চোখের হিফাজত করার চেষ্টা করি। এরপরেও মাঝে মাঝে রাস্তাঘাটে, কোচিংয়ে, ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে, স্ক্রল করতে করতে ছবি বা ভিডিও চলে আসা কাউকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারি না। বারবার দেখে ফেলি। প্রেমে পড়ে যাই। এরপর সারাক্ষণ শুধু তাদের চিন্তাই মাথায় ঘোরে, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারি না… এমন সমস্যা অনেকেরই। সত্যিকথা বলতে আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রেমগুলোই হয় এভাবে… দূর থেকে কাউকে দেখে। এই সমস্যার জন্য করণীয় কী?[1]

প্রথম সমাধান হলো- ভালোমতো চোখের হিফাজত করা। তুমি কঠোরভাবে চোখের হিফাজত করতে পারছ না জন্যেই এই সমস্যার সূচনা হচ্ছে। আবার তাকাতে ইচ্ছা করলে নিজের সাথে কীভাবে লড়াই করতে হবে তা আলোচনা করা হয়েছে। সেটার উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে নাও।

সেই সাথে কিছু মনস্তাত্তিক ব্যাপার স্যাপার পরিষ্কার করে নাও-

ক) এটা যে ভালোবাসা না, এটা যে মোহ বা দৈহিক আকর্ষণ। তুমি গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ভাব নিতে চাও, বন্ধুমহলে স্ট্যাটাস রক্ষা করতে চাও… এগুলো হলো তোমার মনের না বলা কিছু কথা। এগুলোই হলো আসল কথা।

খ) তোমার নিজের জীবনের কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই, বাবা-মা তোমার সব অভাব পূরণ করে দিচ্ছে। তোমাকে টাকাপয়সা দিচ্ছে, টেবিলে খাবার দিচ্ছে, হাত খরচ দিচ্ছে… তাই তুমি তাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করতে পারছ। কী অদ্ভূত অদ্ভূত সব ফ্যান্টাসি… সমুদ্রের এক দ্বীপে তুমি আর সে আটকা পড়লে, আগুন জ্বালিয়ে মাছ পুড়িয়ে খাচ্ছ, এরপর একে অপরের ঘাড়ে মাথা রেখে সূর্যডোবা দেখছ, অথবা বৃষ্টির দিন তুমি ভিজে ভিজে যাচ্ছিলা, সে রিকশা থামিয়ে তোমাকে তুলে নিল রিকশায় অথবা পুরো পৃথিবীতে শুধু তুমি আর সে, আর কেউ নেই! তোমার যদি নিজে খাবার টাকা অর্জনের চেষ্টা করা লাগত, বাসা ভাড়া দেওয়া লাগত, জামা কাপড় কেনা, হাতখরচ সব সামলানো লাগত, তাহলে এসব চিন্তা করার সময়ই পেতে না। এসব ফ্যান্টাসি করে করে তুমি সময় নষ্ট করছ, তোমার ক্যারিয়ার, জীবন ধ্বংস করছ, পাপ করছ।

গ) কেউ সুন্দর হতেই পারে, কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব যে তোমার পছন্দ হবে এমন না। তোমার পছন্দের সম্পূর্ণ বিপরীতও হতে পারে। দূর থেকে তুমি তাকে দেখে মুগ্ধ, কিন্তু তার সম্পর্কে তোমার কাছে বস্তুনিষ্ঠ কোনো তথ্য নেই। তার পরিবার কেমন, তার স্বভাব-চরিত্র কেমন, তার পছন্দ-অপছন্দ কেমন, তার চাওয়া-পাওয়া, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী যেগুলো জানা দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন ও ভালোবাসা তৈরির জন্য দরকার, তার কিছুই তুমি জানো না। অথচ এই মানুষটার কথা চিন্তা করেই তুমি তোমার সময় নষ্ট করছ। এই মানুষটাকে তুমি প্রেমিকা বানিয়ে তোমাকে আঘাত করার অধিকার দিতে চাচ্ছ, তোমার নিয়ন্ত্রণ দিতে চাচ্ছ… এটা কি সুস্পষ্ট বোকামি আর পাগলামি না?

একটা ফোন কেনার আগেও তো তুমি অনেক যাছাই বাছাই করে নাও, অনেক দোকান ঘুরো… আর একটা মানুষকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলবে কোনো কিছু না জেনেই?

চোখের হিফাজত করো। এই পয়েন্টগুলো মাথায় রাখো। কাউকে দেখে ভালো লাগলে তাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি না করে ভাবো- হ্যাঁ, ঠিক আছে সে সুন্দর, অনেক আকর্ষণীয়। কিন্তু তার সাথে আমার বিয়ে হবে কি না তা আমি জানি না, আমার হাতে তথ্য নেই। আমি এখন জানতে চাইও না। সে তার মতো চলে যাক, আমি আমার রাস্তায় চলে যাই। খতম বাই বাই, টাটা গুডবাই গ্যায়া।

তার সাথে যদি আমার বিয়ে ঠিক করা থাকে, তাহলে দুজন পৃথিবীর দুকোণায় থাকলেও আল্লাহ আবার আমাদের এক জায়গায় নিয়ে আসবেন। আর যদি ভাগ্যে না থাকে তাহলে দুজন প্রেম করে ফেভিকল আঠা দিয়ে গায়ের সাথে গা জোড়া লাগিয়ে রাখলেও আমরা একসাথে থাকতে পারব না। তাই প্রেম করে, ফ্যান্টাসি করে দুনিয়া ও আখিরাত নষ্টের রিস্ক নেবার বাহাদুরি দেখানোর কোনো দরকার নেই। ঠিক আছে?

হয়তো এরপরেও কোনো মন খারাপের প্রহরে ইচ্ছে করবে ক্রাশের ওয়াল থেকে একটু ঘুরে আসতে—কী পোস্ট দিল, কোথাও ঘুরতে বা খেতে গেল কি না, নতুন কোনো ছবি আপলোড করল কি না, সেই ছবিতে ছেলেদের লাভ রিএক্ট আর কমেন্ট দেখে অনধিকার ঈর্ষাবোধ জেগে উঠবে। চোখে কাজল, কালো পাড়ের নীল শাড়ি পরা বালিকার সেই বিশেষ ছবিটা এর আগেও দেখেছ। অসংখ্যবার। অসংখ্যবার ফেলেছ দীর্ঘশ্বাস, আজ হয়তো আরেকবার ইচ্ছে করবে দেখতে। অবাধ্য চোখ বেয়ে হয়তো গড়িয়ে পড়বে দু’ফোটা অশ্রু, বালিশ ভিজবে অযথাই!

কী লাভ হয় এসব করে, বলো? বহুদিন, বহুবার তো করেছ এমন, শান্তি কি পেয়েছ? যে সুখের সন্ধানে তুমি উঁকি দাও ক্রাশের প্রোফাইলে, রাতের পর রাত জেগে কল্পনা করো, স্বপ্নের জাল বুনো, তার এতটুকুও কি তুমি পেয়েছ? না কি প্রত্যেকবার ফিরে গিয়েছ কলিজা পোড়া ঘ্রাণ নিয়ে?

মনের ইচ্ছেটাকে শক্ত হাতে দমন করো। পিপীলিকা হয়ে অযথা কেন আগুনের দিকে ছুটে যাও? কেন বারবার নিজেকে এভাবে কষ্ট দাও?

যেইদিন তুমি নিজেকে সংবরণ করতে পারবে ক্রাশের প্রোফাইল ঘাঁটা থেকে, ব্লকলিস্টে পাঠাতে পারবে মনে সংশয় দ্বিধা থাকলেও, সেইদিন থেকেই তুমি অনুভব করবে আল্লাহর জন্য স্যাক্রিফাইস করা কতটা আনন্দের, বুঝবে বেদনা কীভাবে কেমন মধুর হয়ে যায়। তুমি অনুভব করবে ঈমানের এক মিষ্টি স্বাদ, যেই স্বাদ পাবার জন্য যুগে যুগে কত আবিদ, কত আল্লাহওয়ালা সাধনা করে গিয়েছেন।

বিশ্বাস হচ্ছে না তো? একবার চেষ্টা করেই দেখো।


[1] বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারো ইলমহাউস পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত লস্টমডেস্টির ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ বইটি।