মাঝেমধ্যেই পুরোনো এক বন্ধু ফোন করে। কুশলাদি জানতে চায় উষ্ণ কন্ঠে। সেদিন দুপুরের দিকে ফোনে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। কন্ঠটা একটু ভার ভার মনে হলো। বুঝলাম, মন খারাপ। কী হয়েছে জানতে চাইলাম।

বন্ধু যা বলল তার সারমর্ম হলো, তার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই (ছেলেমেয়ে। বন্ধু আমার ততটা প্র্যাক্টিসিং না) কমবেশি ভালোবাসার জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। এরকম অস্থির পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও বন্ধুর গায়ে অশ্লীলতার বাতাস সেরকম লাগেনি। এরকম পরিবেশে সে কতদিন ভালো থাকতে পারবে সে জানে না। আমার কাছে জানতে চাইল, এখন সে কী করবে? চুপ করেই থাকলাম। কীই-বা বলার আছে আমার? এই দেশে এই সময় এই প্রশ্নের যে কোনো উত্তর নেই।

বুকের একেবারে গভীর থেকে উঠে আসা বড় বড় দীর্ঘশ্বাসগুলোর আড়ালে সে চেষ্টা করছিল তার কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখার। কিন্তু পারল কই? সে শুধু একা নয়, তার মতো অনেকেই চারপাশের সস্তা ভালোবাসার ছড়াছড়ির মাঝেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো একা একা লড়ে যায় এই সমাজটার বিরুদ্ধে। তাদের পবিত্র থাকার আকুতিগুলো, হৃদয়ের আর্তনাদগুলো চার দেয়ালের মাঝেই থমকে যায়। ভোগবাদের জোয়ারে গা ভাসানো এই সমাজটার সময় নেই এই ছেলেগুলোর কষ্টগুলো বুঝতে চেষ্টা করার, আর্তনাদগুলো শোনার। কিন্তু পরম করুণাময় সাত আসমানের ওপর থেকে নিশ্চয়ই দেখেন এই ছেলেগুলোর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। সিজদাহতে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানো এই ছেলেগুলোর চোখের পানির প্রতিদান একদিন নিশ্চয়ই তিনি দেবেন। ইনশাআল্লাহ।

এই হৃদয়হীন সমাজটা এই ছেলেদের কষ্টগুলো না বুঝুক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অবশ্যই বোঝেন এই ছেলেদের কষ্টগুলো। এই ছেলেগুলো তাঁরই ওপর ভরসা করে এবং তাঁর কাছেই প্রতিদান আশা করে।

‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক, ৬৫ : ৩)

এক ভাইয়ের সঙ্গে একবার কথা হচ্ছিল ঈদের দিন কে কীভাবে মজা করে এইগুলো নিয়ে। আমাদের জেনারেশনের ছেলেমেয়ে কোনো একটা উপলক্ষ পেলেই হয় – সেটাকে ভ্যালেন্টাইনস ডে বানিয়ে ফেলতে ভুল করে না।

ভাইকে সেদিন বলা হয়নি, আমার বেশি খারাপ লাগে আল্লাহর ঐসব অবুঝ বান্দার জন্য, যারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে একটা হারাম রিলেশানে জড়িয়ে আছে, বিনোদনের নামে অশ্লীলতায় ডুবে আছে। ফেসবুক, ইন্সটাতে নামীদামি রেস্তোরায় চেকইন, জানুপাই, বেবীপাই, কুট্টুস ক্যাপশনের কাপল সেলফি দেখে মনে হতে পারে, এরা বোধহয় বেশ সুখেই আছে, শান্তিতে আছে। আসলে এদের মনে এতটুকুও শান্তি নেই। বাবা-মার হাতে ফোনে কথা বলতে যেয়ে ধরা পড়ে যাবার টেনশন, বিএফ-জিএফের সাথে নিয়মিত দেখা করার ঝামেলা, রেস্টুরেন্ট বিল, এই সেই হাবিজাবি নিয়ে এদের প্রচুর টেনশনে থাকতে হয়। আল্লাহর আইনকে অমান্য করার জন্য আল্লাহ এদের অন্তর অশান্ত করে দেন। আর বিয়ের পরে তাদের সংসারে শুরু হয় আরও অশান্তি।

এইসব অবুঝ ভাইবোনেরা যদি জানত, হারাম রিলেশন থেকে দূরে থাকা ভাইবোনদের অন্তরগুলো কতটা শান্ত! আল্লাহ কী পরিমাণ সাকীনা ঢেলে দিয়েছেন সেই ভাইটির অন্তরে, যিনি রাস্তায় চলাফেরা করার সময় শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে চোখের হিফাযত করেন! তারা যদি উপলব্ধি করতে পারত সেই বোনটির অন্তরের প্রশান্তি, যিনি শীতের গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে তাঁর রবের সিজদাহতে যেয়ে দুআ করেন–তার রব যেন তাকে এমন একজন জীবনসঙ্গী দান করেন যিনি তাঁর চোখ শীতল করবেন।

ভাই, তুমি-আমি কি চাই না, জান্নাতের স্ত্রীকে নিয়ে খালি পায়ে সবুজ ঘাসের চাদরে হেঁটে বেড়াতে?

ফিতনায় ভরপুর এই যুগে নিজের নফসকে সংযত করা বড় কঠিন ভাই। আমরা কি সেই সময়ে চলে এসেছি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করা হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে থাকার চেয়েও বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে? বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, নাটক, সিরিয়াল, মুভি, পত্রিকা সবকিছুতেই বেহায়াপনার বিচরণ। শয়তান তার সকল হাতিয়ার ব্যবহার করে আমাদের সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটাতে চাচ্ছে এবং তাতে সে সফলও। সমাজের বেশিরভাগ মানুষই তার ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই বলে তুমি-আমিও কি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যাব?

ভাই, হারাম রিলেশন জিনিসটা শয়তান আমাদের কাছে শেয়ারিং, কেয়ারিং, রোমান্টিসজমের প্যাকেজ বানিয়ে অনেক আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে। বিয়েকে কঠিন করে ফেলা এবং ব্যভিচারকে সহজলভ্য করে ফেলা এই সমাজে শয়তানের এই প্যাকেজ ফিরিয়ে দেওয়া অনেক অনেক কষ্টকর। অশ্লীল ভিডিওর বিনোদন থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখাও তো অনেক কষ্টকর।
কিন্তু তোমার আমার এই কষ্ট কি বিলাল ইবনু রাবাহ রদিয়াল্লাহু আনহুর কষ্টের চেয়েও বেশি, যাকে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে খালি গায়ে শুইয়ে রেখে তাঁর ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো?[1]

তোমার আমার এই কষ্ট কি মুসআব ইবনু উমাইর রদিয়াল্লাহু আনহুর চেয়েও বেশি, যিনি মক্কার সবচেয়ে ড্যাম স্মার্ট, সুদর্শন, ধনী আদরের দুলাল ছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের কারণে তাঁকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল? পেছনে ফেলে আসতে হয়েছিল বিপুল ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার জীবন। অনাহারে থেকে শাস্তি ভোগ করে তার গায়ের চামড়া এমনভাবে উঠে গিয়েছিল, যেমন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে। খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীর্ণ পোশাকের মুসআব রদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখে চোখের পানি আটকাতে পারতেন না।[2]

ভাই, তাঁরাও তো আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন। তাঁরা যদি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এতটা কষ্ট করতে পারেন, ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তা হলে আমরা কেন এতটুকু কষ্ট করতে পারব না? আমরা কি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি না? না কি শুধু মুখেই দাবি করি?

ভাই, তুমি-আমি কি চাই না, জান্নাতের স্ত্রীকে নিয়ে খালি পায়ে সবুজ ঘাসের চাদরে হেঁটে বেড়াতে, অলস দুপরে নারিকেলবীথিতে বসে সমুদ্রের ঐ নীল জলরাশির দিকে চেয়ে থাকতে? তোমার কাঁধে তোমার প্রবাল ও পদ্মরাগ সদৃশ জান্নাতি স্ত্রী মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে, মাতাল বাতাসে তোমার জান্নাতি স্ত্রীর চুল এলোমেলো হয়ে তোমার চোখমুখে এসে পড়ছে, প্রাণভরে নিচ্ছ তুমি তাঁর চুলের সুবাস। যতবার তোমার স্ত্রী হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে যাচ্ছে, ততবার তাঁকে আগের বারের চেয়ে বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে, তাঁর মুখটার দিকে তাকিয়ে তুমি নতুন করে তাঁর প্রেমে পড়ে যাচ্ছ ততবার।

এইগুলো কি এমনি এমনি পেয়ে যাব তুমি-আমি? এর জন্য কষ্ট করতে হবে না? ভালো জিনিস কি কেউ এমনি এমনি দেয়? জান্নাতের স্ত্রীদের জন্য মোহরানার ব্যবস্থা করতে হবে না?

‘…তোমরা কি মনে করে নিয়েছ তোমরা এমনি এমনি জান্নাতে চলে যাবে? অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের ওপর সেরকম কোনো অবস্থা আসেনি, যেমনটি এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী নবিদের অনুসারীদের ওপর। তাদের ওপর এসেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট, এবং তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল, এমনকি স্বয়ং রাসূল ও তাঁর ঈমানদার সঙ্গীসাথিরা এক পর্যায়ে এই বলে আর্তনাদ করে উঠেছে, আল্লাহ্‌র সাহায্য কবে আসবে? অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।’[3]

ভাই, আমাদের রব আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন এই দুনিয়াতে। যাতে তিনি আমাদের পবিত্র করতে পারেন আমাদের পাপ থেকে, হাশরের ময়দানে আমাদের স্থান দিতে পারেন তাঁর আরশের ছায়ায়, কাউসার থেকে পানি পান করাতে পারেন, তাঁর দীদার দিয়ে আমাদের মানবজন্ম সার্থক করতে পারেন। তাই ভাই, দুনিয়ার এই ফিতনা, এই পরীক্ষায় হিম্মত হারিয়ে ফেললে হবে না। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, তাঁর নিকটে অনবরত সাহায্য চেয়ে আমাদের কোমর বেঁধে লাগতে হবে এই পরীক্ষা উৎরানোর জন্য। আমাদের মনজিল ভাই এই বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ডের দুদিনের রিলেশন না, যিনা-ব্যভিচারের সাময়িক ফুর্তি না, আমাদের মনজিল জান্নাত। জান্নাতে এক মুহূর্ত কাটানোর পর ভাই তুমি ভুলে যাবে দুনিয়ার এখনকার এই দুঃখ-কষ্টগুলো।

চলো না, এই জীবনের এই সাময়িক দুঃখ-কষ্টগুলো সিজদাহতে লুটিয়ে পড়ে চোখের পানিতে সমর্পণ করি আমাদের রবের কাছে।

‘আমি তো আমার দুঃখ-বেদনার অভিযোগ (তোমাদের কাছে নয়) আল্লাহর কাছেই করি।’[4]

***

[1] সীরাতু ইবনি হিশাম, 1/317-318; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ইবনু কাসীর, 4/144

[2] আর-রাউদুল উনুফ ফী শরহিস সীরাতিন নাবাবিয়্যাহ, সুহাইলী 4/52; সুনানে তিরমিযি, (2476)

[3] সূরা বাকারাহ, ২ : ২১৪

[4] সূরা ইউসুফ, ১২ : ৮৬