فَهِيَ إِلَى الْأَذْقَانِ فَهُم مُّقْمَحُونَ

وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ

১) ইয়া-সীন ২) প্রজ্ঞাময় কুরআনের কসম। ৩) নিশ্চয়ই আপনি প্রেরিত রাসূলগণের একজন। ৪) সরল পথে প্রতিষ্ঠিত। ৫) কুরআন পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ, ৬) যাতে আপনি এমন এক জাতিকে সতর্ক করেন, যাদের পূর্বপুরুষগণকেও সতর্ক করা হয়নি। ফলে তারা গাফেল। ৭) তাদের অধিকাংশের জন্যে শাস্তির বিষয় অবধারিত হয়েছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না। ৮) আমি তাদের গর্দানে চিবুক পর্যন্ত বেড়ী পরিয়েছি। ফলে তাদের মস্তক উর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। ৯) আমি তাদের সামনে ও পেছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর তাদেরকে আবৃত করে দিয়েছি, ফলে তারা দেখে না।

ইমাম কুরতুবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমি স্বদেশ আন্দালুসে কর্ডোভার নিকটবর্তী মনসুর দুর্গে নিজেই এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। অবশেষে নিরুপায় অবস্থায় আমি শত্রুদের সামনে দিয়ে দৌড়ে এক জায়গায় বসে গেলাম। শত্রুরা দুই জন অশ্বারোহীকে আমার পিছে ধাওয়া করার উদ্দেশে প্রেরণ করে। আমি সম্পূর্ণ খোলা মাঠেই ছিলাম, নিজেকে আড়াল করার মতো কোনো বস্তুই ছিল না। আমি তখন বসে বসে সূরা ইয়াসিনের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করছিলাম। অশ্বারোহী ব্যক্তি দুই জন আমার সম্মুখ দিয়ে ‘লোকটি কোনো শয়তান হবে’ বলতে বলতে যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে গেল। তারা আমাকে অবশ্যই দেখেনি, আল্লাহ তাদেরকে আমার দিক থেকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন।[2]

তাহলে? অদৃশ্য হবার টেকনিক তো শিখিয়েই দিলাম। জলদি মুখস্থ করে নাও। আর যেখানে যখন মন চায় হয়ে যাও অদৃশ্য। তবে হোমওয়ার্ক ফাঁকি দিয়ে ক্লাসে গেলে স্যারের দৃষ্টি থেকে আড়াল হতে পারবে কি না, তার গ্যারান্টি কিন্তু নেই!

[1] https://ruqyahbd.org/blog/1652/hidden-from-enemy

[2] মাআরেফুল কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল, পৃষ্ঠা : ৫১২-৫১৪